হালদায় ‘সাকার ফিশ’, উদ্বেগ

হালদায় অবৈধভাবে পেতে রাখা জাল জব্দ করতে গিয়ে পাওয়া গেছে একটি ‘সাকার ফিশ’, তা দেখে উদ্বেগ ছড়িয়েছে মৎস্য গবেষকদের মধ্যে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2022, 01:52 PM
Updated : 3 April 2022, 02:13 PM

তারা বলছেন, সাকার ফিশ দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর বাস্তুসংস্থানের জন্য অশনি সঙ্কেত।

সাকার মাউথ ক্যাটফিশ মূলত অ্যাকুরিয়ামের মাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hypostomus plecostomus। গায়ে কালোর উপর সোনালি ডোরা কাটা। অমসৃণ শরীর। পিঠের উপরে ও শরীরের দুপাশে বড় কাটার মত ধারালো পাখনা আছে। মুখে আছে ধারালো দাঁত।

সাকার ফিশ মূলত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ খেয়ে থাকে। তবে এটি শিকারি প্রজাতির নয়। মুখ দিয়ে শুষে খাবার খায়।

হালদা পাড়ের মৎস্যজীবী, বাসিন্দা ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নদী সংলগ্ন খাল-বিল এবং আশেপাশের পুকুরে গত কয়েক বছর ধরে সাকার ফিশের দেখা মিলছে। স্থানীয়রা এ মাছকে চেনে ‘টাইগার ফিশ’ নামে।

জাল জব্দে শনিবার নৌ পুলিশের এক অভিযানে নদীর কচুখাইন অংশে ঘের জালে একটি সাকার ফিশ মেলে।

সদরঘাট নৌ থানার ওসি এ বি এম মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনিবার সকালে নদীর কচুখাইন এলাকায় একটি জাল টেনে তুলে আমরা এই সাকার ফিশটি পাই। এটি লম্বায় আনুমানিক ১২ ইঞ্চি হবে।”

জাল জব্দে নিয়মিত অভিযান চালালেও এই প্রথম এই মাছ জালে পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

হালদা তীরের মৎস্যজীবী কামাল সওদাগর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছর বর্ষায় যখন বিলগুলো পানিতে ডুবে গিয়েছিল, তখন হালদার আশেপাশের এলাকা গড়দুয়ারাসহ কয়েকটি জায়গায় বিলে এই মাছ দেখা গিয়েছিল।

হালদা তীরের দক্ষিণ মাদার্শা এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম মুন্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হালদার সাথে যুক্ত কাটাখালী খালে এই মাছ নিয়মিত দেখা যায়। স্থানীয়রা এটাকে টাইগার ফিশ নামে ডাকে। কাটাখালী খালে একসময় বাইলা, পুঁটি, বোয়াল, চিংড়িসহ নানারকম মাছ মিলত। এখন শুধু টাইগার ফিশ দেখা যায়। অন্য মাছ তেমন দেখা যায় না। খালের পানিও নোংরা হয়ে গেছে।

“হালদায় যারা গোপনে জাল বা বড়শি দিয়ে নিয়মিত মাছ শিকার করে, তারা সাকার ফিশ আগেও পেয়েছে বলে শুনেছি,” বলেন তিনি। 

মা মাছেরা নমুনা ডিম ছাড়ার পর তা সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামে হালদা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রস্তুত জেলেরা। ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংলগ্ন নালা-খাল ও বিল হয়ে সাকার ফিশ হালদায় ঢুকেছে বলে ধারণা করছি। কাটাখালী ও খন্দকিয়া খালে আগেও এ মাছ দেখা গেছে।

“এটা মূলত অ্যাকুরিয়াম ফিশ। নগরী থেকে ড্রেনের মাধ্যমে হয়ত এটি খাল বেয়ে নদীতে পৌঁছে গেছে। হালদায় এর উপস্থিতি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। কারণ এটির বংশবৃদ্ধির হার খুব বেশি। কম অক্সিজেনেও বাঁচতে পারে। দ্রুত এর সংখ্যা বাড়লে হালদার মা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হুমকিতে পড়বে।”

এর কারণ ব্যাখ্যা করে মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “শিকারী মাছ না হলেও সাকার ফিশ জলাশয়ের শ্যাওলা জাতীয় খাবার খেয়ে ফেলে। এরা সংখ্যায় বেড়ে গেলে তা বাস্তুসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং অন্য মাছের খাবারের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তখন সব প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে।”

হাটহাজারীর জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এরআগে হালদা নদীতে সাকার ফিশ তার নজরে পড়েনি। তবে হাটহাজারীর কয়েকটি পুকুরে বছর খানেক আগে এই মাছ দেখেছে তিনি।

তিনিও বলেন, “এদের বংশবৃদ্ধির হার বেশি। সংখ্যায় বেড়ে গেলে তখন অন্য মাছ খাবার পাবে না। কোথাও এ মাছ পাওয়া গেলে তা নিধন করতে হবে। এটাই বংশবৃদ্ধি ঠেকানোর উপায়।”

ড. কিবরিয়া বলেন, “সাকার ফিশের কারণে বুড়িগঙ্গায় এখন অন্য প্রজাতির কোনো মাছ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এখন থেকে এ মাছ নিধন করা না হলে তা হালদার জন্যও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। হালদা অববাহিকায় এ মাছ যাতে কেউ অ্যাকুরিয়ামেও না রাখে সে বিষয়ে নজরদারি ও সচেতনতা প্রয়োজন।”

চট্টগ্রামের রাউজান, হাটাহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা হালদা নদী রুই, কাতলা, কালিবাউশসহ দেশি অর্ধশত প্রজাতির মাছের বাস।

প্রতি বছর মৌসুমের প্রথম বা দ্বিতীয় ভারী বর্ষণে (এপ্রিলের শেষ বা মের শুরুতে) পাহাড়ি ঢল নামলে এবং অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথি থাকলে হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়ে। সেসময় নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে হালদা পাড়ের মৎস্যজীবীরা।