খণ্ডিত জীবন (কিস্তি ৮)

ফয়েজ আহমেদ
Published : 30 Sept 2011, 08:08 PM
Updated : 30 Sept 2011, 08:08 PM

(কিস্তি ৭-এর পরে)

যুবলীগের তারা বললো, আমরা এই রেজুলেসন ওউন করবো না। কারণ আমরা তো আসি নাই, এইটা কারেক্ট করা হউক। তখন কমিটি বললো, এইটা তো নেওয়া হইয়া গেছে! এই অবস্থায় যখন তর্কাতর্কি উঠছে তখন একটা মীমাংসা হইলো, কারেক্ট করা হইলো। সেইটা হলো—যে রেজুলেসন নেওয়া হইছে এটা থাকবে যে ব্রেক করা হবে না। অর্থাৎ রেজুলেসনটা সরকারের পক্ষে গেলো! তার লগে নতুন কইরা লেখা হইলো—কিন্তু যদি ছাত্ররা বা কেউ ফর্টি ফোর ব্রেক করে এবং সরকার বিরোধী কর্মসূচী পরিচালনা করে, তবে তখন আর ফর্টি ফোর ব্রেক না করার এই সিদ্ধান্ত থাকবে না। দ্যাট ইজ, এইটা—রেজুলেসনটা ইনভ্যালিড হইয়া গেলো, ব্রেক করলেই ইনভ্যালিড হইয়া গেলো! এবং সেই অনুযায়ী রেজুলেসনটা মীমাংসিত হয়। এইভাবে সেইদিনের মিটিং শেষ হয়।

………
ফয়েজ আহ্‌মদ
………

তার পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি, যখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লোক আসতে আরম্ভ করে—ছাত্র-জনতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছেলেরা, বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছেলেরা, কামরুন্নেসা স্কুলের মেয়েরা আসলো মুনীর চৌধুরীর ছোট বোন নাদেরা বেগমের নেতৃত্বে, দেওয়াল টপকাইয়া কামরুন্নেসা থেকে বের হইয়া আসলো। কামরুন্নেসা স্কুল ছিলো হাটখোলা রোডে, ইত্তেফাক অফিসের নিকটে। কিন্তু স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা এতো বাধা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসা জমায়েত হইতে থাকলো। তারা কোন বাধা মানে নাই, হাজার হাজার লোক আইসা গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনের গেট দিয়া তারা আইসা হানা দেওয়ার ব্যাপারে একত্র হইলো। সবাই ওই গেট দিয়া-ই ঢুকলো, কারণ, ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট গেট বন্ধ ছিলো। ফার্স্ট গেটের পাশে তখন ইউক্যালিপটাস বৃক্ষ ছিলো—তালগাছের মতো লম্বা, বড়ো—সে একটাও নাই এখন। ওই বৃক্ষের তলা দিয়া তো আসতে পারে নাই, ওইখানে পুলিশ বসা, আইবি বসা—শত শত। এইটা হইলো ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট গেট। এই গেট দিয়া ঢুকতে পারে নাই। সুতরাং তারা গোপনে মেডিকেল কলেজ দিয়া ঘুইরা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলো। তারপরে এইখানে সাড়ে ১০টার পরে শ্লোগান আরম্ভ হলো, কথা আরম্ভ হলো, ভাইসব বইলা বক্তৃতা করে। ভেতরে বক্তৃতা, বাইরে পুলিশ ও অস্ত্র।

মেডিকেল কলেজের ভিতরে মাঠের মতো একটা জায়গা আছে, এইটা ভইরা গেছে। একটা পুকুরও আছে। ওই পুকুর দিয়া পানি উঠাইয়া চোখে দিয়া টিয়ার গ্যাস থেকে রক্ষা পায়। হইচই, কোলাহল পইড়া যায়—নানান রকম অবস্থা চলে। তারপরে সাড়ে এগারোটার দিকে ঢিলাঢিলি আরম্ভ হইলো। ছাত্ররা ভিতের থেইকা বড় রাস্তার উপরে ঢিল মারে, আর বড়ো রাস্তা থেইকা পুলিশ, আর্মড ফোর্স—তারা ঢিল মারে। আর টিয়ার গ্যাস মারে। তার পাথরের ঢিল আর টিয়ার গ্যাস মারে, আর এরা কেবল পাথরের ঢিল মারে—গেটের উপর দিয়া। ছাত্ররা মাঝে মাঝে টিয়ার গ্যাস ধইরা উল্টা কইরা মারে।

