পরীমনির রিমান্ড: দুই হাকিমের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় হাই কোর্ট

চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানোর ক্ষেত্রে ঢাকার দুই মহানগর হাকিমের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2021, 06:49 AM
Updated : 15 Sept 2021, 11:56 AM

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার বলেছে, দুই হাকিমের একজন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মাদকের ভয়াবহতার কথা লিখেছেন। আর রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে যে ত্রুটি হয়েছে, অন্য হকিম তা ‘বিশ্বাসই করেন না’।

বনানী থানার মাদকের মামলায় পরীমনিকে দ্বিতীয় দফায় দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন ঢাকার মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস। পরে একই মামলায় মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম তৃতীয় দফায় আরও এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

কী কী তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে পরীমনিকে শেষ দুই দফা রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছিল, দুই হাকিমের কাছে সেই ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল হাই কোর্ট।

জামিন সংক্রান্ত রুল ও রিমান্ডের বৈধতা প্রশ্নে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারির এক আবেদনের শুনানিতে হাই কোর্টের এই বেঞ্চ গত ২ সেপ্টেম্বর এ আদেশ দেয়। দুই হাকিমকে ১০ দিনের মধ্যে তাদের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।

সেই সাথে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তলব করা হয়। মামলার নথিসহ (কেস ডকেট) তাকে আদালতে হাজির থাকতে বলা হয়। হাজির হয়ে পরীমনিকে শেষ দুই দফা রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। নির্দেশ অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তা এদিন মামলার নথি নিয়ে হাজির ছিলেন।

আর দুই মহানগর হাকিম তাদের লিখিত ব্যাখ্যা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে জমা দেন। বুধবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম দুই ম্যাজিস্ট্রেটের দাখিল করা ব্যাখ্যার অংশ পড়ে শোনান।

তিনি বলেন, “রিমান্ড নিয়ে হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের যে গাইডলাইন এবং আমাদের প্রচলিত আইন আছে, তারা এগুলোর বিরুদ্ধে। যে কারণে আমরা তাদের জবাবে আমরা সন্তুষ্ট নই।

“এই মামলায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে আমরা সন্তুষ্ট নই, যে কারণে পরবর্তী আদেশের জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখ রখলাম।”

দুই মহানগর হাকিমের মধ্যে একজন পরীমনিকে রিমান্ডে পাঠানোর সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে এলএসডি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের আত্মহত্যা এবং ওই মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরেন।

সেটি পড়ে শুনিয়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, “আমরা তাকে শোকজ করেছি কেন তিনি রিমান্ড মঞ্জুর করলেন। তিনি ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ে কোন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে সেটার বর্ণনা দিলেন।”

এরপর বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক অপর ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যাখ্যা পড়ে শোনান। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন, “উপরোক্ত বিষয় সার্বিক বিবেচনায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার আদেশের ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নিতান্তই আমার ইচ্ছাকৃত নয়, সরল বিশ্বাসে কৃত ভুল।”

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, “এখানে যে ত্রুটি হয়েছে তা তিনি বিশ্বাসই করেন না। হাই কোর্টকে আন্ডারমাইন করা হয়েছে।”

মার্জনার আবেদন দুই হাকিমের

দ্বিতীয় দফায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার ব্যাখ্যায় ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, রাষ্ট্র মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এ মামলার আসামি পরীমনি বিদেশি মদ, এলএসডি, এবং আইসসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন।

“এলএসডি মাদক যে কত ভয়ানক মাদক তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যুর পর দেশবাসী জানতে পেরেছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের আত্মহত্যার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে এলএসডি উদ্ধারের ঘটনা তুলে ধরে এ ম্যাজিস্ট্রেট লিখেছেন, “এলএসডি মাদক যদি আমাদের যুব সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে যুব সমাজ ধ্বংস হতে পারে। এজন্য এখনই সময় যুব সমাজকে রক্ষার জন্য এলএসডিসহ অন্যান্য মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ার।”

দ্বিতীয় দফার রিমান্ড মঞ্জুরের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এ মামলায় (পরীমনির মামলায়) ভয়াবহ মাদক এলএসডিসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার হওয়ায় বিশেষত এলএসডি মাদকের উৎস এবং এর হোতাদের গ্রেপ্তারের জন্য আসামি পরীমনিকে রিমান্ডে পাঠানো যৌক্তিক প্রতীয়মান হওয়ায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনামত মহিলাকে পুলিশের উপস্থিতিতে রিমান্ড কার্যকরের নির্দেশ প্রদান করা হয়।”

ঢাকার মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, “উপরিউক্ত বিষয়সমূহ সার্বিক বিবেচনায় আমি দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ প্রদান করি। উক্ত আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে কোনোরূপ ত্রুটি-বিচ্যুতি নিতান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত এবং সরল বিশ্বাসে কৃত ভুল।”

এই অনিচ্ছাকৃত ও সরলবিশ্বাসের ভুলের জন্য মার্জনা চেয়ে অধিকতর ব্যাখ্যা প্রদানের দায় থেকে অব্যাহতি চান দেবব্রত বিশ্বাস। ভবিষ্যতে রিমান্ড আদেশের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন।

ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলামের ব্যাখ্যাও প্রায় একই রকম। পরীমনির তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুরের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “মামলাটিতে নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ, এলএসডি এবং আইসের মত ধ্বংসাত্মক মাদকের উৎস, এর সাথে জড়িত ব্যক্তি, মাদকের অর্থের উৎস, এলএসডির মত নতুন ও ভয়ঙ্কর মদক কীভাবে দেশে প্রবেশ করেছে এবং কীভাবে বিস্তার ঘটেছে ইত্যাদি বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করার লক্ষ্যে বিচারক হিসেবে আমি তৃতীয় দফায় এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করি এবং মহামান্য আপিল বিভাগের নির্দেশনার আলোকে একজন নারী পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ প্রদান করি।”

মাদকের ভয়াবহতা, পরিণতি, যুব সমাজের কথা বিবেচনায় নিয়ে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এ রিমান্ড আদেশের ক্ষেত্রে কোনরূপ ত্রুটি-বিচ্যুতি নিতান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত এবং সরল বিশ্বাসে কৃত ভুল।’

তিনিও ‘সরল বিশ্বাসে করা ভুলের’ জন্য হাই কোর্টের কাছে মার্জনা চান এবং অধিকতর ব্যাখ্যা দেওয়া থেকে অব্যাহতি চান।

ভবিষ্যতে রিমান্ড আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও  সতর্ক থাকবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম।

ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান। আইন সালিশ কেন্দ্রের আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না।

পরে আইনজীবী জেড আই খান পান্না সাংবাদিকদের বলেন, “২৯ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তাকে আসতে বলা হয়েছে। আদালত বলেছেন, তারও ব্যাখ্যার দরকার আছে। ব্যাখ্যা দিতে হবে। আইনজীবীর মাধ্যমে বা তিনি নিজেও ব্যাখ্যা দিতে পারেন।”

গত ৪ অগাস্ট ঢাকার বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে চিত্রনায়িকা পরীমনিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরদিন তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মাদক আইনে মামলা করা হয়। প্রায় এক মাস পর বুধবার জামিনে মুক্তি পান তিনি।

এ মামলায় তিন দফায় মোট টানা সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। গত ৫ অগাস্ট প্রথম দফায় চার দিন, ১০ অগাস্ট দুই দিন এবং ১৯ অগাস্ট একদিনের রিমান্ডে পাঠনো হয় পরীমনিকে।

বার বার রিমান্ডের বৈধতা প্রশ্নে স্বতঃস্ফূর্ত রুল চেয়ে গত ২৯ আগস্ট হাই কোর্টে আবেদন করে মানবাধিকার ও আইনি সহায়তাকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ।

তা আদালতে উপস্থাপন করা হলে ১ সেপ্টেম্বর বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, তৃতীয় দফায় পরীমনির রিমান্ড মঞ্জুর করে ম্যাজিস্ট্রেট ‘রিমান্ড ক্ষমতার অপ্যবহার’ করেছেন।

“তাদের সামনে কী ম্যাটেরিয়াল (তথ্য-উপাত্ত) ছিল যে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে রিমান্ড মঞ্জুর করলেন? এগুলো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না।”

পরদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের উপস্থিতিতে শুনানি করে আদালত আদেশ দেয়। পরীমনির বিরুদ্ধে বনানী থানার মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করার পাশাপাশি শেষ দুই দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করা দুই হাকিমের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়।

হাই কোর্ট সেদিন বলেছিল, ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে এ দুই হাকিমকে তলব করা হতে পারে।