রাজনীতিকদের আর্থিক কেলেঙ্কারি আর নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে হতাশ অনেকেই।
Published : 27 Oct 2024, 01:00 PM
একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জাপানের ক্ষমতাসীন দলের টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই রোববার দেশটিতে আগাম নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হচ্ছে।
বিবিসি লিখেছে, ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) প্রধান নির্বাচিত হওয়ার তিন দিন বাদে এ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন শিগেরু ইশিবা। এর আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন।
রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রহ নিয়ে কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার পর এ বছরের শুরুতে এলডিপির প্রতি মানুষের আস্থা ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। এই পরিস্থিতিতে এলডিপি প্রধান হওয়ার পর আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন ইশিবা।
তবুও এলডিপি বিরোধী দলগুলোর জন্য শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে। বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনই শাসনের প্রশ্নে তারা যে ক্ষমতাসীনদের বিকল্প তা ভোটারদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে।
পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সময় প্রধান বিরোধী দলের প্রতি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল।
কেয়ার-হোম সেক্টরে কাজ করা দীর্ঘদিনের এলডিপি সমর্থক মিয়ুকি ফুজিসাকি নির্বাচনের আগে বিবিসিকে বলেন, “দল বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন, আমি মনে করি মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে।”
দুর্নীতির অভিযোগের কারণে এলডিপি যে সংকটে আছে, তা মেনেই ৬৬ বছর বয়সী এই জাপানি বলেন, “কিন্তু বিরোধীরা সেইভাবে দাঁড়াতে পারেনি। তারা অনেক অভিযোগই করেছে, তবে তারা কী চায় তা স্পষ্ট নয়।”
২০২১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো ফুমিও কিশিদা গত অগাস্টে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এরপর দলীয় প্রধানের নির্বাচনে জয় পেয়ে সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিগেরু ইশিবা।
হারানো জনসমর্থন ফেরাতে এলডিপি যখন মরিয়া, ঠিক তখনই এই সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা আসে।
দীর্ঘদিনের রাজনীতিক সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইশিবা এই নির্বাচনকে ‘জনগণের রায়’ হিসেবে দেখছেন।
তবে এলডিপি মানুষের আস্থা ফেরাতে পারবে কি না তা এখনো অনিশ্চিত। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি বেশিরভাগ সময়ই ক্ষমতায় ছিল।
একের পর এক কেলেঙ্কারি শাসক দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এর মধ্যে প্রধান হল- বিতর্কিত ইউনিফিকেশন চার্চের সঙ্গে দলের সম্পর্ক; সমালোচকরা যে চার্চকে গুপ্তসংঘ বলে থাকেন।
এরপরই প্রকাশ্যে আসে রাজনৈতিক তহবিল দুর্নীতি কেলেঙ্কারির ঘটনা। কয়েক ডজন এলডিপি আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রহের আয়োজন থেকে অর্থ তসরুপের অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন কৌঁসুলিরা। কোটি কোটি ডলার আত্মসাতের ওই অভিযোগ শক্তিশালী রাজনৈতিক দলটির মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দিয়েছে।
