কী অদ্ভুত এ যোগসূত্র যে, পৃথিবী থেকে শত কোটি কিলোমিটার দূরের বিভিন্ন বিধ্বংসী ঘটনার প্রভাব পড়ছে পৃথিবীতে জীবন ধারণের কয়েকটি মূল উপাদানের ওপর!
Published : 04 Apr 2024, 03:02 PM
মানবদেহ ও আমাদের চারপাশের জগৎ যেসব মৌলিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়েছে, এগুলো কীভাবে বা কোথা থেকে এসেছে?
‘কিংস কলেজ লন্ডনে’র জন আর এলিসের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী এ বিষয়ে একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন।
তাদের দাবি, মানুষ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্বের সঙ্গে মহাবিশ্ব থেকে আসা তরঙ্গের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা ‘গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’ নামে এটি পরিচিত।
আরও সহজ করে বললে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হল— ঢেউয়ের মতো, যা বিশালাকারের বিভিন্ন বস্তুর নড়াচড়ার মাধ্যমে মহাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এ ধরনের তরঙ্গ ‘মহাজাগতিক নৃত্যে’ বিশাল ভূমিকা পালন করে, যেখানে বিভিন্ন নিউট্রন তারা বা বিস্ফোরিত নক্ষত্রের অত্যন্ত ঘন অবশিষ্টাংশে ধীরে ধীরে একসঙ্গে কাছাকাছি চলে আসে ও এদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে।
এ সংঘর্ষ কেবল একটি দর্শনীয় মহাজাগতিক ঘটনাই নয়; বরং আয়োডিন ও ব্রোমিন’সহ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কয়েকটি প্রয়োজনীয় উপাদানের ‘কারখানাও’ বলা যায় একে।
এই আয়োডিন আর ব্রোমিন কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ হচ্ছে, মানবদেহ অনেকটা জটিল মেশিনের মতো, যেটি সুচারুভাবে চালাতে বিভিন্ন উপাদানের দরকার হয়। আয়োডিন মানবদেহের থাইরয়েডের হরমোন তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ঘাড়ের একটি ছোট গ্রন্থি, যা থেকে উৎপন্ন হরমোন পেটের ভেতর খাবার ভেঙে সেখান থেকে শক্তি উৎপন্ন করায় ভূমিকা রাখে।
ব্রোমিন, মানবদেহের বিশেষ একটি টিস্যুর বিকাশে সাহায্য করে - একে বলে কানেকটিভ বা সংযোজক টিস্যু। এ উপাদানগুলো না থাকলে আমরা যতটা সহজভাবে জীবনধারণ করি, সেটা সম্ভবত সম্ভব হতো না।
কিন্তু, এ উপাদানগুলো আসে কোথা থেকে? গবেষকরা বলছেন, মহাবিশ্ব একটি বিশাল রান্নাঘরের মতো, যেখানে বিভিন্ন উপাদান তৈরির জন্য নানা ধরনের রেসিপি রয়েছে।
হাইড্রোজেন, কার্বন ও অক্সিজেনের মতো জীবনের অপরিহার্য বিভিন্ন উপাদানের বেশিরভাগই তারা’র জ্বলন্ত চুল্লিতে রান্না করা হয়। আর এ তারাগুলো বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে একটি সুপারনোভায় পরিণত হয়।
আয়োডিন ও ব্রোমিনের সঙ্গে কিছু অন্যান্য উপাদান মিলে এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ অবস্থা তৈরি হয়, আর এমনটা ঘটে যখন নিউট্রন তারা’র সংঘর্ষ ঘটে।
প্রক্রিয়াটি ‘আর-প্রসেস’ নামে পরিচিত, যেখানে নিউট্রন দ্রুত ধারণ করার মাধ্যমে ভারী উপাদান তৈরি হয়। কী অদ্ভুত এ যোগসূত্র যে, পৃথিবী থেকে শত কোটি কিলোমিটার দূরের বিভিন্ন বিধ্বংসী ঘটনার প্রভাব পড়ছে পৃথিবীতে জীবন ধারণের কয়েকটি মূল উপাদানের ওপর! - উল্লেখ রয়েছে এ নিয়ে প্রকাশিত বিজ্ঞানবিষয়ক সাইট নোরিজ-এর নিবন্ধে।
‘আর-প্রসেস’ শুধু একটি তত্ত্ব নয়। দীর্ঘদিন ধরেই নিউট্রন তারা’র সংঘর্ষ ও এদের থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। এমনই একটি সংঘর্ষ শনাক্ত হয়েছিল ২০১৭ সালে, যা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, একেবারে স্পেস-টাইমের মধ্য দিয়ে তরঙ্গ পাঠিয়েছিল এটি। আর তা শনাক্ত করা গিয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন মানমিন্দরের মাধ্যমে।
এই ঘটনা যে কেবল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রমাণ দিয়েছে, তা নয়। বরং এমন একটি মহাজাগতিক ঘটনা আমাদের সামনে তুলে এনেছে, যেখান থেকে জীবন ধারণের জন্য দরকারি উপাদান তৈরি হয়ে থাকে।
গবেষণাটি একটি অদ্ভুত ইঙ্গিত দেয়, চাঁদে সম্ভবত এমন মহাজাগতিক ঘটনার চিহ্ন পাওয়া যাবে, যা মানুষের কাছে এখনও অধরা রয়ে গেছে। চাঁদের মাটি গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, তারা এর থেকে আয়োডিনের মতো বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদানের উৎস সম্পর্কে আরও যোগসূত্র খুঁজে পাবেন।
মহাবিশ্ব শুধু তারা ও গ্রহে পরিপূর্ণ একটি জায়গা নয়, বরং এটি এমন গতিশীল, একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি সমন্বিত ব্যবস্থা, যা আমাদের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক ‘কর্নেল ইউনিভার্সিটি’র ওয়েবসাইটে।