এইটা যখন চলছিলো পুরা মাত্রায় তখন একটা পর্যায়ে নানা রকম মতামত প্রকাশ করা হয়—কেমনে কী করবে। মিটিং-এ বক্তৃতা হইতাছে, গাজিউল হক প্রিসাইড করতেছে মিটিং, ওই মাঠে। সে একজন বিরাটদেহী শক্তিশালী লোক—সেইজন্য তারে প্রিসাইড করতে দেওয়া হইছিলো। এই যে, সে মারামারি কাটাকাটি করতে পারবে; কিন্তু সে সবচেয়ে ভীতু মানুষ। গুলি হওয়ার পরে পালাইয়া যে গেলো, দুইমাসের মধ্যে আসে নাই। তখন প্রায় দেড়টা/দুইটা বাজে, এই সময়টায় ছেলেরা আস্তে আস্তে স্তিমিত হইতে থাকলো। এর মধ্যে যারাই গেট পার হইয়া পুলিশ তাদের ধইরা ধইরা পুলিশের গাড়িতে কইরা কাউকে পাঠাইয়া দেয় সেন্ট্রাল জেলে, কাউকে পাঠাইয়া দেয় টঙ্গীতে। টঙ্গীতে পাঠাইয়া দেয় কারণ কোন গাড়ি-ঘোড়া নাই, টঙ্গীতে ছাড়লে তারা হাঁইটা আইতে আইতে সন্ধ্যা হইয়া যাবে, তখন তো আর মিটিং থাকবে না—এই হইলো স্ট্রাটেজি। এইভাবে অনেকে ঢাকা জেলে ঢুকলো। কেউ পালালো, কেউ ঢাকার বাইরে গিয়ে মুক্তি পেল; সন্ধ্যার পরে তারা ঢাকায় ফিরলো।

…….
গাজীউল হক (জন্ম. ছাগলনাইয়া, নোয়াখালী ১৩/২/১৯২৯ – মৃত্যু. ঢাকা ১৭/৬/২০০৯)
……….
গাজীউল হক যে প্রিসাইড করবে এইটা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিলো। ২০ তারিখের রাত বারোটার দিকে ফজলুল হক হলের পুকুরের পাকা ঘাটে গোপন সভায় কিছু সিদ্ধান্ত হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়—গাজীউল হক সভাপতিত্ব করবে। গাজী টিয়ার গ্যাসে কিছুক্ষণ অজ্ঞান থাকে।

দেড়টা/দুইটার দিকে ঢিলাঢিলি বন্ধ হইয়া গেছে সব। এখন যেটা মধুর ক্যান্টিন সেইটা ওইখানে ছিলো তখন, ডান দিকের কিনারে। ওইখানে পিছন দিক দিয়া বাইর হবার রাস্তা আছে, সেই রাস্তা দিয়া লোকজন চইলা যাইতে আরম্ভ করছে। তখন নেতারা খাইতে গেলো এবং স্ট্রাটেজি ঠিক করতে গেলো। কোন সিদ্ধান্ত নাই, কোন প্রোগ্রাম দেওয়া হইলো না, না দিয়াই মিটিং শেষ হইয়া গেছে। আমিও তখন চইলা গেছি। জানি না বিকালে কী হবে। কোন ছাত্র নেতা, যুবনেতা—কোন নেতাই কোন প্রোগ্রাম দিতে পারলো না। নেতারা যখন খাইতে গেলো তখন একটা বড়ো গাড়িতে কইরা আর্মড ফোর্স নিয়া আসা হইলো। কেউ কল্পনাও করে নাই যে পরে আর্মড ফোর্স আইসা গুলি করবে। মাসুদ বইলা একজন ঢাকা জেলার এডিশনাল এসপি ছিলো। সে এই কন্টিনজেন্টটা লিড করে। সে আইসা পৌনে তিনটা/তিনটার দিকে গুলি করার নির্দেশ দেয়। কেউ ভাবতেই পারে নাই এইভাবে সাইধা সাইধা গুলি করবে। কোন আক্রমণ নাই, কিচ্ছু নাই—সব থাইমা গেছে—কেউ বাড়িতে গেছে, কেউ খাইতে গেছে, কেউ নামাজ পড়তে গেছে—গুলি কইরা দিলো! এসপি মাসুদের এই বন্দুকধারী দলটি আকস্মিকভাবে প্রায় সোয়া তিনটার দিকে গুলি ছোড়ে। কেন গুলি হলো তা প্রথমে বোঝা যায় নাই।

