তবে যারা বরিশাল থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে প্রথমদিন রোববার ঢাকা আসছেন তাদের ১৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে আরও কম লাগছে বলে জানিয়েছেন। কারণ, যাওয়ার পথে সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজায় যানবাহনের চাপ থাকায় সময় একটু বেশি লাগছে।
সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকার সায়দাবাদ থেকে যাত্রী নিয়ে প্রথম বরিশালের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পৌঁছেছেন ইলিশ পরিবহনের বাসচালক এনামুল হক। তিনি সায়দাবাদ থেকে বেরিয়ে বাবুবাজার সেতু পার হয়েছেন। এই সেতুতে কোনো টোল দিতে হয়নি। কিন্তু যেসব বাস পোস্তাগোলা হয়ে বুড়িগঙ্গা সেতু পাড়ি দিচ্ছে সেখানে টোল দিতে হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।
এনামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টায় পৌঁছেছি। মনে হয়, সময় একটু বেশি লাগছে। সামনে কম লাগবে।
“কারণ, সেতুর কাছে ছোট ছোট গাড়ি, থ্রি-হুইলার আর দর্শনার্থীদের প্রচুর ভিড়। এ কারণে সেতু পার হতে সময় লেগেছে। আস্তে আস্তে এসব ঝামেলা থাকবে না। তখন আরও কম সময়ের মধ্যে পৌঁছানো যাবে।”
ঢাকা থেকে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যেই নথুল্লাহবাদে বাস নিয়ে পৌঁছেছেন সাকুর পরিবহনের সুপারভাইজার নাসির উদ্দিন।
তিনি বলেন, “প্রথম দিন হওয়ায় সেতুর টোল প্লাজায় ব্যাপক যানজট। দেড় ঘণ্টার মতো টোল ঘরের সামনে কাটাতে হয়েছে। তাই একটু দেরি হয়েছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।“
বরিশালের হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক রানা তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা সেতুর পূর্বে আড়িয়াল খাঁ সেতুতে ১৩৫ টাকা, পদ্মায় দুই হাজার টাকা ও ধলেশ্বরী সেতুতে ১৬০ টাকা টোল দিতে হয়েছে।”
“আগে ফেরিতে এই বাসের জন্য টোল দিতে হতো এক হাজার ৮৮৫ টাকা। এখনও প্রায় একই লাগছে। তবে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে এখনও টোল দিতে হচ্ছে না। পরে হয়তো লাগতে পারে। তখন বলা যাবে মোট কত টাকা টোল লাগছে গাড়িপ্রতি।”
সময়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে যাত্রী সাইফুল ইসলাম বলেন, “আগে তো সবকিছু ফেরির ওপর নির্ভর করতো। ফেরি ঘাটে কত সময় লাগছে সেটাই ছিল বড় বিষয়। তার পরেও ছয় থেকে সাত ঘণ্টার আগে ঢাকায় পৌঁছানো যেত না। এখন তো চার ঘণ্টার মধ্যেই যাওয়া-আসা করা যাবে বলে মনে হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগে যেখানে ফেরি ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অকারণে যানবাহনগুলো দাঁড়িয়ে থাকত, এখন নিমিষেই পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে। দুর্ভোগ নেই, সময়ের অপচয় নেই।”
সকাল ৮টায় সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে আসা সাকুরা পরিবহনের একটি গাড়িতে বেলা সাড়ে ১২টায় নথুল্লাহবাদ এসে পৌঁছেছেন স্কুলশিক্ষিকা সুরুচি বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু ও নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য কতটা উপভোগ্য তা বোঝানোর ভাষা নেই। এ সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ। তার দৃঢ়তার জন্য আমরা এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছি।“
বাংলাদেশের নদীবন্দরগুলোর অন্যতম বরিশাল। সেখান থেকে ঢাকায় লঞ্চে যাতায়াত করেন অনেক যাত্রী। লঞ্চভেদে সাধারণ ডেকের ভাড়া আড়াইশ থেকে ৩০০ টাকা। লঞ্চের ভাড়া কম হলেও যাতায়াতে সময় অনেক বেশি লাগে। ঢাকা-বরিশালে নদীপথে যাতায়াতে প্রায় নয় থেকে ১০ ঘণ্টা লেগে যায়।
