২১ দিন পর শুনানি জামিন আবেদন খারিজের শামিল: হাই কোর্ট

লম্বা সময় পর শুনানির তারিখ রেখে মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া আদেশ চিত্রনায়িকা পরীমনির জামিন আবেদন ‘খারিজ করার শামিল’ বলে মন্তব্য করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 August 2021, 12:30 PM
Updated : 26 August 2021, 12:51 PM

বৃহস্পতিবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে এমন মন্তব্য আসে।

গত ২২ অগাস্ট পরীমনির পক্ষে জামিন আবেদন করা হলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ শুনানির জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর দিন রাখেন।

পরদিন আরেক আবেদনে ‘দ্রুত শুনানির’ আর্জি জানান পরীমনির আইনজীবী মজিবুর রহমান। সে আবেদনেও সাড়া না পেয়ে তিনি হাই কোর্টে রিটা আবেদন করেন। সেই সঙ্গে হাই কোর্টের কাছে পরীমনির জন্য জামিনও চাওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার প্রথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট রুল জারি করে। আদেশের অনুলিপি পাওয়ার দুই দিনের মধ্যে পরীমনির জামিন আবেদনের শুনানি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

সেই সঙ্গে ২২ অগাস্ট পরীমনি জামিন অবেদন করার পর শুনানির জন্য ২১ দিন পরের তারিখ রেখে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত যে আদেশ দিয়েছে, সেটি কেন বাতিল করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

আগামী ১ সেপ্টেম্বর রুল শুনানির তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে মহানগর দায়রা জজ আদালতকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

শুনানির এক পর্যায়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ করে বলেন, “জামিন আবেদনের বিষয়ে নিম্ন আদালত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে আদেশ দিয়েছে। ২১ দিন পর আদেশ দেবে, এটা জামিন আবেদনটি খারিজ করার শামিল।”

শুনানির শুরুতেই ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় করা পরীমনির জামিন আবেদনের বৃত্তান্ত তুলে ধরে আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, “ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে যে জামিন আবেদনটি করা হয়েছিল সেটি না শুনে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির তারিখ রাখা হয়েছে। এই আদেশের বিরুদ্ধেই আমরা এসেছি।”

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম তখন এ আইনজীবীকে মামলার এফআইআর থেকে পড়তে বলে ঘটনার তারিখ (পরীমনির বাসায় অভিযান, মাদক জব্দ ও তাকে আটক করা) এবং এফআইআর দায়েরের তারিখ জানতে চান।

আইনজীবী তখন বলেন, ঘটনার তারিখ এবং সময় হচ্ছে ৪ অগাস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। আর এআইআর দায়েরের তারিখ ও সময় হ ৫ অগাস্ট ৬টা ৪০ মিনিট।

ঘটনার কত ঘণ্টা পর এফআইআর দায়ের করা হয়েছে- বিচারক তা জানতে চাইলে আইনজীবী মজিবুর বলেন, প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর। তবে এফআইআরে বলা আছে, পরীমনিকে গ্রেপ্তার করা হয়ছে সাড়ে ৪টায়।

বিচারক তখন বলেন, তাহলে তো সময় আরও দুই ঘণ্টা বেড়ে যায়।

আদালতে পরীমনি, ফাইল ছবি

আইনজীবী মজিবুর রহমান এ সময় বলেন, পরীমনিকে গ্রেপ্তার ও এফআইআর দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারা ‘মানা হয়নি’।

এরপর তিনি এফআইইআর পড়ে শোনানোর পাশাপাশি পরীমনির বাসা থেকে কী কী জব্দ করা হয়েছে তার আংশিক পড়ে শোনান।

তিনি পড়েন, … সর্বমোট ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৫০০ টাকা ও একটি কাঠের ফ্রেমে রক্ষিত একটি সাদা জিপার ব্যাগে ৪ গ্রাম আইস/ক্রিস্টাল মেথ…।

বিচারক জানতে চান, ক্রিস্টাল মেথ জিনিসটা কী? সেটা মাদক হিসেবে তফসিলভুক্ত কিনা।

আইনজীবী জবাবে বলেন, এটা বাংলাদেশের আইনে মাদক হিসেবে ‘তফসিলভুক্ত নয়’, তিনি সেটা দেখেছেন।

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান তখন বলেন, এটি এমফিটামিন গ্রুপের মাদক।

পরীমনির আইনজীবী এ সময় বলেন, “এটা এমফিটামিন গ্রুপের হলে সেটা আলাদা চিন্তা। কিন্তু যেটুকু উদ্ধার করা হয়েছে, তার আনুমানিক মূল্য মোট ৪০ হাজার টাকা। এছাড়া আছে এলএসডি।

বিচারক জানতে চান, এলএসডি কি তফসিলভুক্ত?

আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, “আছে। তবে সেখানে মাত্রার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এখানে (এফআইআর) এলএসডির মাত্রার কথা উল্লেখ নাই। শুধু বলা হয়েছে এলএসডি। এর সাথে আছে বোম পাইপ, যা মাদক সেবনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এটা আমাদের কাছে পরিচিত না, এসব জব্দ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।”

এ পর্যায়ে বিচারক জানতে চান, ২৩ অগাস্ট মহানগর দায়রা জজ আদালতে যে আবেদন (জামিন আবেদন দ্রুত শুনানির আবেদন) তারা করেছিলেন, সেটার কী গতি হয়েছে।

জবাবে আইনজীবী মজিবুর বলেন, “এই আবেদনটি এন্টারটেইনই করে নাই। কোর্ট বলেছে, আমি এটা এন্টারটেইনই করব না। আমারা প্রসিকিউশনকে রিকোয়েস্ট করেছি আবেদনটি দেখার জন্য। তারাও সেটি দেখতে অস্বীকার করেছে। এ রকম অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আমরা এই আদালতে (হাই কোর্টে) এসেছি।

বিচারক তখন আইনজীবীর কাছে তার আবেদনের আরজি জানতে চান।

মজিবুর রহমান তখন বলেন, “আমাকে (পরীমনিকে) জামিন দিবেন মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত। আর মহানগর দায়রা জজ আদালতের আদেশটা অবৈধ, কারণ মামলার পারিপার্শ্বিকতা এবং অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী তা অবৈধ।”

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, “ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারা অনুযায়ী মহানগর দায়রা জজ আদালত ও এই আদালতের একই এখতিয়ার। ফলে প্রতিপক্ষকে না শুনে পূর্ণাঙ্গ কোনো আদেশ আমরা দিতে পারব না।”

এরপর ভার্চুয়াল আদালতে উপস্থিত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্নার বক্তব্য শুনতে চায় আদালত।

আইনজীবী পান্না বলেন, “এই মামলাটি নিয়ে আমার কিছু কথা আছে। এই মহিলার (পরীমনির) গ্রেপ্তার করার ২৬ ঘণ্টা পর মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর রিমান্ডের ক্ষেত্রে হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগের কিছু নির্দেশনা আছে। যার একটাও নিম্ন আদালত অনুসরণ করেনি। নিম্ন আদালতই যদি অনুসরণ না করে তবে কে অনুসরণ করবে?”

এ পর্যায়ে আইনজীবী জেডআই খান পান্নাকে থামিয়ে দিয়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমানের বক্তব্য শোনেন বেঞ্চের বিচারকরা।

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মহানগর দায়রার জজ আদালতের আদেশটি ‘বেআইনি নয়’ বলে দাবি করেন।

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম তখন বলেন, “রেকর্ড দেখে আমরা বুঝতে পারছি বেআইনি কিছু আছে। কিন্তু আমরা আইন এবং রীতিনীতির বাইরে কিছু কাজ করব না। কিন্তু জামিন আবেদনের বিষয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ২১ দিন পর জামিন আবেদনের শুনানি, এটা জামিন আবেদনটি খারিজ করার শামিল।”

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তখন বলেন, “সে তো (মহানগর দায়রা জজ আদালত) শুনানির জন্য রেখেছে, তার সামনে তো অন্যান্য রেকর্ড থাকতে হবে। তাছাড়া তো তিনি আদেশ দিতে পারেন না।” 

তখন বিচারক বলেন, “উনি (মহানগর দায়রা জজ আদালত) না শুনলে অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত আছে, তারা শুনবে। কিন্তু এত লম্বা তারিখ দেওয়ার কী আছে?”

এরপর আদালত পরীমনিকে জামিন না দিয়ে তার জামিন আবেদনের শুনানি প্রশ্নে রুল জারি করে। 

হাই কোর্টের এ আদেশ বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিবাদীর কছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমানকে নির্দেশ দেওয়া হয়।