ড্রোন প্রযুক্তিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন ইউরোপীয় উদ্যোক্তারা; কার্গো পরিবহনে ব্যবহারের লক্ষ্যে ড্রোনের বহুল প্রচলনের লক্ষ্যে কাজ করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
Published : 25 Dec 2022, 03:48 PM
বছর জুড়ে আলোচিত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে আসামরিক ড্রোনের সামরিক ব্যবহার। আগের বছরগুলোতে আকাশ থেকে দৃষ্টিনন্দন ফটো-ভিডিও ধারনের জন্য সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছেও আলাদা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল ড্রোন প্রযুক্তি।
এ প্রযুক্তিকে আরও একধাপ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন ইউরোপীয় উদ্যোক্তারা; কার্গো পরিবহনে ব্যবহারের লক্ষ্যে পাইলটবিহীন ড্রোন বহুল প্রচলনের লক্ষ্যে কাজ করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
তেমনই এক উদ্যোক্তো বুলগেরিয়ার স্ফিলেন রেইঞ্জেলোভ; ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ড্রোনামিক্স।
অ্যারোস্পেস প্রকৌশলী রেইঞ্জেলোভ যখন ড্রোনামিক্স প্রতিষ্ঠা করেন, তখন অ্যামাজন পরীক্ষা চালাচ্ছিল ছোট ছোট ড্রোন ব্যবহার করে সরাসরি ক্রেতার দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দেওয়ার প্রযুক্তি নিয়ে। কিন্তু এর সঙ্গে একেবারেই একমত নন তিনি।
ক্রেতাদের দোরগোড়ায় ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতাগুলোর কথা আগেই ভেবে রেখেছিলেন রেইঞ্জেলোভ। “আমরা আসলে ছোট ড্রোন ব্যবহারের ভাবনার কার্যকারিতা খুঁজে পাইনি। তাই আমরা ভিন্ন কৌশল বেছে নিয়েছি।”
রেইঞ্জেলোভের এ ভাবনা থেকেই ড্রোন প্রযুক্তিভিত্তিক কার্গো এয়ারক্র্যাফট নির্মাণ প্রকল্পের শুরু। আর বুলগেরিয়াতে বসেই নিজেদের ভাবনাকে ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন রেইঞ্জেলোভ; আনুষ্ঠানিক অভিষেকের সময় তাদের কার্গো ড্রোনের নাম হবে ‘ব্ল্যাক সোয়ান’।
বিবিসি লিখেছে, ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ দেখতে বাজারে বহুল প্রচলিত ছোট আকারের প্লেনগুলোর মতো হলেও পাইলটের জন্য কোনো কেবিন নেই এতে। ‘সস্তা সেলফোন প্রযুক্তি’ ব্যবহার করে নির্মিত ড্রোনটি একদম ছোট রানওয়েতেও অবতরণ করতে পারে বলে দাবি করেছেন রেইঞ্জেলোভ।
“বুলগেরিয়াতে এয়ার কার্গো মানে হচ্ছে একটা বড় প্লেন থেকে মালামাল নামিয়ে ট্রাকে তোলা, যা পড়ে শ্রেণীবিন্যাসের জন্য বিশেষ স্থানে নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে সরবরাহের পরবর্তী পর্যায়ের জন্য সাজানো হয়।”
এ পরিস্থিতিতে ছোট রানওয়ে ব্যবহার করে মূল প্রাপকের অবস্থানের কাছাকাছি কোথাও আকারে ছোট কার্গো পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে খরচ কমানো এবং রাজপথে মালবাহী ট্রাকের সংখ্যা কমানো সম্ভব বলে মনে করেন রেইঞ্জেলোভ। “পুরো ইউরোপ জুড়ে তিন হাজার এয়ারস্ট্রিপ আছে, অবতরণের জন্য যা অনেক জায়গা।”
বিবিসি জানিয়েছে, ব্ল্যাক সোয়ান নির্মাণে ড্রোনামিক্স বিশেষ হালকা শঙ্কর উপাদান ব্যবহার করছে। তবে, এর ইঞ্জিন পেট্রোল নির্ভর।
