ইরান হামলার পেছনে ইরান ছিল, এমন সত্য যদি বেরিয়ে আসে তাহলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ে তা আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
Published : 10 Oct 2023, 08:14 PM
ইসরায়েলের ভেতরে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রাণঘাতী হামলার ঘটনায় ইসরায়েলের ঘোর শত্রু ইরান জড়িত ছিল কিনা সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি প্রতিবেদনে হামাস এবং লেবাননের গেরিলা গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর কয়েকজন সদস্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ইরান এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েলে ওই হামলার সবুজ সংকেত দিয়েছিল। এই সদস্যদের কোনও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
তবে, ওয়াশিংটনে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা পরে বলেছেন, হামলায় ইরানের ভূমিকা থাকার যেসব অভিযোগ উঠেছে তা যাচাই করার জন্য এ মুহূর্তে তাদের কাছে কোনও তথ্য নেই।
হামলার পেছনে ইরান ছিল, এমন সত্য যদি বেরিয়ে আসে তাহলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ে তা আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
তাই ইরানের নেতারা ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর আনন্দ প্রকাশ করে এর প্রশংসা করলেও তারা দ্রুতই এ ঘটনার সঙ্গে কোনওরকম সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “এ হামলার সঙ্গে ইরানের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে।”
ইরানের এক মুখপাত্র বলেছেন, অন্য দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ইরানের কোনও হস্তক্ষেপ নেই। কিন্তু একথার মানে এই নয় যে, ইরান হামলা পরিকল্পনায় জড়িত ছিল না।
হামাসের হামলার সঙ্গে ইরানের সম্পৃক্ত থাকা নিয়ে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কোন প্রমাণ না থাকলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, “হামাস এবং ইরানের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে।”
বহু বছর ধরে হামাসকে সমর্থন ও সাহায্য দিয়ে আসছে ইরান। হামাসকে অর্থ এবং বিপুল অস্ত্র সহায়তা দেয় হামাস। এমনকি হামাস রকেটও পায় ইরানের কাছ থেকে।
ইরানের কাছ থেকে অস্ত্র যাতে গাজায় হামাসের হাতে যেতে না পারে সেজন্য সরবরাহপথ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।
বিবিসি জানায়, গাজায় অস্ত্র সরবরাহ হয় সুদান এবং ইয়েমেন রুটে। তাছাড়া, লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে এবং মিশরের সিনাই উপদ্বীপ দিয়েও বেদুঈন চোরাকারবারীদের মাধ্যমে গাজায় ইরানের অস্ত্র প্রবেশ করে।
ইসরায়েলের ঘোর শত্রু দেশ হওয়ার কারণে ইরান স্পষ্টতই ইহুদি রাষ্ট্রটিকে দুর্দশাগ্রস্ত্র দেখতে চায়।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাইম তোমের বিবিসি-কে বলেন, ইসরায়েলের ভেতরে হামাসের হামলার সঙ্গে ইরানের সম্পৃক্ত থাকার ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, “ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে শান্তি চুক্তি হতে চলেছে- এমন খবরের প্রতিক্রিয়ায় এ হামলা হয়েছে।”
কিন্তু গত শনিবার ইসরায়েলে হামলার জন্য ইরান সত্যিই নির্দেশ দিয়েছিল কী না সেটির প্রমাণ পাওয়া ‘কিছুটা কঠিন’ বলে উল্লেখ করেন তোমের। তিনি বলেন, “ইরান হামাসকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করে। সিরিয়া, এমনকি ইরানের ভেতরে হামাস সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়; একথা সত্য।”
তিনি দাবি করেন, হামাসের সামরিক শাখার প্রধান সালেহ-আল-আরৌরি এবং হামাসের অন্যান্য আরও নেতা সম্প্রতি লেবানন থেকে ইরানে অনেকবার আসা-যাওয়া করেছেন। সেখানে তারা বহু বৈঠক করেছেন, যার মধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে।
কিন্তু ইসরায়েলে হামলার সময়ের ব্যাখ্যা দিতে গেলে কেবল হামাস এবং ইরানের মধ্যকার ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’টাই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন তোমের। তার কথায়, হামাস ইসরায়েলের ভেতরকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত খুব ভালভাবেই জানে। ফলে, ইরান নানাভাবে হামাসকে সমর্থন দিলেও তোমের মনে করেন, ইসরায়েলে হামলার পেছনে অন্তত ৭৫ শতাংশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে হামাস নিজেই।
এর সঙ্গে একমত তেল আবিব ইউনিভার্সিটির ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রাজ জিম্মট। “এটি ফিলিস্তিনিদের কাহিনী,” সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন রাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, গত সোমবার লেবাননের বৈরুতে একটি বৈঠকে ইসরায়েলে হামলার জন্য ইরান সবুজ সংকেত দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হামাস এবং হেজবুল্লাহর সদস্যদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত অগাস্ট মাস থেকে হামাসের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করেছে ইসরায়েলে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে গত শনিবারের নজিরবিহীন অভিযানের জন্য।
গাজায় ইসরায়েলের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে হামাস সাধারণত যে ধরনের হামলা করে শনিবারের হামলা সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সুপরিকল্পিত এবং সুক্ষ্ম ছিল।
হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ, ড্রোন, গাড়ি এবং হস্ত-চালিত গ্লাইডার দিয়ে হামাস যেভাবে হামলা চালিয়েছে, তাতে বোঝা যায় এ হামলা পরিকল্পনাকারীরা ইউক্রেইন যুদ্ধসহ সাম্প্রতিক হাইব্রিড ওয়ারফেয়ারের দৃষ্টান্তগুলো ভালোভাবে গবেষণা করেছে।
তেল আবিব ইউনিভার্সিটির ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রাজ বলেছেন, “হামলার সিদ্ধান্ত হামাস-ই নিয়েছে। তাদের নিজেদের স্বার্থ এবং ফিলিস্তিনের বাস্তবতার আলোকে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
“হামাস কি ইরানের সাহায্য কাজে লাগিয়েছে? অবশ্যই লাগিয়েছে। হামলায় ইরানের স্বার্থ জড়িত ছিল? হ্যাঁ ছিল। হামলা করার জন্য হামাসের কি ইরানের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল? না,” বলেন রাজ।
সাবেক মোসাদ কর্মকর্তা হাইম তোমের বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে হামাস তাদের একটি এলিট ফোর্স গড়ে তোলার কাজ করছে। সামনের দিনে আরো কী ঘটতে পারে এবং ইরানের সম্পৃক্ততা আরও প্রকাশ্য হয় কী না তা নিয়ে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা এখন সতর্কভাবে উত্তর-দক্ষিণে নজর রাখছেন।
লেবাননে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হেজবুল্লাহ এরই মধ্যে ছোট-ছোট দুটি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত গোলান মালভূমিতে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলছে, তারা লেবাননের ভেতরের নিশানায় হেলিকপ্টার দিয়ে হামলা চালিয়েছে।
রাজ বলেন, “হামাসের হামলা মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা বদলে দেবে এবং ইরান কেবলমাত্র হামাসকে সহায়তা করে যাওয়া এবং সমন্বয় করা থেকে আরও এগিয়ে সরাসরি ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যদি ইসরায়েলের পাল্টা জবাব হামাসের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে।”