“এনআইডি চলে গেলে ভোটার তালিকায় ভাটা পড়বে। এনআইডির জন্ম হয়েছে নির্বাচন কমিশনে সুতরাং এখানে থাকা দরকার,” বলেন এনআইডি উইংয়ের সিস্টেম ম্যানেজার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন।
Published : 14 Mar 2025, 01:36 AM
দেশের নাগরিকদের এনআইডিসহ নানা সেবা এক জায়গা থেকে দিতে ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন কমিশন’ গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের মধ্যে ‘বেঁকে’ বসেছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সাংবিধানিক সংস্থা ইসির এনআইডি উইংয়ের বাইরে স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের এমন উদ্যোগকে তারা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলছেন।
এনআইডি কার্যক্রম ইসির অধীনে রাখতে সরকারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে কোনো ধরনের ‘অগ্রগতি’ না পাওয়ায় মানববন্ধনসহ ‘কঠোর’ কর্মসূচিরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, এনআইডি উইংসহ দশ আঞ্চলিক কার্যালয় এবং পাঁচ শতাধিক থানা নির্বাচন কার্যালয়ের সামনে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুই ঘণ্টা ‘স্ট্যান্ড ফর এনআইডি কর্মসূচি’ পালন করেন। সেখান থেকে ১৯ মার্চ ‘অপারেশনাল হল্ট’ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংস্থা’ নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠনের সুপারিশ করেছে সরকারের কাছে। এ নিয়েও আপত্তি নির্বাচন কমিশনের।
“এনআইডি কার্ড, ভোটার রেজিস্ট্রেশন যেটা উনারা বলেছেন পরবর্তী পর্যায়ে একটা আবার স্বাধীন অধিদপ্তর/পরিদপ্তরে হ্যান্ডওভার করার জন্য সাজেস্ট করছেন। ...আরেকটা কর্তৃপক্ষকে দিলে আমার কি তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে? ইটস ইমপসিবল,” গত ২৬ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন এমনটাই বলেছেন।
এনআইডি সেবা ইসির অধীনে রাখার দাবিতে গত ৬ মার্চ নির্বাচন ভবনে সিইসির কক্ষের সামনে অবস্থান নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নিজেদের হাতে সেবাটি রাখার পক্ষে যুক্ত তুলে ধরে সিইসি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আশ্বস্ত করেছেন এভাবে, সরকার হয়ত চিন্তা করছে একটা জায়গা থেকে সার্ভিসটা দেবে। এনআইডি ইসির কাছে আছে, থাকবে-এ বিষয়ে কমিশন সম্পূর্ণ একমত।
“আমাদের মতামত সরকারের কাছে লিখিতভাবে জানাব। আর্জেন্ট বেসিসে এটা জানানো হবে।”
তিনি বলেন, এনআইডি হল ভোটার রেজিস্ট্রেশনের একটা ‘বাইপ্রোডাক্ট’। ১৭ বছর ধরে ইসি কর্মকর্তারা শ্রম দিয়েছেন, সারাদেশে নেটওয়ার্ক ডেভেলপ করছেন। সার্বিক বিষয়গুলো সরকার অবশ্যই বিবেচনায় নেবে।
এনআইডি নিয়ে টানাহেঁচড়ার এমন পরিস্থিতিতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেছেন, আপাতত এনআইডি কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকলেও ভবিষ্যতে স্বাধীন ডেটা অথরিটির কাছেই যাবে।
বুধবার আইসিটি ভবনে ‘এনআইডির ওনারশিপ বিষয়ে বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে’ তিনি বলেন, “আমরা ডেটা অথরিটির কথা বলছি। আমরা বলছি না যে নির্বাচন কমিশনের যে আইটি সেল আছে সেটাকে বন্ধ করে দেব। তার যে সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার এবং কারিগরি ক্ষমতা আছে সেটাকে আমরা নিয়ে নেব? আমরা যেটা বলছি ডেটা অথরিটির মাধ্যমে ডেটা রেগুলেটেড হবে। যার কাছে যেটা আছে, সেটা আপাতত সেখানেই থাকবে।”
বিশেষ সহকারীর ভাষ্য, একটা পর্যায়ে এসে যখন এই সফটওয়্যারগুলোকে রূপান্তর করা দরকার হবে, তখন একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ে আসা হবে এনআইডি সেবাকে।
বরাদ্দ কত? কত লোক জড়িত?