প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন তখন তার বাসায়। এখনকার বাংলা একাডেমী ভবনে তখন প্রধানমন্ত্রীর থাকে। নিচের তলায় অফিস, উপরের তলায় থাকেন। এইটা বাংলা একাডেমী হইলো ৫৪-এর নির্বাচনের পরে। নির্বাচনে একুশ দফা বইলা যুক্তফ্রন্টের দফা ছিলো। সেই একুশ দফার একটা দফা হচ্ছে—নুরুল আমিন যেই বাড়িতে ছিলো, সেই বাড়িটা বাংলা একাডেমী হবে। নির্বাচনে জিতলে যা যা করবে তার একটা হইলো এইটা। মওলানা ভাসানীর বুদ্ধি এইটা। আমরা শুনছি যে নুরুল আমিন গুলি করার এই নির্দেশ দেয় নাই। নুরুল আমিন, (সিএসপি) আই. এইচ. কোরেশী–কেউ জানতো না, কোরেশী আমাকে বলেছে, 'আমি জানি না।' এই অর্ডার আসছে করাচির উপরতলা থেকে। এই ধরনের ঘটনা পাকিস্তানে এই প্রথম। গুলি হইছে, লোক মারা গেছে—এই রকম কখনো ঘটে নাই আগে। তখন বিকেলে নিউ টাউন, ওল্ড টাউন থেকে হাজার হাজার লোক আবার মেডিকেল কলেজে আসতে থাকলো।

গুলিতে যারা মারা গেলো তারা কেউ এই আন্দোলনে ছিলো না। তারা সাধারণ ছেলে—মেডিকেল কলেজে পড়ে বা বাইরের, অনত্র কাজ করে। তারা হয়তো খাইতে বের হইছে, নামাজ পড়তে বের হইছে, আর গুলির মুখোমুখী। মেডিকেল কলেজের সামনে খাদ্যের হোটেল আছিলো—মেডিকেল কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছেলেরা এইখানে খায়। এরা কোন আন্দোলনে ছিলো না।

তখন অ্যাসেম্বলি চলতেছিলো। সেইখানে প্রতিবাদ হইলো, তর্কবাগীশ বাইর হইয়া আসলো। অ্যাসেম্বলি ক্লোজ হইয়া গেলো। পরে মওলানা ভাসানীর স্টেটমেন্ট আসলো ফ্রম যমুনা নদী। তখন সংবাদ আছিলো মুসলীম লীগের পত্রিকা, সুতরাং আমরা দুই প্যারাগ্রাফ লেইখা ছাইড়া দিছি! গুলি হওয়ার কথা লেইখা দিলাম, কিন্তু ওই অংশ কাইটা ফালাইয়া দিছে, পাবলিশ হয় নাই। গুলির খবর ঠিকভাবে প্রকাশিত হইছে আজাদ-এ, যেহেতু আজাদ-এর মাওলানা আকরাম খাঁর সাথে প্রোভিন্সিয়াল মুসলীম লীগের ঝগড়া ছিলো। কারণ ছিলো এইগুলা সরকাররে সাপোর্ট করে। ২২ তারিখ সকাল বেলা দেখা গেলো, আজাদ হইলো অনলি কাগজ যে কাগজে গুলির খবর আছে—বড়ো কইরা। সেদিন থেকে 'আজাদ' পত্রিকা ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

২২ তারিখে অনেক কাহিনী হইছে। মেডিকেল কলেজে গায়েবী জানাজা হইছে, দশ-পনের হাজার লোক হইছে গায়েবী জানাজায়। তারপরে সেইখান দিয়া বিরাট মিছিল বাইর হইছে। মিছিল কার্জন হলের সামনে দিয়া আবদুল গণি রোড হইয়া বঙ্গবাজার হইয়া ওল্ড টাউনের দিকে গেলো—দুইটা ভাগ হইলো, একটা গেল সদরঘাটের দিকে, আরেকটা গেলো ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উল্টাদিকে আজাদ অফিসের দিকে। যাওয়ার পথে আবদুল গণি রোডের মুখে পুলিশ লাঠিচার্জ করলো। অনেকে আহত হইলো। লাঠিচার্জের পরে মিছিলটা ভাগ হইয়া গেলো। এই মিছিলে নেতারা কেউ ছিলো না।

