পরবর্তীতে নির্বাচন করার জন্য যেটুকু ডেটার প্রয়োজন, শুধু সেটুকুর কর্তৃত্ব পাবে নির্বাচন কমিশন। তবে এতে কারও চাকরি যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
Published : 12 Mar 2025, 10:49 PM
নির্বাচন কমিশনের ডেটা কার কাছে থাকবে এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেছেন, ভবিষ্যতে জাতীয় ‘ডেটা অথরিটি’ করার আগ পর্যন্ত এগুলো নির্বাচন কমিশনের কাছেই থাকবে।
পরবর্তীতে নির্বাচন করার জন্য যেটুকু ডেটার প্রয়োজন, শুধু সেটুকুর কর্তৃত্ব পাবে নির্বাচন কমিশন। তবে এতে কারও চাকরি যাবে না। বরং মানসম্পন্ন ডেটার জন্য দায়িত্ব আরও বাড়বে, লোকবলও বাড়াতে হতে পারে।
বুধবার বিকেলে আইসিটি ভবনে ‘এনআইডির ওনারশিপ বিষয়ে বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে’ এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী। তথ্যপ্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী এসময় তার সঙ্গে ছিলেন।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলছেন, নাগরিকের তথ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কার কাছে থাকবে এ নিয়ে গত কয়েকদিনে ‘বিস্তর পড়াশোনা’ করেছেন তারা। তাতে তারা দেখেছেন, বাংলাদেশ, জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর মত কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো দেশেই নাগরিকের ডেটা নির্বাচন কমিশনের মত সংস্থার হাতে থাকে না।
সংবাদ সম্মেলনে একটি চার্টে তিনি দেখান, ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপসহ আশপাশের দেশগুলোর নাগরিকদের ডেটা থাকে একটি বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে। মোট ৯৩টি দেশে এই নাগরিক ডেটা কর্তৃপক্ষটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে কাজ করে।
এখন নির্বাচন কমিশনের কাছে নাগরিকদের ৩৫ ধরনের ডেটা সংরক্ষিত আছে। এটা কমিশনের কাছে থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফয়েজ আহমদ বলেন, “একটা যৌক্তিক প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ভোটিং রাইট ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য আসলে ৩৫ ধরনের তথ্যের প্রয়োজন আছে কী? তো এই প্রশ্নটা যৌক্তিক ও কারিগরিভাবে উপস্থাপন হচ্ছে।
“আমরা ডেটা অথরিটির কথা বলছি ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে থাকা ডেটা স্ট্রাকচারগুলোর সঙ্গে ইন্টার অপারেবিলিটির কথা বলছি। আমরা বলছি না যে নির্বাচন কমিশনের যে আইটি সেল আছে সেটাকে বন্ধ করে দেব। তার যে সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও কারিগরি সক্ষমতা আছে আমরা সেটা নিয়ে নেব এমন কথাও বলছি না।
“আমরা বলছি যে ডেটাটা ডেটা অথরিটির মাধ্যমে রেগুলেট হবে। যার কাছে যে ডেটা আছে সেটা আপাতত সেখানেই থাকবে। আমরা যদি ইন্টার অপারেবিলিটি নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে একটা পর্যায়ে এসে এই সিস্টেমগুলোকে রিপ্লেস করার দরকার হবে। কারণ এই সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারগুলো অনেক পুরনো। তখন সেটা আমরা একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে আসব।”
তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে আমাদের এআইকে ঘিরে প্রস্তুতি রাখতে হবে। তখন এআই বিপুল ডেটা নিয়ে কাজ করবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সেটা সামলানো কঠিন হবে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে ভোটিং রাইটস বাস্তবায়ন করা এবং সেটাকে প্রটেকশন দেওয়া। সিটিজেন ডেটা স্টোর ও প্রটেকশন করা নির্বাচন কমিশনের কাজ না।”
ডেটার মালিকানা হারালেও কারো চাকরি যাবে না– সেই আশ্বাস দিয়ে ফয়েজ আহমদ বলেন, “আমি এটার নিশ্চয়তা দিতে চাই ডেটা অথরিটি গঠনের পর বাংলাদেশের যত মন্ত্রণালয় বা সংস্থা আছে, তাদের কারোরই আইটি সংশ্লিষ্ট কর্মীদের চাকরি যাবে না। কারোর অথরিটি ক্ষুণ্ন হবে না। বরং এর মাধ্যমে প্রত্যেকটা ব্যবস্থা আরও বেশি শক্তিশালী হবে। অন্য মন্ত্রণালয়ের ডেটা প্রাপ্তির তাদের যে অধিকার, সেটার সুরক্ষা এখানে দেওয়া হবে।”