বর্তমানে ১২ কোটি ৩৭ লাখের বেশি নাগরিকের তথ্য রয়েছে তথ্যভাণ্ডারে। এর সঙ্গে ভোটার তালিকা হালনাগাদে তথ্য সংগ্রহ হয়েছে প্রায় অর্ধকোটি এবং মৃত ভোটার বাদ পড়ছে ১৭ লাখের মত। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সামনে রেখে জুনে তালিকা চূড়ান্ত করতে চায় নির্বাচন কমিশন।
তার আগে হঠাৎ করে এনআইডি সেবা অন্যত্র নেওয়া হলে নির্বাচনি প্রস্তুতিও বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন ইসি কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেছেন, বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী ইসি সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাসহ ৫,১১২ জনের মতো লোকবল রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের লোকবল রয়েছে দুই হাজারের বেশি।
সব মিলিয়ে নির্বাচনি নানা কাজের পাশাপাশি এনআইডি সেবা দিতে সাত সহস্রাধিক লোকবল সম্পৃক্ত।
২০০৭-২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভোটার তালিকা ও এনআইডি সেবায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চলমান হালনাগাদ কাজেও প্রায় ১৯০ কোটি টাকার বরাদ্দ রয়েছে।
মনির হোসেন বলেন, ভোটার তালিকার কাজ করতে গিয়েই মূল ব্যয় হচ্ছে। এর সঙ্গে এনআইডির কাজে তুলনামূলক কম ব্যয় হয়।
ছবিসহ ভোটার তালিকা ও তথ্যভাণ্ডার
আগে ভোটার নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত তথ্য থেকে ভোটার তালিকা হাতে লিখে তৈরি করা হত। ২০০৭-২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ শুরু হয়।
২০০৭ সালে নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং ইউএনডিপির সহায়তায় ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ হাতে নেয়। ভোটার তালিকার ডেটাবেইজটির বহুবিধ ব্যবহারের সম্ভাবনা বিবেচনা করেই এক পর্যায়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা চালু করা হয়।
>> বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্র হচ্ছে ভোটার তালিকা ডেটাবেজের একটি উপজাত (বাইপ্রোডাক্ট)।
>> সূচনালগ্ন থেকে কমিশনের জনবল কার্যত বৃদ্ধি না করেই ১৭ বছর ধরে এই সেবার পরিসর ও মান বাড়ানো হয়।
>> কমিশন ইতোমধ্যে নিজস্ব জনবলকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলেছে।
>> ইসি একাধারে নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যক্রম, ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম এবং এনআইডি সেবা দিচ্ছে।
>> এই সেবা দিতে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল কর্মরত আছে।
>> তথ্যভাণ্ডার থেকে বর্তমানে ১৮২টি সংস্থা তথ্য সেবা নিচ্ছে।
>> চলমান রয়েছে হালনাগাদ কর্মসূচিও, যেখানে অর্ধকোটির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
ইসি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ডেটাবেইজ স্থানান্তরের উদ্যোগ চলমান নির্বাচন প্রস্তুতির কাজে ব্যাপক বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। আগামী নির্বাচন নির্বিঘ্ন করার পথে এ ধরনের ‘অযাচিত উদ্যোগ’ বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
তারা বলছেন, এই মুহূর্তে এনআইডি সেবা সরিয়ে নিলে একটি কার্যকর ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটবে এবং এই সেবা দুটি (ভোটার তালিকা ও এনআইডি) আলাদা করলে নির্বাচন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবাধর্মী কাজে দ্বৈততাসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেবে।
প্রস্তাবিত সিভিল রেজিস্ট্রেশন কমিশন কী
নাগরিকদের সব ধরনের সেবা এক ছাতার নিচে রাখতে স্বতন্ত্র কমিশন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।
জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি ও পাসপোর্ট সেবা নিয়ে দুর্ভোগ-জটিলতা নিরসনে স্বতন্ত্র কমিশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন (কমিশন), ২০২৫’ নামে একটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরির কাজ চলছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ নিয়ে স্থানীয় সরকার, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতও নিচ্ছে।
খসড়াটি নিয়ে পর্যালোচনার লক্ষ্যে ‘আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক মতামত প্রদান’ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রথম সভা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের এ বৈঠকে ইসি সচিবালয়ের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।
>> প্রস্তাবিত সিভিল রেজিস্ট্রেশনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘নাগরিকের আইনি সত্তা প্রতিষ্ঠায় জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা বৈশিষ্ট্যের স্থায়ী, ধারাবাহিক, সর্বজনীন, আবশ্যকীয় রেকর্ড সংরক্ষণে নিবন্ধন পদ্ধতি’।
>> অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর সরকার সিভিল রেজিস্ট্রেশন নামে কমিশন প্রতিষ্ঠা করবে। সংবিধিবদ্ধ এই সংস্থা মামলা করতে পারবে, এই সংস্থার বিরুদ্ধেও মামলা করা যাবে।
>> এর প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। তবে সরকারের অনুমোদন নিয়ে শাখা কার্যালয় স্থাপন করা যাবে।
>> গঠন: চেয়ারম্যান ও একজন নারী সদস্যসহ সর্বোচ্চ পাঁচ সদস্যের কমিশন হবে এটি; মেয়াদ থাকবে তিন বছর। কমিশনের একজন সচিব থাকবেন।
>> কাজ: কমিশন এই অধ্যাদেশের অধীন নাগরিকের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ও দত্তক নিবন্ধন এবং মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের সঙ্গে স্থানান্তর, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার তথ্য-উপাত্ত অন্তর্ভুক্ত করে বিদ্যমান সিভিল রেজিস্ট্রেশন-ব্যবস্থার সার্বিক সমন্বয় ও উন্নয়ন করবে।
>> জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা, পরিচয়পত্র প্রস্তুত, বিতরণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক সব দায়িত্ব পালন করবে এ কমিশন।
>> ইউনিক আইডি, সিআরভিএস (সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস) এন্টারপ্রাইজ আর্কিটেকচার, ইন্টার-অপারেবিলিটি স্ট্যান্ডার্ড এবং সিটিজেন কোর ডেটা স্ট্রাকচারের ভিত্তিতে সমন্বিত সেবা প্রদান ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন; সিভিল রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির (যেমন-ব্লকচেইন) ব্যবহার উপযোগিতা, আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পর্যালোচনা করে সরকারকে সুপারিশ দেবে সিভিল রেজিস্ট্রেশন কমিশন।
>> কমিশনকে সিভিল রেজিস্ট্রেশন তথ্য-উপাত্তের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ করতে হবে। নাগরিক এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত ও সহজ উপায়ে সিভিল রেজিস্ট্রেশন তথ্য-উপাত্ত প্রদান; সিভিল রেজিস্ট্রেশন স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, জনবান্ধব করতে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ; সমন্বিত সেবা প্রদান প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই।
>> সিভিল রেজিস্ট্রেশন-ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের অনুমোদন নিয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী, বিদেশি রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও করতে পারবে কমিশন।
সরকারের কাছে ইসির ভাষ্য
এতসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে গত ৯ মার্চ সরকারের কাছে অবস্থান তুলে ধরে সচিবালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত এবং ভোটার তালিকা আইন ২০০৯ এর ধারা ১১ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সার্বক্ষণিকভাবে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চালুসহ ভোটার ডেটাবেজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