সর্বোচ্চ ৩৫০ কেজি কার্গো নিয়ে ২০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়বে ব্ল্যাক সোয়ান। এতে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের যাত্রাপথ এড়িয়ে চলতে পারবে কার্গো ড্রোনটি। তবে, কার্বনঃনিসরণ কমাতে কার্গো ড্রোনটিতে নতুন ধরনের কৃত্রিম জ্বালানী ব্যবহারের সম্ভাবত্যাও যাচাই করছেন এর নির্মাতারা।
রেইঞ্জেলোভের ভাষ্যে, “আমরা এক শহর থেকে আরেক শহর সংযুক্ত করতে চাই, সরবরাহকারীর কাছ থেকে প্রাপকের দরজা নয়।”
বিবিসি লিখেছে, ব্ল্যাক সোয়ান পুরোদস্তুর এয়ারলাইন সেবার মতো পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে ড্রোনামিক্স; রেইঞ্জেলোভের ভাষ্যে, “ইউরোপের প্রথম ড্রোন কার্গো এয়ারলাইন।”
ওজনের ভিত্তিতে ফি ধার্য করবে ড্রোনামিক্স; বড় পরিসরে কোম্পানির সেবা চালু হলে ইউরোপজুড়ে পণ্য সরবরাহের খরচ ও সময় দুটোই কমবে বলে দাবি এ উদ্যোক্তার।
একই পথে হাঁটছে জার্মানির পণ্য পরিবহন জায়ান্ট হেলম্যান; কোম্পানির এ উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়ান ক্লাইনে-লাসথুস। উড়োজাহাজে পণ্য পরিবহনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই কর্মকর্তার মতে, কার্গো ড্রোনের আবির্ভাবে প্রচলিত কার্গো পরিবহন শিল্পে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না।
কিন্তু হেলমান আগে যেসব অঞ্চলে পণ্য সরবরাহ করতে ট্র্যাকের ওপর নির্ভর করতো, সেসব অঞ্চলে কার্গো ড্রোনগুলো কাজে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
প্রথম পর্যায়ে হেলম্যান কার্গো ড্রোন ব্যবহার করে গ্রীক দ্বীপগুলোতে পণ্য সরবরাহ সহজ করতে চাইছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন তিনি।
“ফেরির চেয়েও বেশিবার যাতায়াত করতে পারবে ড্রোনগুলো। এর মাধ্যমে পণ্য সরবরাহকে আমরা আলাদা আলাদা প্যাকেজে ভাগ করতে পারবো এবং আরও বেশিবার পণ্য সরবরাহ করতে পারবো। একটা বড় পরিবর্তনের আশা দেখাচ্ছে এ প্রযুক্তি,” বিবিসিকে বলেন ক্লাইনে-লাসথুস।
ব্ল্যাক সোয়ানের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপের পুরোটাই ইইউ-ভিত্তিক কার্গো হাবের নাগালের মধ্যে আনতে চায় ড্রোনামিক্স। ২০২৩ সালে ব্ল্যাক সোয়ানের প্রথম পরীক্ষামূলক সংস্করণ ওড়ানোর পরিকল্পনা করছেন এর নির্মাতারা।
ইউরোপের অ্যারোস্পেস নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ব্ল্যাক সোয়ান সম্পর্কে অবহিত আছে এবং সীমিত পরিসরে এক কার্যক্রম পরীক্ষা করার জন্য লাইসেন্স দিয়েছে বলে জানিয়েছে ড্রোনামিক্স।
হেলম্যানও ২০২৩ সালেই নিজস্ব ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। পণ্য পরিবহনে ড্রোন ব্যবহারের লক্ষ্যে একসঙ্গেই কাজ করছে হেরম্যান ও ড্রোনামিক্স। এ প্রসঙ্গে ক্লাইনে-লাসথুসের বক্তব্য, “পার্সেল ড্রোনের ভাবনায় আমি কখনোই বিশ্বাস করিনি। এ কারণেই আমরা ড্রোনামিক্সের সঙ্গে কাজ করছি। এটা অ্যামাজন ডেলিভারির মতো ভাবনা নয়।”
