ভারতের চাল রপ্তানি বন্ধে বিশ্বে মূল্যস্ফীতির শঙ্কা বাড়ছে, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আরও ক্ষতির মুখে পড়ছে।
Published : 29 Aug 2023, 01:38 PM
ভারতের হরিয়ানায় পানিতে তলিয়ে যাওয়া নিজের ধানক্ষেতের আইলে বসেছিলেন সতীশ কুমার, দুচোখ ভরা হতাশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন পচে নষ্ট হয়ে যাওয়া ধানের চারার দিকে।
‘বিরাট ক্ষতির মধ্যে পড়েছি’, বলছিলেন পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের এই কৃষক, যিনি তার নতুন সংসারের আহার জোগাতে এই ধানচাষের ওপরই নির্ভর করেন।
সতীশ বলেন, “নভেম্বর পর্যন্ত আমি আর কিছুই ফলাতে পারব না।”
সিএনএন জানিয়েছে, উত্তর ভারতে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে গত জুলাই মাস থেকে নতুন লাগানো ধানের চারাগুলো ডুবে আছে পানির নিচে। ফসলের ক্ষতি ছাড়াও তীব্র বৃষ্টিতে আকস্মিক বন্যা ও ভূমি ধসের ঘটনা ঘটেছে ওই অঞ্চলে।
সতীশের ভাষ্য, এমন বন্যা গত কয়েক বছরেও দেখেননি তিনি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জমি ফের চাষের জন্য ঋণ নিয়েছেন।
এই সমস্যা সতীশের একার নয়।
বিশ্বের চাল রপ্তানিতে শীর্ষ ভারত। দেশের ভেতরে চালের চড়া দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাদা চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে দেশের সরকার। এরপর চাল রপ্তানিতে আরও কিছু বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন- আধাসিদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
এই কড়াকড়ি বিশ্বব্যাপী খাদ্য মূল্যস্ফীতির শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। কৃষকের জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে চাল নির্ভর বেশ কয়েকটি দেশ এই নিষেধাজ্ঞা জরুরি ভিত্তিতে তুলে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।
বিশ্বের ৩০০ কোটির বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। বিশ্বব্যাপী চাল রপ্তানির ৪০ শতাংশই করে ভারত।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার সর্বশেষ কারণ হল ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা। ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং এল নিনোর মত বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। তাতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে পারে গ্লোবাল সাউথের দরিদ্র দেশগুলো।
কৃষক সতীশ কুমার বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞায় আমাদের সবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। রপ্তানি না হলে আমরা দাম বেশি পাব না। এই বন্যা আমাদের কৃষকদের জন্য মরণ আঘাত। আর এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের শেষ করে দেবে।”
সমস্যা সবারই
হঠাৎ করে ভারতের চাল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রেও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের চালের দাম এক যুগের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ।
মান ও খ্যাতির দিক থেকে ভারতের সেরা চাল বাসমতি। এ চালের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তবু যে সাদা চালের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা দেশের মোট চাল রপ্তানির ২৫ শতাংশের মত।
অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে কেবল ভারতই খাদ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে– বিষয়টি এমন নয়। তবে রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর শস্য চুক্তি প্রত্যাহারের এক সপ্তাহ পর চাল রপ্তানিতে ভারতের ওই নিষেধাজ্ঞা বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। কৃষ্ণ সাগর শস্য চুক্তি অনুযায়ীই ইউক্রেইন শস্য রপ্তানি করত। ওই চুক্তি প্রত্যাহারের ফলে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের খাদ্যসংকটের উদ্বেগে পড়ে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসাইন সিএনএনকে বলেন, “এখানে প্রধান বিষয় হল চালই কেবল একমাত্র খাদ্যপণ্য নয়। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের দরিদ্র মানুষের সিংহভাগ খাদ্যের যোগান দেয়।”
নেপালি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ভারতের নিষেধাজ্ঞার পর তাদের দেশে চালের দাম বেড়ে গেছে। ভিয়েতনামে এক দশকের মধ্যে এখন চালের দাম সর্বোচ্চ।
বিশ্বে চাল রপ্তানিতে দ্বিতীয় থাইল্যান্ড। কিন্তু থাই চাল রপ্তানি সংস্থার মতে, কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানেও চালের দাম বাড়তি।
ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাতে সিএনএন জানিয়েছে, চাল রপ্তানি ফের চালু করতে দিল্লির কাছে আবেদন জানিয়েছে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্স। বিষয়টি নিয়ে ভারতের কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে কোনো মন্তব্য জানতে পারেনি সিএনএন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে-অলিভিয়ের গৌরিঞ্চাস জানান, এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ভারতে অনুরোধ করছেন তারা।
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক
সরকারি হিসেবে, ভারতের মোট শ্রমশক্তির অর্ধেক কৃষক। দেশটির মধ্য, দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে বেশি ধান চাষ হয়।
রয়টার্স জানিয়েছে, গ্রীষ্মের চাষাবাদ সাধারণত জুনে শুরু হয়। ওই সময় বর্ষার বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। ভারতের মোট চাল উৎপাদনের ৮০ শতাংশই হয় গরমের সময়ে।
কিন্তু চলতি বছর বর্ষা শুরু হয়েছে দেরিতে। ফলে মধ্য জুন পর্যন্ত পানির ঘাটতি ছিল অনেক বেশি। এরপর অবশেষে যখন বৃষ্টি শুরু হল, তখন গোটা দেশকে ভাসিয়ে দিল। বন্যা শুরু হল, ধ্বংস করে দিল ফসলের ক্ষেত।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা গত মাসে সতর্ক করে বলেছে, আরও চরম আবহাওয়া ও রেকর্ড তাপমাত্রার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ এল নিনো এখন সক্রিয়।
এল নিনো চলাকালে নিরক্ষরেখা বরাবর পশ্চিমমুখী বায়ুপ্রবাহ ধীর হয়ে যায় এবং পানির উষ্ণ স্রোতগুলোর পূর্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়, এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
উষ্ণায়নের এই প্রভাব ভারতের হাজারো কৃষক টের পাচ্ছে। ফলে ধান বাদ দিয়ে অন্য ফসল ফলানোর কথাও এখন ভাবছেন তারা।
আরও পড়ুন-
বাসমতি নয় এমন চাল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা ভারতের
চাল রপ্তানিতে শুল্কের সঙ্গে শঙ্কাও বাড়ালো ভারত
ফিরেছে এল নিনো, চলতি বছর রেকর্ড তাপমাত্রার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব