চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানোর ক্ষেত্রে ঢাকার দুই মহানগর হাকিমকে ফের ব্যাখ্যা দিতে বলেছে হাই কোর্ট।
Published : 29 Sep 2021, 12:57 PM
আগামী ২৪ অক্টোবর পরবর্তী আদেশের জন্য রেখে ওই সময়ের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা হাই কোর্টকে জানাতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়।
দুই হাকিমের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও আব্দুল আলিম মিয়া জুয়েল। আইন সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান।
বনানী থানার মাদকের মামলায় পরীমনিকে দ্বিতীয় দফায় দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন ঢাকার মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস। পরে একই মামলায় মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম তৃতীয় দফায় আরও এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
কী কী তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে পরীমনিকে শেষ দুই দফা রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছিল, দুই হাকিমের কাছে সেই ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল হাই কোর্ট।
জামিন সংক্রান্ত রুল ও রিমান্ডের বৈধতা প্রশ্নে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারির এক আবেদনের শুনানিতে হাই কোর্টের এই বেঞ্চ গত ২ সেপ্টেম্বর সেই আদেশ দেয়। দুই হাকিমকে ১০ দিনের মধ্যে তাদের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
সেই সাথে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মামলার নথিসহ (কেস ডকেট) আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। পরীমনিকে শেষ দুই দফা রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়।
নির্দেশ অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৫ সেপ্টেম্বর মামলার নথি নিয়ে হাজির হন। মার্জনা চেয়ে দুই মহানগর হাকিমের জমা দেওয়া লিখিত ব্যাখ্যাও সেদিন আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
দুই হাকিমের ব্যাখ্যায় উষ্মা প্রকাশ করে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক মোস্তফা জামান ইসলাম সেদিন বলেছিলেন, “রিমান্ড নিয়ে হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের যে গাইডলাইন এবং আমাদের প্রচলিত আইন আছে, তারা এগুলোর বিরুদ্ধে। যে কারণে আমরা তাদের জবাবে আমরা সন্তুষ্ট নই। যে কারণে পরবর্তী আদেশের জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখ রাখলাম।”
সে অনুযায়ী মঙ্গলবার বিষয়টি আদেশের জন্য উঠলে দুই মহানগর হাকিমের আইনজীবী আব্দুল আলিম মিয়া জুয়েল আদালতকে বলেন, “আপনারা গত ২ সেপ্টেম্বর আমাদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছিলেন। আমরা সেই ব্যাখ্যা রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে আপনাদের কাছে দাখিল করেছি। আপনার হস্তগত হয়েছে। কি কারণে দিয়েছি সে কারণগুলো বলেছি।”
এ সময় তাকে থামিয়ে দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আদালতকে বলেন, “দুজনই আমার কাছে এসেছিলেন, দুজনই ইয়াং অফিসার। দুজনই অনুতপ্ত, দুঃখিত। ট্রেনিংয়ের অভাবে প্রপারলি রিপ্লাইটা (ব্যাখ্যা) লেখা হয় নাই। উনারা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন আপনাদের কাছে।”
বিচারক মোস্তফা জামান ইসলাম তখন বলেন, “ঠিক আছে, আরেকটা রিপ্লাই দিক। আমরা সময় দিই। আগামী ২৪ অক্টোবর পরবর্তী আদেশের জন্য রাখছি।”
আইন সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী জেডআই খান পান্না তখন বলেন, “হ্যাঁ, আরেকটা রিপ্লাই দিক। কারণ সুপ্রিম কোর্টের আদেশ-নির্দেশনা (রিমান্ড নিয়ে) আছে। সেটা মানতে হবে।”
এরপর আদালত আগামী ২৪ অক্টোবর বিষয়টি পরবর্তী আদশের জন্য রেখে এই সময়ের মধ্যে দুই হাকিমকে ফের ব্যাখ্যা দিতে বলে।
আগের ব্যাখ্যায় যা বলেছিলেন দুই হাকিম
দ্বিতীয় দফায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার ব্যাখ্যায় ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস বলেছিলেন, রাষ্ট্র মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এ মামলার আসামি পরীমনি বিদেশি মদ, এলএসডি, এবং আইসসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন।
“এলএসডি মাদক যে কত ভয়ানক মাদক তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যুর পর দেশবাসী জানতে পেরেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের আত্মহত্যার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে এলএসডি উদ্ধারের ঘটনা তুলে ধরে এ ম্যাজিস্ট্রেট লেখেন, “এলএসডি মাদক যদি আমাদের যুব সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে যুব সমাজ ধ্বংস হতে পারে। এজন্য এখনই সময় যুব সমাজকে রক্ষার জন্য এলএসডিসহ অন্যান্য মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ার।”
দ্বিতীয় দফার রিমান্ড মঞ্জুরের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এ মামলায় (পরীমনির মামলায়) ভয়াবহ মাদক এলএসডিসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার হওয়ায় বিশেষত এলএসডি মাদকের উৎস এবং এর হোতাদের গ্রেপ্তারের জন্য আসামি পরীমনিকে রিমান্ডে পাঠানো যৌক্তিক প্রতীয়মান হওয়ায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনামত মহিলাকে পুলিশের উপস্থিতিতে রিমান্ড কার্যকরের নির্দেশ প্রদান করা হয়।”
ঢাকার মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, “উপরিউক্ত বিষয়সমূহ সার্বিক বিবেচনায় আমি দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ প্রদান করি। উক্ত আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে কোনোরূপ ত্রুটি-বিচ্যুতি নিতান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত এবং সরল বিশ্বাসে কৃত ভুল।”
এই ‘অনিচ্ছাকৃত ও সরল বিশ্বাসের ভুলের’ জন্য মার্জনা চেয়ে অধিকতর ব্যাখ্যা প্রদানের দায় থেকে অব্যাহতি চান দেবব্রত বিশ্বাস। ভবিষ্যতে রিমান্ড আদেশের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন।
ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলামের ব্যাখ্যাও প্রায় একই রকম। পরীমনির তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুরের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “মামলাটিতে নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ, এলএসডি এবং আইসের মত ধ্বংসাত্মক মাদকের উৎস, এর সাথে জড়িত ব্যক্তি, মাদকের অর্থের উৎস, এলএসডির মত নতুন ও ভয়ঙ্কর মদক কীভাবে দেশে প্রবেশ করেছে এবং কীভাবে বিস্তার ঘটেছে ইত্যাদি বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করার লক্ষ্যে বিচারক হিসেবে আমি তৃতীয় দফায় এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করি এবং মহামান্য আপিল বিভাগের নির্দেশনার আলোকে একজন নারী পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ প্রদান করি।”
মাদকের ভয়াবহতা, পরিণতি, যুব সমাজের কথা বিবেচনায় নিয়ে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এ রিমান্ড আদেশের ক্ষেত্রে কোনরূপ ত্রুটি-বিচ্যুতি নিতান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত এবং সরল বিশ্বাসে কৃত ভুল।’
তিনিও ‘সরল বিশ্বাসে করা ভুলের’ জন্য হাই কোর্টের কাছে মার্জনা চান এবং অধিকতর ব্যাখ্যা দেওয়া থেকে অব্যাহতি চান।
ভবিষ্যতে রিমান্ড আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম।
সেদিন এক হাকিমের ব্যাখ্যা আদালতে পড়ে শুনিয়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, “আমরা তাকে শোকজ করেছি কেন তিনি রিমান্ড মঞ্জুর করলেন। তিনি ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ে কোন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে সেটার বর্ণনা দিলেন।”
এরপর অন্য হাকিমের ব্যাখ্যা পড়ে শুনিয়ে বিচারক বলেন, “এখানে যে ত্রুটি হয়েছে তা তিনি বিশ্বাসই করেন না। হাই কোর্টকে আন্ডারমাইন করা হয়েছে।”
গত ৪ অগাস্ট ঢাকার বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে চিত্রনায়িকা পরীমনিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরদিন তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মাদক আইনে মামলা করা হয়। প্রায় এক মাস পর ১ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
এ মামলায় তিন দফায় মোট টানা সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। গত ৫ অগাস্ট প্রথম দফায় চার দিন, ১০ অগাস্ট দুই দিন এবং ১৯ অগাস্ট একদিনের রিমান্ডে পাঠনো হয় পরীমনিকে।
বার বার রিমান্ডের বৈধতা প্রশ্নে স্বতঃস্ফূর্ত রুল চেয়ে গত ২৯ আগস্ট হাই কোর্টে আবেদন করে মানবাধিকার ও আইনি সহায়তাকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ।
তা আদালতে উপস্থাপন করা হলে গত ১ সেপ্টেম্বর বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, তৃতীয় দফায় পরীমনির রিমান্ড মঞ্জুর করে ম্যাজিস্ট্রেট ‘রিমান্ড ক্ষমতার অপ্যবহার’ করেছেন।
“তাদের সামনে কী ম্যাটেরিয়াল (তথ্য-উপাত্ত) ছিল যে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে রিমান্ড মঞ্জুর করলেন? এগুলো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না।”
পরদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের উপস্থিতিতে শুনানি করে আদালত আদেশ দেয়। পরীমনির বিরুদ্ধে বনানী থানার মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করার পাশাপাশি শেষ দুই দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করা দুই হাকিমের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়।
হাই কোর্ট সেদিন বলেছিল, ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে এ দুই হাকিমকে তলব করা হতে পারে।