মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তাসহ অন্তত চারটি শর্ত দিচ্ছেন কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
Published : 21 Aug 2019, 07:44 PM
মিয়ানমারের পাঠানো তালিকা ধরে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সাক্ষাৎকারে বাস্তুচ্যুত এই রোহিঙ্গারা এই মনোভাবের কথা জানান।
তারা বলছেন, মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর আগে তাদের নাগরিকত্ব, জমি-জমা ও ভিটেমাটির দখল, নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এক বছর আগে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর দুই সরকারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পাঠানো তালিকা থেকে ৩ হাজার ৪৫০ জনকে রাখাইনের অধিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের ফেরত নিতে রাজি হওয়ার কথা জানায় মিয়ানমার।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বরে আছেন এই প্রত্যাবাসনের জন্য নির্বাচিত এই শরণার্থীরা।
সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্তিতে এসে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের মনোভাব জানতে ক্যাম্পগুলোতে সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে।
বুধবার টেকনাফের শালবাগান এলাকার ২৬ নম্বর ক্যাম্পে সাক্ষাৎকার দিয়ে ফেরা ২০০ জনের মধ্যে যে ১৫ জনের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়, তারা সবাই মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়ার মনোভাব দেখান।
পরিবারের তিনজনের পক্ষে সাক্ষাৎকার দিতে আসেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসলাম।
মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে রোহিঙ্গা ভাষায় তিনি যে উত্তর দিয়েছেন, তা ছিল এই রকম- ”আমার কাছে জানতে চাইছে, ‘যাবা, না যাবা না বলো’; আমি বলেছি নাগরিকত্ব দেওয়ার আগে কোনোভাবে যাব না। আমাদের ভিটেমাটির অধিকার দিতে হবে, যে ক্ষতি করছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, নিরাপত্তা দিতে হবে।”
মিয়ানমারে বিনা বিচারে গ্রেপ্তার থাকা রোহিঙ্গাদের মুক্তি দেওয়ার দাবিও জানান ইসলাম।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মাকে নিয়ে বাংলাদেশের পথ ধরার কথা জানান মোহাম্মদ ইসলাম। কয়েকদিন পর বোনকে নিয়ে আসে তার ভাই। তবে এখন পর্যন্ত বাবার কোনো খবর নেই বলে জানান তিনি।
এখন এই পরিবারের আশ্রয় হয়েছে ২৬ নম্বর ক্যাম্পের এইচ ব্লকে। বাঁশ আর প্লাস্টিকে তৈরি ঘরে বিদেশি সংস্থার ত্রাণে চলছে তাদের সংসার।
ইসলামের মতো একই রকম বক্তব্য দেন হাসিনা বেগম। স্বামীকে মিয়ানমার রেখে আট সন্তানকে নিয়ে সেই অগাস্টে বাংলাদেশের পথ ধরেছিলেন তিনি।
স্বামীকে ছাড়া ছোট সন্তানদের নিয়ে ক্যাম্পের খুপড়ি ঘরে ত্রাণ দিয়ে সংসার চলছে তার।
হাসিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমদের তারা রেপ করেছে, আমাদের হত্যা করেছে, কোনো নিরাপত্তা আর নাগরিকত্ব ছাড়া আমরা সেখানে যাব কী করে? সব কিছু ঠিক না হলে আমরা যাব না। ফেরত না পাঠিয়ে আমাদের মেরে ফেলুক।”
আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, “আমাদের রোহিঙ্গা স্বীকৃতি দিলে যাইয়ুম দে আঁরি। আমরা বাংলাদেশে পরান বাঁচাইতে আসছি। পরান না বাঁচাইয়া ঠেলা মারলে, ন যাইয়ুম আঁরা।“
জোর করে না পাঠিয়ে ‘গুলি করে মেরে ফেলুক’ এমন কথাও বলেন তিনি।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই তাগিদও দেওয়া হচ্ছে, যাতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়ে রাখাইনে নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাসের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
মিয়ানমার কিছু উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করলেও জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলছেন, রাখাইন এখনও রোহিঙ্গাদের ফেরার উপযোগী হয়নি।
গত মাসে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে এসেছিলেন। তখন রোহিঙ্গারা তাদের কাছেও নাগরিকত্বের বিষয়টি আগে তুলেছিলেন।
মিয়ানমারের যে নাগরিকত্ব আইন রয়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়া দুষ্কর। দেশটির ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের জন্মগত নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ নেই তবে ‘অবস্থানগত নাগরিক’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের আদিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও নারাজ মিয়ানমার সরকার।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর মিন্ট থোয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে যারা তিন পুরুষ ধরে মিয়ানমারে বসবাস করেন, তারা সুযোগ পাবেন।
আগের দিন মঙ্গলবার মাত্র ২১ জন সাক্ষাৎকার দিতে এলেও বুধবার সেই তুলনায় সাড়া পাওয়ার কথা জানান বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি এবং ২৬ ও ২৭ নম্বর ক্যাম্পের ইনচার্জ মোহাম্মদ খালেদ হোসেন।
তবে রোহিঙ্গারা কী মতামত দিয়েছেন, সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
খালেদ সাংবাদকিদের বলেন, ”রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠাতে সব ধরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই সেখানে পাঠানো হবে। মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে কাউকে চাপ দেওয়া হবে না।”
বৃহস্পতিবারও একইভাবে রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।