ফলে যাত্রীদের অনেকেই বাসে চলাচল করেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় তাদের সেই সময় আরও কমে আসবে বলেই ধারণা করা হচ্ছিল। তবে সেতু পার হওয়ার পর রাস্তার প্রশস্তকরণের কাজ না হলে সুফল মিলবে না বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন।
সুগন্ধা পরিবহনের বরিশালের কাউন্টারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, “চার লেনের রাস্তা না হলে পদ্মা সেতুর সুফল বেশি মিলবে না। ফরিদপুরের ভাঙ্গার পর থেকে সড়ক সরু। এ কারণে একটু সময় বেশি লাগে। তা নাহলে তিন ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-বরিশাল আসা-যাওয়া করা যেত।”
মিজান পরিবহনের কাউন্টারের ব্যবস্থাপক মিলন বলেন, তাদের চারটি বাস সকালে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। প্রথম বাসটি তিন ঘণ্টায় সায়েদাবাদ পৌঁছেছে বলে দাবি করেন তিনি।
মিলন আরও বলেন, তার বন্ধু মামুন পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার মতিন খন্দকার সকালে প্রাইভেট কার নিয়ে ঢাকারে উদ্দেশে রওনা দিয়ে তিনি ঘণ্টায় সায়েদাবাদ পৌঁছেছেন।
নথুল্লাহবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও বিআরটিসির বরিশাল ডিপো ঘুরে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৫টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে অর্ধশত বাস ছেড়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, “ঢাকায় যাত্রী নামিয়ে দিয়ে একটি বাস বরিশালের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। বাসটি দেড়টার সময় ফরিদপুরের ভাঙ্গা পার হয়েছে।”
বেসরকারি মালিকানাধীন পরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাস ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে সাকুরা পরিবহনের। নথুল্লাহবাদ টার্মিনাল থেকে সকাল সাড়ে ৫টা থেকে আধা ঘণ্টা পর পর তাদের বাস পরিপূর্ণ যাত্রী নিয়ে ছেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কাউন্টার ব্যবস্থাপক আনিসুর রহমান।
হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক সালাম জানান, তাদের তিনটি বাস ছেড়ে গেছে। ৪১ সিটের প্রতিটি বাসে ৩৬ থেকে ৩৭ জন যাত্রী ছিলো।
বেপারী পরিবহনের মিরাজ বলেন, তাদের তিনটি বাস ছেড়ে গেছে। সবগুলোতেই যাত্রী পরিপূর্ণ ছিল।
ঈগল পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক সোহেল জানান, পদ্মা সেতু দেখার জন্যই অনেক যাত্রী ঢাকায় যাচ্ছেন। এ কারণে যাত্রীদের ভিড় রয়েছে। তাদের ৪০ আসনের একটি বাস পরিপূর্ণ যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।
বিআরটিসি বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফারুকুল আলম।
বানারীপাড়া উপজেলার বাসিন্দা সুমনা আফরিন বলেন, “চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যাচ্ছি। আরও আগে যাওয়ার কথা ছিল। পদ্মা সেতু দিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। আজ অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে।”
ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন গৃহিনী লাকী বেগম। তিনি বরিশাল থেকে পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকা যাওয়ার জন্য দুইদিন অপেক্ষা করেছেন। রোববার বেলা ১১টায় বিআরটিসি বাসে ঢাকায় রওনা হয়েছেন।
নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের কাউন্টারগুলোতে যাত্রীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই জানালেন, শুধু পদ্মা সেতু দেখতেই তারা ঢাকা যাচ্ছেন।