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ‘ব্রিস্টোউ’-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ড্রোনভিত্তিক পণ্য সরবরাহ প্রযুক্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হেলিকপ্টার নির্ভর পরিবহন সেবা দেয় কোম্পানিটি। ইতোমধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ‘এলরয় এয়ার’-এর কাছ থেকে একশ কার্গো ড্রোন কেনার চুক্তি করেছে তারা।
বাজারে বিদ্যমান যাত্রীবাহী ‘ইলেকট্রিক ভার্টিকাল টেক-অফ (ইভিটল)’ উড়ুক্ক যানগুলো পুরোপুরি বিদ্যুৎ শক্তি নির্ভর হলেও এলরয় এয়ারের কার্গো ড্রোন হাইব্রিড ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ব্যবহার করে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
আর হাইব্রিড ইঞ্জিনের কারণে বিদ্যমান এয়ারপোর্টগুলো থেকেই জ্বালানী নিতে পারবে কার্গো ড্রোনগুলো, আলাদা করে ডকিং স্টেশন লাগবে না। আর হেলিকপ্টারের এক-তৃতীয়াংশ জ্বালানী খরচ করে এলরয় এয়ারের কার্গো ড্রোনগুলো।
এ প্রসঙ্গে ব্রিস্টোউ কর্মকর্তা ডেভিড স্টেপানেক বলেন “পুরোপুরি বৈদ্যুতিক যানের মানে হচ্ছে আপনি কোথায় এর চার্জিং বেইজ রাখবেন তার ওপর নির্ভর করবে এর সীমাবদ্ধতা।” সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতেই হাইব্রড ইঞ্জিনের ব্যবহার।
পশ্চিম আফ্রিকায় নিজস্ব বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে এলরয় এয়ারের তৈরি কার্গো ড্রোন ব্যবহারের কথা ভাবছে ব্রিস্টোউ। সাগরের তলদেশ থেকে খনিজ তেল আহরণ শিল্পের জন্য দ্রুত যন্ত্রাংশ ও আনুসাঙ্গিক টুল সরবরাহে ড্রোনগুলো ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে কোম্পানিটি।
বিবিসি জানিয়েছে, ২২৬ কেজি কার্গো নিয়ে সরাসরি উলম্বভাবে উড্ডয়নে সক্ষম ড্রোন নির্মাণের চেষ্টা করছে এলরয় এয়ার; ৪৮০ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে পারবে ‘শ্যাপারেল’ নামের ড্রোনগুলো।
এক সময়ে উবারের পণ্য পরিবহন বিভাগে স্বচালিত পরিবহন যান নিয়ে কাজ করেছেন এলরয় এয়ারের কোফি আশান্তে। স্বচালিত ট্রাকের সঙ্গে কার্গো পড জুড়ে দেওয়ার প্রযুক্তি কার্গো ড্রোনের সঙ্গেও কাজ করে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটি (এফএএ)’র সঙ্গে এলরয় এয়ারের সুসম্পর্ক রয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন আশান্তে; ২০২৩ সালে নিজস্ব ড্রোনের প্রথম পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করে রেখেছে তার কোম্পানি।
২৬ ফুট প্রস্থের ড্রোনটি অসামরিক ড্রোনের বিচারে আকারে বেশ বড় বলে স্বীকার করেছেন আশান্তে। তবে, এর আকারই ড্রোনটির জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক দিক বলে জানিয়েছেন তিনি।
“একটা ইউএভি (আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল)-এর চেয়ে একশ গুণ বেশি ওজন বহন করতে পারে এটি। পরিবহন ক্ষমতার হিসেবে এটা একটা ছোট আকৃতির প্লেনের সমান, কিন্তু পরিচালনার খরচ হেলিকপ্টারের চেয়েও কম।”
সাধারণ ক্রেতাদের জন্য ড্রোনের মাধ্যমে দোরগোড়ায় পণ্য পাওয়া এখনও অনেকটাই দূরের স্বপ্ন। কিন্তু একটি ড্রোন স্বপ্নের মৃত্যুতে সম্ভবত নতুন আরেকটি ডানা মেলার সুযোগ খুঁজে পেয়েছে বলে লিখেছে বিবিসি।