বরিশাল অঞ্চল থেকে ঢাকায় লঞ্চ চলাচল কমে গেছে, ফলে হাজার শ্রমিককে নতুন পেশা খুঁজতে হচ্ছে।
Published : 30 Apr 2023, 09:59 PM
পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে লঞ্চযাত্রী কমে যাবে, তা আঁচ করা যাচ্ছিল। কিন্তু তার প্রভাবে যে বেকার হওয়ার দশায় পড়তে হবে, এমনটা ভাবেননি হাজার লঞ্চ শ্রমিক।
নদীপথে লঞ্চে বরিশাল থেকে ঢাকায় ১৬৮ নটিক্যাল মাইল যেতে যেখানে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লেগে যায়; সেখানে সড়কপথে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে বাসগুলো প্রায় ১৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করছে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টায়।
ভাড়ার পার্থক্য আকাশ-পাতাল না হওয়ায় সময় বাঁচাতে লঞ্চের চেয়ে বাসের প্রতি দিনে দিনে আগ্রহী হয়ে উঠছে বরিশালের মতো পটুয়াখলী, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনাসহ দক্ষিণবঙ্গের নদীবেষ্টিত অধিকাংশ জেলার মানুষ।
স্বাভাবিকভাবেই সড়কপথে ‘উন্নয়নের’ আঘাত লেগেছে দশকের পর দশক ধরে যাত্রী পরিবহনে সেবা দিয়ে যাওয়া নৌপথের শত শত শ্রমিকের জীবনে। বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে তারা পেশা পরিবর্তন করছেন। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আর যাদের বয়স বেশি তারা বেকার হয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের নদীবন্দরগুলোর অন্যতম বরিশাল। সেখানকার নৌ-বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলছিলেন, “পদ্মা সেতু চালুর আগে বরিশাল-ঢাকা নৌ-পথে প্রতিদিন ৮/৯টি লঞ্চ চলাচল করত। এখন সেখানে চলে ২ থেকে ৩টি। বাকি লঞ্চ বন্ধ থাকে। তাই শ্রমিকদের বেকার থাকা ও বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শ্রমিকদের জন্য মালিকপক্ষের ভর্তুকি দিতে হবে।”
এ ঘটনা শুধু বরিশালের ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা নয়; বরং সারাদেশে লঞ্চ খাতের শ্রমিকদেরও একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের বরিশাল জেলা শাখার সহসভাপতি একিন আলী মাস্টার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা সেতু হওয়ার পর অনেক রুটের লঞ্চ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সারা দেশের লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে।
“বর্তমানে বরিশাল-ঢাকা রুটের লঞ্চের পাঁচ থেকে সাতশ শ্রমিক বেকার হওয়ার পথে রয়েছেন। তারা এখন বিকল্প কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছেন।“
নদীমাতৃক দেশের শত বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল বরিশাল নদীবন্দর। বরিশাল নগরী গড়ে উঠেছে এই নদীবন্দরকে কেন্দ্র করেই। হকার, কলারম্যান, দোকান-পাট, নদীবন্দরের কর্মচারী, নৌকার মাঝি, লঞ্চের যাত্রীতে শশব্যস্ত এই ঘাট ভাঙতে শুরু করে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পরই।
গত এক বছরেই বরিশাল নদীবন্দর তার জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে অনেকখানি। ঘাটের সেই পুরনো ব্যস্ততা এখন আর চোখে পড়ে না। লঞ্চগুলো জেটিতে বেকার বসে আছে। মানুষের কোলাহল থেমে গেছে অনেকটাই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, লঞ্চে মাস্টার, সুকানি, গ্রিজারম্যান, লস্কর, কেরানি, কলারম্যান, কেবিন বয়, টিকিট চেকারের চাকরি করে থাকেন শ্রমিকরা। একটা লঞ্চে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন।