“এই ডেটাবেজ ব্যবহার করেই নিবন্ধিত ভোটারদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হয়। ভোটার তালিকা সম্বলিত জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজ অন্যত্র স্থানান্তরিত হলে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতাও খর্ব করবে।”
ডেটা অথরিটি হলেও চাকরি যাবে না
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব অবশ্য আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন।
বুধবার তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি যে সংস্থাগুলো আছে সে সংস্থাগুলোকে আশ্বাস দিতে চাচ্ছি, যে ডেটা অথরিটি আগামী দিনে হবে এটা একটা ধারণার মধ্যে আছে। এ ধারণাটা বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডকে কমপ্লিমেন্ট করে। এই ধারণাটা দেওয়ার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতের যাত্রা শুরু করলাম।
“এই ধারণার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যে আইটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার রয়েছে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে না। তাদের কারও চাকরি যাবে না, কোনো ক্ষতি হবে না। বরং প্রত্যেকটা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে।”
অন্য মন্ত্রণালয়ের যে তথ্য প্রাপ্তির অধিকার, নতুন ব্যবস্থায় সেটা আরও ‘সুরক্ষিত হবে’ বলে মনে করেন বিশেষ সহকারী।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “নির্বাচন কমিশন থেকে কয়েকটা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে এনআইডি সার্ভার নির্বাচন কমিশনের কাছে থেকে নিয়ে যেন না নেওয়া হয়। আমরা বলতে চাচ্ছি, এখন নির্বাচন কমিশন যে ডেটাবেইজ মেনটেইন করে তারা সেটাই মেইনটেইন করবে।
“কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদেরকে একটি স্বাধীন ডেটা অথরিটির দিকে যেতে হবে। যেটা কিনা আমাদের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, অথেন্টিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক, ডেটা এক্সটেন্ট ফ্রেমওয়ার্কের জন্য জরুরি। যার ওপর ভিত্তি করে আমাদের ডিজিটাল অপর্চুনিটিগুলো দাঁড়িয়ে আছে।”
সন্তুষ্ট নন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
বিশেষ সহকারীর আশ্বাসে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ইসির কর্মীরা।
এনআইডি উইংয়ের সিস্টেম ম্যানেজার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন মনে করেন, ভোটার তালিকা ও এনআইডি সেবা আলাদা করা হলে দুটিই দুর্বল হয়ে পড়বে। এর কোনোটি সবল হলেও অন্যটি হয়ে পড়বে খুব নাজুক।
“এনআইডির এমনভাবে জন্ম হয়েছে- এটা কমিশন থেকে আলাদা করার মত নয়। ডেটাবেইজ একটা। কোনো প্রতিষ্ঠানকে এনআইডি (সেবা) নিতে হলে ভোটার তালিকাও নিতে হবে। এনআইডি নিলে ভোটার তালিকা ব্যাহত হবে। এনআইডি চলে গেলে ভোটার তালিকায় ভাটা পড়বে। এনআইডির জন্ম হয়েছে নির্বাচন কমিশনে সুতরাং এখানে থাকা দরকার।”
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, “এনআইডি নিয়ে একেক সময় একেকরকম সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়। তারা এনআইডি নিয়ে টানাহেঁচড়া করে। এর আগে একাধিকবার চেষ্টা হয়েছিল। মাঝে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এখন আবার নতুন কমিশন তৈরি করে তাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
১৭-১৮ বছর ধরে কোনো সমস্যা হয়নি মন্তব্য করে ইসির এ কর্মকর্তা বলেন, “এনআইডি ইসির অধীনে থাকতে হবে।”
তিনি বলেন, “সরকারের তরফে ডেটা কমিশন বা সিভিল রেজিস্ট্রেশন কমিশন, যাই করুক; ইসি থেকে এনআইডি সরানো যাবে না বলে আমরা মনে করি। কিন্তু স্বতন্ত্র কোনো কমিশন করা হলে আমাদের দাবি তো আর পূরণ হল না; গণমাধ্যমে যতটকু তথ্য জেনেছি তাতে কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট নয়।”