২২ তারিখেও ফর্টি ফোর জারি করা হইছিলো এবং কিছু কিছু জায়গায় আর্মি নামানো হইছিলো। আর্মি কোথাও কোথাও গুলি করে। বলা হয় তিন থেকে পাঁচজন মারা গেছে ওইদিন। আমার কাছে একটার অথেনটিক নিউজ ছিলো—১২/১৩ বছরের একটা ইয়াং ছেলে মারা গেছে নবাবপুরে। স্টুডিও 'এইচ'-এর উল্টা দিকে। মারা গেছে এই জন্য আমি জানি—সংবাদ-এ ছিলাম তো, ওইখানে যাওয়া আসা করছি। ২২ তারিখ সংবাদ ঘেরাও হইছিলো, পাবলিক ঘেরাও করছিলো; জিন্নাহ এভিনিউতে মর্নিং নিউজ অফিস পোড়াইয়া দেওয়া হইছিলো। সংবাদ-এ আগুন দিছিলো, পোড়ে নাই; পুলিশ আইসা রক্ষা করছিলো। 'মর্নিং নিউজ' বাঁচে নাই।

বাংলাবাজারে একটা বাড়ি ছিলো—বইয়ের দোকান, এবং একটা পত্রিকার নামে বাড়িটার নাম হইছিলো, মান্থলি পত্রিকা—'দিলরুবা'। ওই পত্রিকার বাড়িতে যাইয়া আমি তার মালিক কাদের সাহেবকে বললাম—২১ তারিখ ও আইজ (২২তারিখ) তো গুলি হইছে, মারামারি হইছে, বহু লোক জেলে গেছে, আজকে কারফিউ—এইটার উপরে একটা পত্রিকা বাইর করতে চাই। আপনে বাইর কইরা দেন। সে রাজি হইলো। পরে আমারে সাহায্য করতে আইলো ডাঃ শরফুদ্দিন, আমার আর্টিস্ট বন্ধু আমিনুল ইসলাম; সে একটা স্কেচ কইরা দিলো হাতে—গুলি করতাছে, আমরা তিনজন মিইলা কাগজ বাইর কইরা ফেললাম। বিকাল সাড়ে পাঁচটা/পৌনে ছয়টায় ছাপা হইলো, 'বিশেষ সংখ্যা' নাম দিলাম। আর কোন নাম নাই, ধইরা ফেলা হবে! বিনা পয়সায় ছাড়লাম—যে টাকা দেয় দিবে। পরে জানতে পারি, বন্ধু লোহানী তাঁর 'অগত্যা' পত্রিকা সেদিন বিশেষ সংখ্যা রূপে বের করেন সন্ধ্যায়।

গুলি হওয়ার পরে সিচুয়েসনটা চেঞ্জ হইয়া গেলো। সবাই অবাক হইয়া গেলো যে গুলিটা করলো কেন! পরে বোঝা গেলো যে গুলিটা উস্কানিমূলক, আমরা লাফাইয়া পড়বো, তখন ওরা আমাদের আরো মারবে। তখন অনেকেই যার যার জায়গায়—নানান জায়গায় পলাইয়া গেলো। যেমন, গাজীউল হক পলাইয়া গেলো বগুড়ায়, তার বাড়িতে। ফুলবাড়িয়া যাইয়া ট্রেনে চইলা গেলো। যাওয়ার পথে সে ময়মনসিংহে একটা বাড়িতে আছিলো দুই দিন। সেই বাড়িটা হইলো—জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর শ্বশুর বাড়ি। ভাবী শ্বশুরবাড়ি, তখনো শ্বশুরবাড়ি হয় নাই। বগুড়ায় তার বাবা ছিলো মাজারে, মাজারে একটা চেল্লা ছিলো। চেল্লায় মুরীদরা টাকা-পয়সা দেয়, ঘর থাকে, বড় বড় ড্যাগ থাকে, রান্নাবান্না হয়, লোকজন খাওয়া দাওয়া করে। গাজীউল হক যাইয়া চেল্লার মধ্যে ঢুইকা ওই ঘরে বইসা রইলো, আন্ডারগ্রাউন্ডে! আমরা সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চইলা গেছি।

এইডারে পলিটিক্যালি কেউ নিলো না। আতাউর রহমান যাইয়া বুড়িগঙ্গার পারে, চুপ কইরা চকবাজারের ওইখানে সোয়ারীঘাটে তার বাড়িতে রইলেন। মওলানা ভাসানী যমুনা নদী থেইকা আর আসলো না, সে স্টেটমেন্ট দিলো; কিন্তু নদীর কোথায় সে আছে কেউ জানে না। আর কেউ নাই, সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমবঙ্গে, ফজলুল কাদের চৌধুরীসহ বাকি সবাই মুসলীম লীগের লোক। তারা কিছু বললো না।

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফয়েজ আহমদ
ইমেইল: artsbdnews24@gmail.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts