ছেলের জন্য লড়ব, জিতবও: জাহাঙ্গীরের মা

প্রথবারের মতো সংবাদমাধ্যম কর্মীদের সামনে এলেন ৭০ বছর বয়সী জায়েদা। বললেন তিনি ‘কেবল জাহাঙ্গীরের না, সবার মা’।

গাজীপুর প্রতিনিধিগাজীপুরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2023, 04:12 PM
Updated : 6 May 2023, 04:12 PM

গাজীপুরে নানান ব্যবসায় যখন জাহাঙ্গীর আলমের সুসময় তখন তার মতো তার মা জায়েদা খাতুনও গরিব মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। বিপদে পড়া কাউকে কাউকে অটোরিকশাও কিনে দিয়েছেন। তবে তিনি কখনও ভোটে দাঁড়াবেন বিষয়টা কল্পনাতেও ছিল না স্থানীয়দের।

অথচ আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ভোট হতে যাচ্ছে, তাতে এখন আলোচিত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন জায়েদা খাতুন। সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল হওয়ার পর তার কর্মী সমর্থকরা এখন মায়ের পাশেই দাঁড়িয়েছেন।

শনিবার প্রথমবারের মতো সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে জায়েদা দাবি করেছেন, তার ছেলের প্রতি ‘অন্যায়’ করা হয়েছে। এ কারণেই তিনি ভোটে নেমেছেন। আর সেই ‘অন্যায়ের’ প্রতিবাদেই সবাই তার পাশে থাকবে এবং তিনি ভোটে জিতবেন।

জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করবেন। তবে মায়ের পক্ষে ভোটের প্রস্তুতিও শুরু করেছেন।

গাজীপুর সদরের ছয়দানা এলাকার বাসায় জাহাঙ্গীরের বাড়িতেই থাকেন তার মা। স্থানীয় সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে তিনি গেছেন মাঝেমধ্যে। তবে জনসম্মুখে প্রকাশ্যে সেভাবে আসেননি তিনি। এমনকি মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনও যাননি রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে।

আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগেই অন্য প্রার্থীরা নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরছেন। কিন্তু তাও করেননি জায়েদা। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পর গাজীপুরের ভোটে নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে এবং মাকে প্রার্থী করতে জাহাঙ্গীর মনোনয়ন কিনলেই শুরু হয় জায়েদাকে নিয়ে আলোচনা।

এখন পর্যন্ত অনেকের ধারণা, জাহাঙ্গীর যদি শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা ফিরে না পান, তাহলে তিনি মায়ের পক্ষে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন। তবে আওয়ামী লীগে অবস্থান হারানোর পর নেতাকর্মীদের একটি অংশ পক্ষত্যাগ করায় তিনি মায়ের পক্ষে কতটা সফল হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

এর মধ্যে শনিবার প্রথমবারের মতো সংবাদমাধ্যম কর্মীদের সামনে এলেন ৭০ বছর বয়সী জায়েদা। বললেন, তিনি ‘কেবল জাহাঙ্গীরের না, সবার মা’।

তার ছেলে ‘যড়যন্ত্রের শিকার’ এমন অভিযোগও করেন জায়েদা। বলেন, তার প্রতিবাদে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন। তার বিশ্বাস জনগণ তার পাশে আছে এবং ভোটে তিনিই জিতবেন।

এই নির্বাচনে প্রার্থী আছেন ৯ জন। সোমবারের মধ্যে ভোট থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ আছে। এরপরে বোঝা যাবে শেষ পর্যন্ত কাদের মধ্যে হবে লড়াই।

তবে মূল লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান এবং ‘বিএনপি পরিবারের’ সরকার শাহনূর ইসলাম রনি থাকছেন। জাহাঙ্গীর যদি উচ্চ আদলতে যান এবং তার আবেদন যদি গ্রহণ হয়, তাহলে তিনি নাকি তার মা ভোটের লড়াইয়ে থাকবেন; আর থাকলেও কতটা প্রভাব থাকবে, এ নিয়েই চলছে ভোটের আলোচনা।

‘আমার ছেলের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে”

প্রথমবারের মতো সংবাদমাধ্যম কর্মীদের সামনে মাকে নিয়ে আসেন জাহাঙ্গীরই। সেখানে জায়েদা বলেন, “নগরের ৫৭টা ওয়ার্ডের মানুষ আমাকে কতটা ভালোবাসে, তা আমি ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাই। আমি ছেলের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।”

জয়ের জন্য আত্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যদি সুষ্ঠু ভোট হয়, কারচুপি ও দুর্নীতি না হয়, তাহলে আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। ৫৭টি ওয়ার্ডের মানুষ আমার সঙ্গে আছে, থাকবে ইনশাল্লাহ।”

জাহাঙ্গীরের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার ছেলে নগরে বাসিন্দাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছিল। নগরের রাস্তাঘাটের অনেক উন্নয়ন করছে। কিন্তু কিছু মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ষড়যন্ত্র করে আমার ছেলেকে বসানো হইছে। আমার ছেলের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছি।”

Also Read: ‘বিদ্রোহী’ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ফের ব্যবস্থা: মির্জা আজম

Also Read: আপিল টিকল না, এখন আদালতে যাবেন জাহাঙ্গীর

Also Read: জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এবার সম্পদ গোপনের অভিযোগ

Also Read: জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা কি টিকবে?