তারা এখন কী বলছেন
পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি'র গবেষণা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার যখন এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন বিষয়টিকে ‘উভয় সংকট’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার পেছনে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতার অভাব অন্যতম কারণ। কিন্তু পাসপোর্ট সেবার ক্ষেত্রে দালালচক্র এবং দুর্নীতির বিষয় তারা গবেষণায় পেয়েছেন।
"এই প্রশ্নটা উত্থাপিত হওয়া যৌক্তিক যে জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব বদল হলে মানুষের সেবার মানের ক্ষেত্রে এটা কতখানি যথার্থ হবে।"
নির্বাচন কমিশন কেন এনআইডি সেবা হাতছাড়া করতে চায় না, সেই প্রশ্ন করা হলে দুদক সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইফতেখারুজ্জামান বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা সৎ ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা ইসি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই দিতে পারবেন। তারা বিভিন্ন দাবি জানাতে পারেন। কিন্তু এভাবে কর্মসূচি দিতে পারেন না, এটা অভূতপূর্ব ও প্রশ্নবিদ্ধ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ ধরনের কর্মসূচি তো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে গেল!”
অন্তর্বর্তী সরকার এখন এনআইডি সেবাকে আলাদা কাঠামোর অধীনে নেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সে বিষয়ে একমত পোষণ করেন তিনি।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এতদিন নির্বাচন কমিশনের কাছে ছিল এটা ঠিক আছে। কিন্তু বৈশ্বিক মানদণ্ডে ডেটাবেজ এর বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। এটি একটি কারিগরি বিষয়ও। ইসির কাছে এতদিন থাকলেও বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, জালিয়াতি, তথ্য ফাঁস, তথ্য পাচারের মত অভিযোগের মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, এর দায় ইসিও এড়াতে পারে না।”
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে এনআইডির তথ্য ফাঁস, এনআইডি জালিয়াতি-দুর্নীতি, রোহিঙ্গাদের ভোটার নিয়ে অনেক নেতিবাচক বিষয় সামনে এসেছে। ভোটে সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে ইসি কর্মকর্তাদের নিজেদের কাজে মনোনিবেশ না করে নিজেদের ক্ষমতা ‘কুক্ষিগত’ করে রাখা বা কোনো উদ্দেশ্যে এ ধরনের কর্মসূচি রয়েছে কিনা সেই সংশয় দেখা দেবে অনেকের।
“বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত এক ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। কারিগরি ও নিরাপত্তাসহ সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এখন তা আর ইসির অধীনে থাকা ঠিক হবে না। এজন্য আমরা মনে করি এনআইডি কার্যক্রমটা একটা স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে থাকা উচিত।”
স্বাধীন একটি কমিশন বা কর্তৃপক্ষের অধীনে এনআইডি সেবা হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কারিগরি সুরক্ষা নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান।
আওয়ামী লীগের সময়ে এনআইডি সেবাকে ইসির হাত থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেছিলেন, “বর্তমান এনআইডি যদি অকার্যকর হয়, সেটা ভিন্ন বিষয়। নির্বাচন কমিশন যদি এনআইডি না চালাতে পারত, সেটাও ভিন্ন হত। যদিও কিছু সমস্যা আছে, যেগুলো সমাধান করতে হবে। আমি মনে করি, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সম্পদটা ২০০৭ সালে সৃষ্টি করেছে নির্বাচন কমিশন। এনআইডির ভিত্তি হলো ভোটার তালিকার ডাটাবেজ। এখন কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে?
“স্বরাষ্ট্রের এ কাজটা আমাদের ভোটার তালিকার শুদ্ধতা প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দেবে। আমাদের কাছে বিষয়টা উদ্বেগজনক মনে হয়, আসলে উদ্দেশ্যটা কী? কাজটা নির্বাচন কমিশন করলে ক্ষতি কোথায়? আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি একান্ত করতে চায় তাহলে যেন নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেজ ও জনবল হস্তান্তর না করা হয়।”
ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার উদ্যোগে সেই বদিউল আলম মজুমদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনই ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংস্থা’ নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠনের সুপারিশ করেছে।
এখন অবস্থান পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হ্যাঁ, আমি আগে এনআইডি কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করেছিলাম। আমি প্রথম বলেছিলাম স্বরাষ্ট্রে না নিয়ে এটা ইসির অধীনে থাকাই ভালো হবে। কিন্তু সংস্কার কমিশনে কারিগরিসহ নানা বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার পর স্বতন্ত্র স্বাধীন একটি সংস্থার কথা বলছি আমরা।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এ সদস্য বলেন, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৈশ্বিক মানে ডেটাবেজ নিয়ে বড় পরিসরের সেবা কাজের জন্য স্বতন্ত্র সংস্থার কোনো ‘বিকল্প নেই’।
নির্বাচন কমিশন কেন এনআইডি সেবা হাতছাড়া করতে চায় না, সেই প্রশ্নে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, “এ বিষয়টি নিয়ে ভালো ব্যাখ্যা, যুক্তি ইসিই দেবে।”
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, এনসিডিসি
সারাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এনআইডি সংক্রান্ত সকল সেবা সুচারুরূপে সম্পন্নের জন্য দেশের বৃহত্তম জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারের নিরবচ্ছিন্ন অপারেশন, আপগ্রেডেশন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিবর্তে আগামী সাত বছরের মধ্যে ‘জাতীয় নাগরিক ডেটা কমিশন’ নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ কমিশন গঠন করতে হবে, যার দায়িত্ব হবে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন, সংরক্ষণ ও বিতরণ।
এই সংস্থার অর্গানোগ্রাম ও জনবল কাঠামো নির্ণয়ে একটি আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মের মাধ্যমে নিরীক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং এ কমিশন পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখার কথা বলা হয়েছে কমিশনের সুপারিশে।
ভবিষ্যতে প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক ডেটা কমিশনের কার্যক্রমের পরিধি আরও বিস্তৃত করে বর্তমানে প্রচলিত কিছু সেবা, যাদের মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ ইত্যাদি নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়, তাদের জাতীয় নাগরিক ডেটা কমিশনের অধীনে নিয়ে আসার কথাও কমিশন বলেছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম ইসির অধীনে রাখার বিষয়ে যুক্তি তুলে সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, "কারণ এই ব্যবস্থাটা আমরা গড়ে তুলেছি ২০০৭ সাল থেকে। আমাদের কারিগরি দক্ষতা আছে। এখান থেকে আমরা কাম্য সেবা দিচ্ছি এবং এখান থেকে সেবা সম্প্রসারণের ক্ষেত্র তৈরি করছি।"
তিনি বলেন, ১৮২টি সংস্থা ইসির কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছে। অন্যান্য সংস্থাও তথ্য নিচ্ছে। সুরক্ষিত বলেই তারা তথ্য নেয়।
“কাজেই যেটা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি, সেই পদ্ধতিটিকে আবার নতুন করে গড়ে তোলার চেয়ে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিকেই সম্প্রসারণ করা যৌক্তিক বলে মনে করি। এটাই আমরা বারবার বলে আসছি।"
পুরনো খবর
এনআইডি সেবা: ইসিতে রাখার দাবিতে সারাদেশে বৃহস্পতিবার অবস্থান
এনআইডি সেবা ইসির অধীনে রাখার দাবিতে কর্মীদের অবস্থান
ইসির মতামত ছাড়া এনআইডি 'অন্য কোথাও' যাবে না, মনে করেন সিইসি
বর্তমান ইসিও এনআইডি সেবা নিজেদের কাছে রাখতে চায়