বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হচ্ছে ‘সাকার ফিশ’

অ্যাকুরিয়ামের শোভা বাড়ানো ‘সাকার মাউথ ক্যাটফিশ’ এখন হয়ে উঠেছে বড় মাথাব্যথা।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2022, 04:05 AM
Updated : 16 Nov 2022, 04:05 AM

গত কিছুদিন ধরে খামারিদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠা ‘সাকার মাউথ ক্যাটফিশ’ অবশেষে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

১৯৮৫ সালের ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিস রুলস’ এর বিধি সংশোধন করে নিষিদ্ধের তালিকায় যুক্ত করা হবে পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা এ মাছের নাম।

এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছে, সাকার ফিশ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হলে তাতে কারো আপত্তি আছে কিনা। আপত্তি থাকলে দুই মাসের মধ্যে তা জানাতে বলা হয়েছে।

আপত্তি নিষ্পত্তি সেরে নির্ধারিত সময়ের পর বিধি সংশোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবে মন্ত্রণালয়। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে যেখানে সাকার ফিশ পাওয়া যাবে, সেটা ধ্বংসের নির্দেশনা দেওয়া হবে।

এর আগে ২০০৮ সালে আফ্রিকার রাক্ষুসে মাস পিরানহা বাংলাদেশে চাষ করা, পোনা উৎপাদন, বংশ বৃদ্ধি, বাজারজাত করা এবং কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় আফ্রিকান মাগুরের আমদানি, উৎপাদন ও বিপণনের ওপর। 

একই ধরনের কারণে এবার ‘সাকার মাউথ ক্যাট ফিশ’ নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে বলে জানালেন মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্যচাষ) ড. মো. খালেদ কনক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এ গ্রুপের তিন থেকে চার ধরনের প্রজাতি দেখা যায়। এরা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আর সাকার ফিশ আমরা খাইও না। কোনো দেশেই খাওয়ার রেকর্ড নেই।

“অথচ দেশে জলাশয়গুলোতে এ মাছ ক্রমাগত বাড়ছে। যে কোনো পরিবেশে যে কোনো জায়গায় বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধি করার সক্ষমতা আছে এর। ভালো পানিতে বাড়ছে, দূষিত পানিতেও দ্রুত বংশবৃদ্ধি করছে।”

সাকার মাউথ ক্যাট ফিশকে দেশি প্রজাতির মাছের জন্য ‘হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করে খালেদ কনক বলেন, “এরা দেশীয় প্রজাতির মাছের রেনু খেয়ে ফেলে এবং জীববৈত্র্যের জন্যও হুমকি। তাই আমরা সাকার মাছ নিষিদ্ধের প্রস্তাব করেছি।”

কেন এমন নাম

ইংরেজি নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ, কোনো কোনো দেশে একে কমন প্লেকো বলে।  বৈজ্ঞানিক নাম Hypostomus plecostomus।

গায়ে কালোর উপর সোনালি ডোরা কাটা। অমসৃণ শরীর। পিঠের উপরে ও শরীরের দুপাশে বড় কাটার মত ধারালো পাখনা আছে। মুখে আছে ধারালো দাঁত।

তবে এটি শিকারি মাছ নয়। মুখ দিয়ে শুষে খাবার খায়। মুখের আকারে জলহস্তীর সাথে মিল আছে। সে কারণে নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘সাকার মাউথ’। আর শিং-মাগুরের মত একই পরিবারের বলে একে বলা হয় সাকার মাউথ ক্যাটফিশ।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট এ মাছের অনেকগুলো প্রজাতি থাকলেও বাংলাদেশে ছোট আকারের দুই-তিনটি প্রজাতি আছে। এদের খাদ্য মূলত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ। পানি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে এ মাছ।

কোনো দেশেই খাওয়ার মাছ হিসেবে সাকার ফিশের সুনাম নেই। ডোরা কাটা চেহারা আর টিকে থাকার ক্ষমতার কারণে এটি অ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মাছের বর্জ্য ও অন্যান্য ময়লা খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলে বলেও অনেকে এ একোয়ারিয়ামে এ মাছ রাখেন।

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক বলেন, “বাংলাদেশে কোনো এক সময় হয়ত অ্যাকুরিয়ামে রাখার জন্যে এনেছিল। পরে ধীরে ধীরে মুক্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে গেছে।”

ভয়ের কারণ কী

দেশের জলাশয়ে সাকার ফিশের দেখা মিলছে গত কয়েক বছর ধরে। শুরুতে পুকুর ও খালে এর দেখা মিললেও এখন বিভিন্ন নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে সাকার ফিশ। ঘেরে সাকার ফিশের উপস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা।

যে বুড়িগঙ্গায় দূষণের কারণে অন্য মাছ উধাও হয়ে গেছে, সেখানেও সাকার ফিশ দিব্যি টিকে থাকছে। দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতেও এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে সাকার মাছ। 

Also Read: হালদায় ‘সাকার ফিশ’, উদ্বেগ

Also Read: বরগুনায় জেলের জালে ধরা পড়ল সাকার মাউথ ক্যাটফিশ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ মাছের বংশবৃদ্ধির হার খুব বেশি। কম অক্সিজেনেও বাঁচতে পারে। দ্রুত এর সংখ্যা বাড়লে জলাশয়ে অন্য প্রজাতির মাছ হুমকিতে পড়ে।

“শিকারী মাছ না হলেও সাকার ফিশ জলাশয়ের শ্যাওলা জাতীয় খাবার খেয়ে ফেলে। এরা সংখ্যায় বেড়ে গেলে তা বাস্তুসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং অন্য মাছের খাবারের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তখন সব প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে।”

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহবুবুল হক বলেন, “এ মাছ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সাকার মাছ জলাশয়ের একেবারে তলায় থাকে ও খায়। আর ভারি ধাতুগুলো জমা হয় তলায়। সে কারণেও পরিবেশের জন্য এটা উদ্বেগজনক।”

এখন কী

২০১১ সালের মৎস্য আইন অনুযায়ী, দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষতি হয় এমন বিদেশি মাছ চাষ বাংলাদেশে দণ্ডনীয় অপরাধ। আর কোন কোন মাছ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকবে, তা বলা হয়েছে ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিস রুলস’ এর বিধির ১৮ ধারা ২ উপধারায়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মৃণাল কান্তি দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই বিধিতে সাকার মাছের নাম যুক্ত করতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। কারও আপত্তি বা পরামর্শ থাকলে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসচিবের কাছে দুই মাসের মধ্যে পাঠাতে বলা হয় সেখানে। এ মাসেই সে সময় শেষ হচ্ছে।

“আমরা সব ধরনের অংশীজনের মতামত পেয়েছি। মৎস্য চাষী, ব্যবসায়ী, মৎস্য অধিদপ্তর, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। কারো অভিযোগ, আপত্তি থাকলে তা নিষ্পত্তি করে সংশোধনী চূড়ান্ত করা হবে।”

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহবুবুল হক বলেন, সাকার মাছ নিষিদ্ধ হলে জেলা-উপজেলায় যেখানে এ মাছ পাওয়া যাবে, তা ধ্বংস করার নির্দেশনা দেওয়া হবে।

“২৯ নভেম্বরের পরে চূড়ান্ত হয়ে বিধিতে যুক্ত হবে। তখনই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও উদ্যোগ নেওয়া হবে।”