২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে দলীয় প্রতীক নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে ২ লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোটে হারিয়ে দেন তিনি।

সেই নির্বাচনের পর থেকে রাজধানী লাগোয়া এই জনপদে জাহাঙ্গীরের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছিল। তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেটিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে মেয়রের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। তারপর বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।

জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরপরই ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সেই পদ আর ফিরে পাননি তিনি।

ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ। চার মাস যেতে না যেতেই ফের বিদ্রাহী নেতার বিরুদ্ধে আবার ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা এসেছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে।

জায়েদা খাতুন বলেন, “আমাদের মা-ছেলেকে জনগণ কেমন ভালোবাসে দেখার জন্য ভোটে দাঁড়িয়েছি। যদি নির্বাচিত হতে পারি, তাহলে রাস্তাসহ যে কাজগুলো পড়ে আছে সেগুলো শেষ করব।”

জায়েদার জীবন

জায়েদা প্রথমবারের মতো সংবাদমাধ্যম কর্মীদের মুখোমুখি আসার দিন তার বাড়িতে ভিড় জমে সাধারণ মানুষদেরও। তারা আসলে জাহাঙ্গীর সমর্থক।

সেখানে ছিলেন গাজীপুরের কানাইয়া এলাকার সালমা বেগম, যিনি এক সময় জায়েদার প্রতিবেশী ছিলেন। তার কাছ থেকে জাহাঙ্গীরের মায়ের সংসার জীবনের কিছু তথ্য পাওয়া গেল।

জায়েদার স্বামী মিজানুর রহমানের গ্রামের বাড়ি ছিল গাজীপুরের কালীগঞ্জের বান্দাখোলা এলাকায়। বিয়ের ১০ থেকে ১২ বছর পরে বড় মেয়ে জারমিন আক্তারকে নিয়ে চলে তারা চলে আসেন কালীগঞ্জের কানাইয়া এলাকায়। সেখানে এক খণ্ড জমি কিনে করেন বাড়ি। সেখানেই জাহাঙ্গীর ও ছোট ভাই আল আমিনের জন্ম।

ছেলেরা কিছু বড় হওয়ার পরে কানাইয়া থেকে তারা যান জায়েদার বড় ভাই শফিকুল আলমের বাসায়। সেখানে থেকেই ছাত্রজীবন শেষ করেন সন্তানরা।

সালমা বলেন, “স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম করে চলতে হয়েছে জায়দাকে। অনেক কষ্ট ও দুঃখকে জয় করেই আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন তিনি। আজ তার ছেলেরাও প্রতিষ্ঠিত।”

গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর বরখাস্ত

ব্যবসা হারিয়েছেন জাহাঙ্গীর, আজমতের আয় এখন বেশি

গাজীপুরে মায়ের জন্যও মনোনয়ন ফরম তুললেন জাহাঙ্গীর

জাহাঙ্গীর মেয়র হওয়ার আগে গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এর আগে নানান ব্যবসা ছিল। ব্যবসায় নেমেই আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়।

সালমা বেগম বলেন, “সন্তানদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে আসতে জায়দার অনেক ত্যাগ, ধৈর্য ও পরিশ্রম রয়েছে। এলাকাবাসীর নানা সমস্যার সময়ও সময়ই তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন।”

কানাইয়া এলাকায় জায়েদার আরেক প্রতিবেশী হাজেরা খাতুন ও সখিনা বেগম জানান, ছোটকাল থেকেই তারা দেখেছেন, ছেলের ভালো-মন্দ নিয়ে তিনি পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে এসেছেন।

হাজেরা বলেন, “আমরা সবসময় জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আছি। জাহাঙ্গীর থাকুক বা তার মা থাকুন, আমরা শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকব।“

ভোটের জন্য জায়দার বাজেট ৩০ লাখ

সাংবাদিকদের জাহাঙ্গীরের মা জানান, তার কাছে নগদ টাকা আছে ৩৫ লাখ। ব্যাংকে আছে আরও ৫০ হাজার। আর এই টাকার মধ্যে নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় দেখিয়েছেন ৩০ লাখ।

এর মধ্যে পোস্টার ছাপাবেন ৩ লাখ ৪২ হাজার টাকায়, ১০টি নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপনে ১০ হাজার করে, ক্যাম্পে কর্মীদের খরচ হবে ৯০ হাজার টাকা।

এছাড়া কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপনে ৫০ হাজার, কর্মীদের খরচসহ মোট ব্যয় উল্লেখ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ লাখ টাকা। প্রার্থীর যাতায়াত, ঘরোয়া বৈঠক, লিফলেট-পোস্টার এবং মাইকিংয়ে খরচ হবে বাকি টাকা।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হলফনামায় জানিয়েছেন, তিনি স্বশিক্ষিত। আয়ের উৎস ব্যবসা।

হলফনামায় দেখা গেছে, ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বন্ড, ঋণপত্র ও ‘অনারেবল টেক্সটাইল কম্পোজিট লিমিটেড’ নামে একটি পোশাক কারখানা থেকে বছরে আড়াই লাখ টাকা আয় করেন তিনি।

দেড় লাখ টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ১ লাখ ২০ হাজার টাকার আসবাব ও ৩০ তোলা স্বর্ণালংকার থাকার কথা উল্লেখ করেছেন হলফনামায়।

মাকে ‘নামিয়ে’ আদালতে তাকিয়ে জাহাঙ্গীর

সংবাদমাধ্যম কর্মীদের সামনে নিয়ে আসার মাধ্যমে মাকে কার্যত ভোটের মাঠে নামিয়েছেন জাহাঙ্গীর। তবে তিনি এখনও নিজের বিষয়ে আশা হারাচ্ছেন না।

একটি পোশাক কারখানার ১০১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের জামিনদার থাকায় রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পরে নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করে দিয়েছে।

জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি রোববার উচ্চ আদালতে যাব। আশা করি, আদালতের সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা ফিরে পাব।”