টোকিওর উপকণ্ঠে উরাওয়া স্টেশনে বিরোধীদের এক নির্বাচনী সমাবেশে যোগ দিতে আসা মিচিকো হামাদা বলেন, “ক্ষমতাসীন দল কী শোচনীয় অবস্থায় আছে। এটাই আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে। আমার কাছে যেটা মনে হয়, ওদের কর ফাঁকির বিষয়টা ক্ষমার অযোগ্য।”
এ বিষয়টি এমন একসময়ে তাকে নাড়া দেয়, যখন জাপানিরা নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্যের জন্য হাঁপিয়ে উঠেছে। তিন দশক ধরে মজুরি না বাড়লেও জিনিসপত্রের দাম গত দুই বছরে এতো বেড়েছে যা বিগত অর্ধ শতাব্দীতে দেখা যায়নি।
এ মাসে ভোটাররা যখন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি ডাক, ওষুধ, বিদ্যুৎ, গ্যাসের মত নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে।
হামাদা বলেন, “প্রতি মাসে খাবারের জন্য আমি ১০ হাজার বা ২০ হাজার ইয়েনের বেশি ব্যয় করি।
“আর এখন অনেক জিনিসই কিনছি না যেটা আগে কিনতাম। আমি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছি কিন্তু এটি এখন আরো বেড়ে গেছে। ফলের মত জিনিসের দাম অনেক বেশি।”
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে তিনি একাই উদ্বিগ্ন নন। পেনশনভোগী চি শিমিজু বলেন, এখন তাকে পার্টটাইম কাজ করতে হবে।
উরাওয়া স্টেশনের একটি স্ট্যান্ড থেকে কিছু খাবার নিতে নিতে তিনি বিবিসিকে বলেন, "আমাদের ঘণ্টাপ্রতি মজুরি কিছুটা বেড়েছে, তবে সেটা জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে যায় না।
“আমি সস্তা এবং ভালো কিছু খুঁজতে এই ধরনের জায়গায় আসি, কারণ সাধারণ দোকানে সবকিছুই ব্যয়বহুল।”
শিমিজু অনেক বছর ভোট না দিলেও এবার তিনি ভোট দিতে পারেন; যদিও তিনি নিশ্চিত নন কোন প্রার্থী বা কোন দলকে ভোট দেবেন।
“আমি এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না যাকে আমি ভোট দিতে পারি। আমার মনে হয়, এমন কেউ নেই যাকে আমি আমাদের নেতা হিসেবে বিশ্বাস করতে পারি। যারা পয়সা কামানো জন্য এমপি হয়েছেন, তাদের কথা ভেবে অবাক হই।”
বিবিসি লিখেছে, এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন দেখে মনে হতে পারে যে, ইশিবা রাজনৈতিক জুয়া খেলছেন। নিম্নকক্ষের ৪৬৫টি আসনের মধ্যে তার দলের ছিল ২৪৭টি আসন, আর জোটের শরিক কোমেইতোর দখলে ছিল ৩২টি আসন।
ডায়েট নামে পরিচিত নিম্নকক্ষের নিয়ন্ত্রণ পেতে একটি দলের অন্তত ২৩৩টি আসন প্রয়োজন হয়। কোমেইতো আগের সমান আসন ধরে রাখতে সক্ষম হবে না বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল সবশেষ সংসদে ৯৮টি আসন পেয়েছিল, তারা এবার আরও ভোটার টানার চেষ্টা করছে।
জাপানের টেম্পল ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিজ অ্যান্ড হিস্ট্রির অধ্যাপক জেফ কিংস্টন বিবিসিকে বলেন, “আমি মনে করি, এলডিপি নিজেদের খোঁড়া গর্তেই পড়েছে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটি আর জনমতকে গুরুত্ব দেয় না, কেনইবা দেবে? এখানে শুধু কেলেঙ্কারির ঘটনাই ঘটেছে।”
তবে এসবের কোনোটির কারণে দলটি পরাজিত হবে বলে মনে করেন না অধ্যাপক কিংসটন।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, যেসব আসনে জয়-পরাজয়ের সমান সম্ভাবনা থাকে, সেসব আসন হারানোর আশঙ্কায় তারা (এলডিপি) উদ্বিগ্ন। সেই সঙ্গে শরিক কোমেইতোকে নিয়ে প্রশ্ন আছে এবং জোটে তারা কতটা কার্যকর অংশীদার হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”
কেয়ার-হোম খাতের কর্মী মিয়ুকি ফুজিসাকি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যদি এলডিপি জয় পায়, তবে পরিবর্তনের জন্য তাদের বক্তৃতাবাজির চেয়ে আরও বেশি কিছু করতে হবে।
“আমি চাই তারা আমাদের দেখাক তারা কী করতে যাচ্ছে- যাতে এই [কেলেঙ্কারি] আবার না ঘটে। শুধু ভোটের সময় বুলি আওড়ালেই হবে না, তাদের সেটা প্রমাণ করে দিতে হবে।”