পরীমনির বার বার রিমান্ডে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ দেখছে হাই কোর্ট

মাদক মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনিকে তিনবার রিমান্ডে পাঠানোর ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করা হয়েছে বলে মনে করছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2021, 09:03 AM
Updated : 1 Sept 2021, 09:42 AM

পরীমনির রিমান্ডের বৈধতা প্রশ্নে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারির আবেদনের শুনানিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ পর্যবেক্ষণ দেয়।

শুনানির এক পর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, তৃতীয় দফায় পরীমনির রিমান্ড মঞ্জুর করে ম্যাজিস্ট্রেট ‘রিমান্ড ক্ষমতার অপ্যবহার’ করেছেন।

“তাদের সামনে কী ম্যাটেরিয়াল ছিল যে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে রিমান্ড মঞ্জুর করলেন? এগুলো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না।”

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও পরীমনির আইনজীবী মো. মুজিবুর রহমান। তাদের সঙ্গে ছিলেন সৈয়দা নাসরিন ও মো. শাহীনুজ্জামান।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহহিয়া দুলাল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান।

মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার প্রায় এক মাস পর বুধবার সকালে কারাগার থেকে মুক্তি পান চিত্রনায়িকা পরীমনি।

শুনানিতে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, “আমরা রিমান্ড সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের জাজমেন্ট আদালতে দাখিল করেছি। এখানে যেসব নির্দেশনা আছে, সেসব নির্দেশনা নিম্ন আদালতকে মেনে চলতে বলা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের মামলা ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে এসব নির্দেশনা মেনে চলা হয় না।”

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম এ সময় বলেন, “এই মুহূর্তে জামিন তো হয়ে গেছে। রুলটি শুনানির জন্য অনুপযুক্ত হয়ে গেছে।“

আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, “আমি জামিন বা রুলের বিষয়ে কিছু বলছি না।”

বিচারক তখন বলেন, “রিমান্ড বিষয়ে আমরা একটা গাইডলাইন দেব। সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন তো আছেই, তারপরেও মানছে না তারা (ম্যাজিস্ট্রেট)।” 

এসময় সেই গাইডলাইন অনুসরণ করার আদেশ চান আইনজীবী জেড আই খান পান্না।

পরীমনির আইনজীবী মো. মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ করে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, “আমরা সিনিয়র আইনজীবীর (জেড আই খান পান্নার) আবেদন নথিভুক্ত করে রাখব। তার (পরীমনির) রিমান্ড সম্পর্কে কী বলতে চান, বলতে পারেন।”

আইনজীবী মুজিবুর রহমান বলেন, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় যে বিধান আছে এবং আপিল বিভাগের যে গাইডলাইন আছে, সেগুলো পরীমনির রিমান্ডের ক্ষেত্রে ‘অনুসরণ করা হয়নি’।

বিচারক তখন জানতে চান, পরীমনির দ্বিতীয় দফার রিমান্ড কত দিনের ছিল। আইনজীবী উত্তরে বলেন- দুই দিন। প্রথম রিমান্ড ছিল চার দিনের। তৃতীয় রিমান্ড ছিল এক দিনের।

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম তখন রিমান্ড আবেদন মঞ্জুরকারী ম্যাজিস্ট্রেটের নাম জানতে চেয়ে আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে বলেন, “আমরা ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৩৫ এবং ৪৩৯ ধারা অনুযায়ী ওই রুলটা (দুই দিনের মধ্যে পরীমনির জামিন আবেদনের শুনানি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না) পেন্ডিং অবস্থায় ডাইরেকশন (নির্দেশনা) দিতে পারি।”

রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান তখন বলেন, রুল তো নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

বিচারক বলেন, “একটা অংশ নিষ্পত্তি হয়ছে। আরেকটা অংশ আছে।”

এরপর বিচারক আইনজীবীকে ফৌজদারী কার্যবিধি থেকে ৪৩৫ এবং ৪৩৯ ধারা পড়ে শোনাতে বললে আইনজীবী দুটি ধারা পড়ে শোনান।

এক পর্যায়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ৪৩৫ ও ৪৩৯ ধারার কথা উল্লেখ করে আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে বলেন, “আমরা এক্সামিন করতে পারি এবং রেকর্ডও কল করতে পারি। আমরা হাই কোর্ট বিভাগ সব কিছু করতে পারি।    

“আমরা তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে রিমান্ডের রেকর্ড কল করতে পারি একটা সন্তোষজনক জবাব দেওয়ার জন্য। জবাব দিতে যদি ফেইল করে তাহলে তাদের অ্যাপিয়ারেন্স (হাজির হওয়ার নির্দেশ) দেব যে, আমরা জবাবে সন্তুষ্ট না।” 

এরপর বিচারক রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এই বিষয়ে আদেশ দিলে আপনাদের কোনো সমস্যা আছে?”