বরিশাল-ঢাকা রুটের ‘এমভি পারাবত-১১’ লঞ্চের কর্মচারী মো. এনামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত এক বছরে পারাবত কোম্পানির লঞ্চের অন্তত ১০০ শ্রমিক স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তারা অন্য পেশায় চলে গেছেন।”
তিনি বলেন, “পারাবত-১১ লঞ্চে বর্তমানে কেবিন বয়ের প্রয়োজন ২২ জন। কিন্তু আছে মাত্র ১০ জন। যে টাকা তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, তাতে তাদের পোষায় না। তাই অন্যত্র চলে গেছেন।
“আগে বেতনের বাইরে সার্ভিস চার্জসহ বিভিন্নভাবে প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা আয় করত একজন শ্রমিক। কিন্তু এখন যাত্রী তেমন নেই। লঞ্চও ঠিকমতো চলে না। আগে লঞ্চ প্রতিদিন চলত। এখন মাসে পাঁচ দিনও চলে না। তাই কেবিন বয়রা পুষিয়ে নিতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে।”
পারাবত-১১ লঞ্চের কেরানি নিজাম উদ্দিন বলেন, “শনিবার লঞ্চটি ঘাটে আনা হয়। কিন্তু যাত্রী না থাকায় লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। যে কয়েকজন যাত্রী ছিলো, তাদের নিয়ে ঢাকা গেলে দুই থেকে তিন লাখ টাকা ক্ষতি হত।
“লঞ্চ না চললে শুধু বেতন দিয়ে চলা যায় না। একজন কেবিন বয় ৩ হাজার ৮০০ টাকা বেতন দিয়ে কীভাবে চলবে? তাই অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কেউ গ্রামে ফিরে গেছে, কেউ অন্য পেশায় গিয়েছে।”
সরকারের কাছে বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবি করেছেন কেরানি নিজাম উদ্দিন।
বরিশাল-ঢাকা রুটের ‘এমভি কীর্তনখোলা-১০’ লঞ্চের এক শ্রমিক বলেন, তাদের কোম্পানির ‘এমভি কীর্তনখোলা-২’ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওই লঞ্চের সব শ্রমিকরা চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
‘পদ্মা সেতু হলে লঞ্চে যাত্রী কমবে জানতাম, এত কমবে ভাবিনি’
৩ সেতুতে টোল দিয়ে ৪ ঘণ্টায় বরিশাল
এর মধ্যে কেউ কেউ বাসের শ্রমিক, চালকের সহকারী (হেলপার), সুপারভাইজার হয়েছেন। কেউবা ঢাকা, সাভারে তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছেন বলে জানান ওই শ্রমিক।
লঞ্চ ঘাটের কলারম্যান বাবুল শরীফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঘাটে দেড় শতাধিক কলারম্যান রয়েছে। তারা এখন শুধু লঞ্চ মালিকদের দেওয়া সামান্য পারিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করে চলছেন।
“প্রতিদিন দেড়শ টাকা করে পারিশ্রমিক পান তারা। যাত্রী বেশি হলে বাড়িয়ে দেয়। এ দিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়। অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছেন।”
অভ্যন্তরীণ রুটের লঞ্চের গ্রিজারম্যান মো. কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি ৩৫ বছর ধরে লঞ্চে চাকরি করছেন। এক সময় বরিশাল ঘাট থেকে অভ্যন্তরীণ অর্ধশতাধিক রুটে লঞ্চ চলাচল করত। এখন তিন-চারটি রুটে চলাচল করছে।
তিনি বলেন, “লঞ্চের মাস্টার, সুকানি ও গ্রিজারম্যান বাধ্য হয়ে অল্প বেতনে হলেও এ পেশায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে লস্কর পদের লোকজন মাটিকাটা, রাজমিস্ত্রির সহকারীসহ দিনমজুরের পেশায় চলে যাচ্ছেন।”
‘এমভি মানামী’ লঞ্চের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোভিডের সময় ও পদ্মা সেতু চালুর পর কিছু শ্রমিক চলে যায়। কিছু ছুটিতে গিয়েছিল। ঈদের সময় তারা আবার ফিরে এসেছে।”
তিনি বলেন, “লঞ্চ মালিকপক্ষ নিয়মিত বেতন দেয়। কিন্তু যাত্রী কম আসায় তাদের বাড়তি উপার্জন কমে যায়। তাই তাদের মন খারাপ হয়।”
নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের বরিশাল জেলার সহসভাপতি একিন আলী মাস্টার বলেন, আগে বরিশাল-ঢাকা রুটে প্রতিদিন ১৪টি লঞ্চ চলাচল করত। প্রতিদিন ঢাকা থেকে সাতটি এবং বরিশাল থেকে সাতটি দুই প্রান্তের উদ্দেশে ঘাট ছেড়ে যেত। এখন মাত্র চারটি লঞ্চ চলাচল করে। বাকি লঞ্চ বন্ধ থাকে। বন্ধের সময় শ্রমিকরা বেকার থাকে।
লঞ্চ শ্রমিকদের আগের মত বেতন এবং আয় নেই জানিয়ে একিন আলী বলেন, “আগে মালিকরা বেতন ভালো দিত। লঞ্চের কেবিন ভাড়া দিয়েও প্রতিদিন টাকা আয় হতো। এখন তো সেই আয় বন্ধ হয়ে গেছে। মালিকরাও আর বেতন দিতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা বিকল্প কর্মের সন্ধান করছে।”
ঈদে চাঁদপুর-বরিশাল রুটে চলাচলের জন্য একটি লঞ্চ এনেছিলেন একিন আলী মাস্টার। কিন্তু যাত্রীর অভাবে সেই লঞ্চ চলাচল করতে পারেনি।
নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশের বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি শেখ হাশেম আলী মাস্টার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর নৌ-পথ বিলুপ্তির পথে রয়েছে। অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে নৌযান।
তিনি বলেন, বরিশাল-ঢাকা রুটের ১৮টি লঞ্চ রয়েছে। ঈদ মৌসুমে কয়েকদিন ১০টি করে লঞ্চ চলাচল করছে। এরপর আবারও রোটেশন শুরু হবে। এতে একটি লঞ্চ মাসে দুই থেকে তিনটির বেশি ট্রিপ দিতে পারবে না।
শেখ হাসেম জানান, বরিশাল-ঢাকা রুটের প্রত্যেকটি লঞ্চে ৬০-৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন। বন্ধের সময় মাত্র ১০ জন করে দায়িত্বে থাকে। বাকিরা এ সময় ছুটিতে থাকবে। তখন তারা বেকার থাকবে।
তিনি বলেন, “লঞ্চ মালিকরাই তো তাদের ব্যয় উঠাতে পারবে না। তারা কীভাবে শ্রমিকদের বেতন দেবে? তাই শ্রমিকদের কর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।”
তিনি জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে প্রতিদিন আটটি করে লঞ্চ চলত। এখন দুটি করে চলে। একইভাবে ঢাকা-আমতলী রুটে দুটির স্থলে একটি, ঢাকা-বরগুনা রুটের আটটির মধ্যে একটি চলছে। ঢাকা-তুষখালী রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ঢাকা ও মেহেন্দিগঞ্জের পাতারহাট এবং ঢাকা-ভাষানচর রুটের দুটি লঞ্চের স্থলে এখন একটি করে চলাচল করছে। ঢাকা-হুলারহাট এবং ঢাকা-ভাণ্ডারিয়া রুটের চারটির স্থলে একটি করে চলছে।
ঢাকা-পয়সারহাট, ঢাকা-মীরগঞ্জ এবং ঢাকা-কালাইয়া রুটে দুটির স্থানে একটি করে লঞ্চ চলছে। ঢাকা-রাঙ্গাবালী ও ঘোষের হাট রুটে তিনটির স্থলে একটি করে লঞ্চ চলছে।
বরিশাল নৌ-বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, শ্রমিকরা বেকার হচ্ছেন। অনেকে পেশা ছাড়ছেন। এক্ষেত্রে তাদের সহায়তার জন্য বিআইডব্লিউটিএ করণীয় কিছু থাকলে তা করা হবে।