ফয়েজ আহমদ বলছেন, বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের ডেটা ডার্ক ওয়েবে বেচাকেনা হচ্ছে। চাইলেই পাওয়া যায় ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ডেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছাড়া ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য একটি ‘ডেটা অথরিটি’ করার পরিকল্পনা চলছে।
“এই ডেটা অথরিটি সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের ডেটা স্ট্রাকচারগুলোকে সংযুক্ত করে একটা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবে। এখন নির্বাচন কমিশন অনেকগুলো সংস্থাকে ডেটা সরবরাহ করছে। কিন্তু কোনখান থেকে ডেটা চুরি হচ্ছে কী না তা তদারকির সক্ষমতা তাদের নেই। জাতীয় ডেটা অথরিটির ইঞ্জিনিয়াররা সার্বক্ষণিক ডেটার সুরক্ষার বিষয়ে কাজ করবেন।”
ডেটা সুরক্ষার যথাযথ কাঠামো না থাকায় দেশে অনেক ধরনের আর্থিক সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না মন্তব্য করে ফয়েজ আহমদ বলেন, “এখন মানুষ ব্যাংকে একরকম করে আবার হাসপাতালে আরেকরকম ঠিকানা দিচ্ছেন। একটা লোক ১৭ জায়গায় তথ্য দিলে ১৭ রকম তথ্য পাওয়া যায়।
“এখন ঠিকানা যাচাই (অ্যাড্রেস ভেরিফিকেশন) ছাড়া দেশে পেপালের মত ফিনান্সিয়াল সার্ভিসগুলোও আসতে চায় না। সেজন্যই আমাদের একটা সমন্বিত ডেটা হাইওয়েতে উঠতে হবে, যেখানে এই অথরিটি শৃঙ্খলা রাখবে। যার যতোটুকু ডেটা লাগবে তার ওনারশিপে ততোটুকু ডেটা থাকবে।”
কবে নাগাদ এই ডেটা অথরিটি গঠন হতে পারে এবং এর ধরন কী হবে জানতে চাইলে ফয়েজ আহমদ বলেন, “আমরা এখন চিন্তা ও পরিকল্পনা করছি। এটার সাংবিধানিক ক্ষমতা লাগবে এবং এটা একটা রেগুলেটরি অথরিটি হবে। এটা সরাসরি কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে না। আমরা যখন পার্সোনাল ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট করতে যাব, তখন আগে এই ডেটা অথরিটির প্রশ্নটি সলভ করতে হবে।”
তিনি এ জন্য অন্তত ছয় মাসের একটি কর্মপ্রক্রিয়ার কথা বলেন।
বাংলাদেশের যে এনআইডি ব্যবস্থা এটা একটা ঐতিহাসিক কারণে নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যাস্ত হয়েছিল মন্তব্য করে ফয়েজ আহমদ বলেন, ২০০৭ সালে যখন একটা স্বচ্ছ ভোটার তালিকা করার প্রয়োজন পড়ে তখন এই দায়িত্বটা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত হয়।
“আমাদের এনআইডি আছে, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আছে, নতুন একটা সিটিজেন স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন আছে যেখানে জন্ম, মৃত্যু, মৃত্যুর কারণ, বিবাহ, তালাক ও অ্যাডাপশন এই ছয়টা তথ্য আছে। আমরা একটার পড় একটা নতুন দ্বীপ তৈরি করছি কারণ এদের নিজেদের মধ্যে কোন বোঝাপড়া নেই।
“তাই আমরা মনে করি, একটা স্বাধীন ডেটা অথরিটি থাকলে এই সমস্যাগুলো থেকে আমরা উৎরে যেতে পারব। কারও সাইবার সিকিউরিটিতে পার্সোনাল সিকিউরিটি ব্রিচ হলে এই অথরিটি তাকে একটা গাইডলাইন দেবে। আবার এনআইডি ডেটা ব্রিচ হলে বা কোনো ভেন্ডর কোম্পানি ডেটা কপি করলে তার আইনি কাঠামোটা কী হবে সেটা ন্যাশনাল ডেটা অথরিটি ঠিক করে দেবে। এক কোম্পানি আরেক কোম্পানির সঙ্গে কীভাবে ডেটা শেয়ার করবে, এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কীভাবে ডেটা শেয়ার করবে এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ডেটা অথরিটি শৃঙ্খলা রাখতে পারে। এই যে তথ্যের হাইওয়েতে একটা শৃঙ্খলা তৈরি হবে।
“কার্পেটের নিচে সমস্যা না লুকিয়ে সেগুলো সমাধানের জন্য আমরা একটার পর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ তৈরি না করে সেগুলোকে একটা হাইওয়েতে আনার জন্য একটা ন্যাশনাল ডেটা অথরিটি গঠন করতে যাচ্ছি।”