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান তখন বলেন, ‘পরীমনির জামিন অবেদন শুনানির জন্য ২০ দিন পরের তারিখ রেখে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না’- এই রুলটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

বিচারক তখন বলেন, ‘দুই দিনের মধ্যে পরীমনির জামিন আবেদনের শুনানি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না’, এটা ৪৩৯ ধারায় ৪৯৮ (জামিনের আবেদন, মঞ্জুর সংক্রান্ত ধারা) এর শুনানি কত দিনের মধ্যে শুনতে হবে সে বিষয়ে একটি গাইডলাইন দেওয়া হবে।

“৪৩৯ ধারার আলোকে আমরা একটি গাইডলাইন দেব, মেট্রো সেশনগুলো (ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) জামিন আবেদন কতদিনের মধ্যে শুনবেন, এটা কি এক মাস পরে নাকি দুই মাস পরে, নাকি তিন দিন পরে।” 

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আজকে যে প্রশ্নটি উঠেছে, সেটি হচ্ছে রিমান্ড নিয়ে। অভিযুক্ত আবেদনকারীকে (পরীমনিকে) তিনবার রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখন কি রিমান্ডের উপর রুল ইস্যু করতে চাচ্ছেন?”

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, “রুল ইস্যু করতে চাচ্ছি না, রিপোর্ট কল করতে চাচ্ছি। তাদের কাছে কী ম্যাটেরিয়াল (উপাদান) ছিল তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করলেন।”

মিজানুর রহমান বলেন, “এখন তো সে (পরীমনি) রিমান্ডে নাই।”

বিচারক বলেন, “রিমান্ডে নাই। কিন্তু কী ম্যাটেরিয়াল ছিল যে, তিনবার রিমান্ডে দিলেন? কেন ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড ক্ষমতার অপ্যবহার করলেন? তারা এই মামলাটায় চার দিন রিমান্ডের পরে তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল কিনা, তদন্তকারী কর্মকর্তা, কেস ডকেটসহ (মামলার নথি) কোর্টে অ্যাপিয়ার করতে বলব।

“ম্যাজিস্ট্রেট দুজনের সামনে (যারা পরীমিকে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন) কী ম্যাটারিয়াল ছিল এটা জানতে চাইব। কোনো ম্যাটেরিাল ছাড়া আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) প্রেয়ার দিল (আবেদন করলেন) রিমান্ডের, আপনি (ম্যাজিস্ট্রেট) মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো তো কোনো সভ্য সমাজে হইতে পারে না, ঘটতে পারে না বর্তমানে।”

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এ সময় রিমান্ড নিয়ে আদেশের বিষয়টি পরের দিন রাখতে আরজি জানান। আদালত তখন বিষয়টি বুধবার বেলা ২টায় শুনানির জন্য রাখে।  

বেলা ২টায় শুননি শুরু হলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল বলেন, এ বিষয়ে শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল থাকবেন। সেজন্য তারা বৃহস্পতিবার সময় চাইছেন।

বিচারক বলেন, “আমরা কী শোকজ করতে পারব না? ব্যাখ্যা চাইতে পারব না?”

ডিএজি বলেন, “অবশ্যই পারেন। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল থাকতে চাচ্ছেন।”

এরপর আদালত শুনানি মুলতবি করে।

পরীমনিকে লাগাতারভাবে রিমান্ডে নেওয়ার বৈধতা প্রশ্নে স্বপ্রণোদিত রুল চেয়ে গত রোববার হাই কোর্টে আবেদন করে মানবাধিকার ও আইনি সহায়তাকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

পরে তা হাই কোর্টের এই বেঞ্চে উপস্থাপন করা হলে ‘পরে দেখব’ বলে  আদেশের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন জ্যেষ্ঠ বিচারক। তারই ধারাবাহিকতায় আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে।