এ অস্ত্রের বড় যোগানদাতা ইরান বলে অভিযোগ পশ্চিমা বিশ্বের। যদিও এবারের হামলায় সরাসরি জড়িত না থাকার দাবি ইরানের।
Published : 11 Oct 2023, 01:21 AM
গাজার স্থল, জল ও আকাশ সীমান্তে ইসরায়েল ও মিশরের পাহারা এমনই কঠোর, তাদের নজর এড়িয়ে কারও পক্ষে ছোট্ট এ ভূখণ্ডে যাওয়া-আসা করা অসম্ভবই বটে। যে কারণে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটর্স ওয়াচ এ ভূখণ্ডকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘খোলা কারাগার’ বলে বর্ণনা করে।
দিনের পর দিন চলে আসা এমন অবস্থার ব্যতিক্রম ছিল শনিবার ভোর; সব নজরদারি এড়িয়ে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ পরিচালনা করে হামাস।
দুর্ভেদ্য সেই কড়া পাহারা এড়িয়ে কী করে হামাস যোদ্ধাদের হাতে সামরিকভাবে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণ করে খানিকক্ষণের জন্য হলেও দিশেহারা করে দেওয়ার মতো অস্ত্র পৌঁছেছে?
এনডিটিভির এক বিশ্লেষণে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে।
সেদিন ভোরে হামাস শুরুতে মাত্র মিনিট ২০ এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার রকেট ছুড়ে প্রতিপক্ষকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে। ওই হামলার আড়ালে তারা একই সময়ে সীমান্তে ইসরায়েলের নজরদারি যন্ত্রপাতির উপর ড্রোন হামলা চালিয়েছে। তারপর তারা সীমান্ত বেড়ায় ৮০টির বেশি জায়গায় বড় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মোটরসাইকেল ও গাড়িতে করে সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করেছে।
হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে গুলি চালিয়ে বহু ইসরায়েলিকে হত্যা করে এবং আরও অনেক ইসরায়েলিকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে।
এরপর জবাবে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে গাজাকে একপ্রকার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। চার দিন ধরে সব রকমের হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা।
ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো জানিয়েছে, হামাসের হামলায় নিহত ইসরায়েলির সংখ্যা বেড়ে ৯০০ জন হয়েছে আর আহত হয়েছে অন্তত ২৬০০ জন; এছাড়া আরও বহু জনকে ধরে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
অপরদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরায়েলের আক্রমণে এখন পর্যন্ত ৬৮০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি।
গাজার আয়তন মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এ ভূখণ্ডে বাস করেন প্রায় ২৩ লাখ মানুষ। এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাও বটে। যে দুটি ভূখণ্ড নিয়ে ফিলিস্তিনিরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে তার একটি গাজা, অন্যটি পশ্চিম তীর। মাঝখানে ইসরায়েল থাকায় ভূখণ্ড দুটি পরষ্পর থেকে বিচ্ছিন্ন।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলের দখল নিয়েছিল। সেই থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী জনগণ তাদের লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে আসছে।
ইতিহাসের নানান ঘটনার পথ পেরিয়ে ইসরায়েলের সেনারা গাজা ছেড়ে চলে যান ২০০৫ সালে। পরের বছর নির্বাচনে গাজার ক্ষমতায় আসে ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। তারা ক্ষমতায় আসায় এ ভূখণ্ডে নজরদারি কঠোর করে ইসরায়েল, যাতে বাইরে থেকে হামাসের হাতে কোনো অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে।
গাজার দুই দিকে ইসরায়েল ও একদিকে মিশর। অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর। মিশর বরাবরই এ সীমান্ত কঠোর পাহারায় রেখেছে। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরে রয়েছে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর কঠোর অবস্থান। তারা গাজার বাসিন্দাদের সমুদ্রে সর্বোচ্চ ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত স্বাধীনভাবে চলাচল করতে দেয়; এর বেশি যাওয়ার অনুমতি নেই।
হামাসের হামলা মোকাবেলায় কেন দেরি করেছিল ইসরায়েল?
হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হাজার ছাড়িয়েছে
এর মধ্যেও সব নজরদারি এড়িয়ে হামলার প্রস্তুতিতে অস্ত্রের যোগান পাওয়া এবং হামলা চালানোর বিষয়ক এ বিশ্লেষণে এনডিটিভি জানায়, অস্ত্র পাচারকারীরা ভূমধ্যসাগর উপকূলে অস্ত্র ফেলে যায়। তারপর সেগুলো সুযোগ বুঝে হামাসের কাছে সরবরাহ করা হয়। ইসরায়েলের কড়া পাহারার মধ্যেও তারা যে এ কাজে সফল হয় তার প্রমাণ গত শনিবার হামাসের ছোড়া রকেটগুলো।
মাটির নিচে সুড়ঙ্গ পথ দিয়েও হামাসের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেয় অস্ত্র চোরাকারবারীরা। গাজার সঙ্গে মিশরের যে সীমান্ত আছে মূলত সেই সীমান্ত ব্যবহার করে সুড়ঙ্গ পথে গাজায় অস্ত্র আসে।
অপরদিকে হামাসের হাতে থাকা ফজর-৩, ফজর-৫ এবং এম-৩০২ রকেটগুলো আসে ইরান ও সিরিয়া থেকে। ফজর-৩ ইরানের তৈরি ভূমি থেকে ভূমিতে উৎক্ষেপণযোগ্য আর্টিলারি রকেট। ৪৩ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে ফজর-৩।
আরেক সশস্ত্র বাহিনী হিজবুল্লাহর হাতে প্রচুর ফজর-৩ রকেট রয়েছে। ফজর-৫ রকেট ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে গিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। এম-৩০২ রকেট বা খাইবার-১ রকেটও ইরানের তৈরি। দীর্ঘপাল্লার এ রকেটও ব্যবহার করেছে হামাস। হিজবুল্লাহ যার যোগান দিয়েছে বলে অনেকের ভাষ্য।
ইসরায়েলে হামাসের হামলা পরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছিল ইরান?
গত শনিবার ভোরে মাত্র ২০ মিনিটে ইসরায়েলে পাঁচ হাজারের বেশি রকেট ছুড়েছে হামাস। মূলত, ব্যাপক এবং দ্রুত গতির এই হামলা ইসরায়েলকে কয়েকঘণ্টার জন্য সেদিন দিশাহীন করে দিয়েছিল।
বছরের পর বছর ধরে হামাস নিজেদের রকেট প্রযুক্তিতেও একটু একটু করে উন্নতি করেছে। তবে ইসরায়েলের প্রায় দুর্ভেদ্য আয়রন ডোম আকাশ সুরক্ষা ব্যবস্থাকে তীব্র হামলায় চমকে দিতে মূলত ইরানের তৈরি অস্ত্রগুলোর ব্যবহার করেছে হামাস।
যদিও ইরান হামাসের এই ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ এ সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এমনকি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসকে তহবিল যোগান দেওয়ার অভিযোগও তারা উড়িয়ে দিয়েছে।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাস ইরানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ, তহবিল ও অস্ত্র পায়। হামাসের তহবিলের ৭০ শতাংশের যোগানদাতা ইরান বলেও ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
তালেবান সংযোগ
এমন খবরও শোনা যাচ্ছে যে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলায় হামাস যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্রও ব্যবহার করেছে এবং তার যোগান দিয়েছে আফগানিস্তানের তালেবান। ২০২১ সালে আফগানিস্তান অভিযান সমাপ্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরপরই পুনরায় দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। তখন দেশটিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর অস্ত্র তাদের হাতে চলে যায়।