“৫-৬ জনের সংসার, আসলামের উপার্জনেই চলত। সে মারা গেল। গরিব মানুষ, এখন এই সংসার কেমনে চলবে?”
Published : 13 Dec 2023, 09:26 PM
গাজীপুরে রেললাইন কেটে নাশকতার ঘটনায় নিহত ট্রেনযাত্রী আসলাম মিয়ার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তার উপার্জনেই চলত ছয় সদস্যের পরিবারটি। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে পরিবারটি অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে।
বুধবার বিকালে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার সালটিয়া ইউনিয়নের রৌহা গ্রামে আসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার স্ত্রী ও বৃদ্ধ মা কান্নাকাটি করছেন। প্রতিবেশীরা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আসলামের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন দুই পাশে দুই ছেলে-মেয়ে বসেছিলেন। তারাও কাঁছিলেন। সবার ছোট ছেলেটি মায়ের কোলেই বসেছিল। তার কোনো অভিব্যক্তি ছিল না। সে বুঝতেও পারছে না তার বাবা আর নেই। সে শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
ফাতেমা আহাজারি করে বলছিলেন, “দুই ছেলে, এক মেয়ে, ওদের বাবা তো ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেল। এখন সন্তানদের কী হবে? আমার কিছুই নাই, আমার স্বামীই সম্বল।
“আমার স্বামী নির্দোষ গো, আমার স্বামীর তো কোনো দোষ করছে না, তাহলে কেন এভাবে তার মৃত্যু হল? আমি এই সরকারের কাছে এর বিচার চাই।”
মেয়েটি কেঁদে কেঁদে বলছিল, “আমার আব্বারে কে মারল। আমি একটু আব্বারে দেখব। আমি আব্বার মুখটা একটু দেখব। আমার আব্বা কই গেল। আমি এখন কারে আব্বা ডাকব।”
গাজীপুরের ভাওয়াল ও রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকায় রেললাইন কেটে ফেলায় ভোর ৪টার দিকে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ট্রেনযাত্রী আসলাম মিয়া নিহত ও লোকো মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
ঘটনার পর পরই ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর সেই রেললাইন ট্রেন চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
এ ঘটনাকে নাশকতা হিসেবে উল্লেখ করে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, দুর্বৃত্তরা অক্সি-অ্যাসিটিলিন গ্যাস ব্যবহার করে রেললাইন কেটেছে।
গফরগাঁওয়ের রৌহা গ্রামের মৃত মোছলেম উদ্দিন ও হোসনা খাতুনের ছেলে আসলাম মিয়া পেশায় ছিলেন সবজি ব্যবসায়ী। তিনি গ্রাম থেকে সবজি নিয়ে ঢাকায় আসতেন। সবজি বিক্রি করে আবার বাড়ি ফিরে যেতেন। তার আয়েই পরিবার চলত।
রেললাইন কাটা হয় অক্সি-অ্যাসিটিলিন দিয়ে: ডিআইজি নুরুল
গাজীপুরে রেলে নাশকতা: ১৪ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচলের উপযোগী
‘দেখি ট্রেনের বগি কাত, কোনো রকমে জীবনটা নিয়ে বের হই’
গাজীপুরে রেললাইন কেটে ফেলায় বগি লাইনচ্যুত, এক জন নিহত
গাজীপুরে দুর্ঘটনা: বিকল্প পথে চলছে ট্রেন, ৩টির যাত্রা বাতিল
গাজীপুরে ছয়শ ফুট রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত, বসছে নতুন পাত
ত্রিশোর্ধ্ব আসলামের দুই ছেলে শুভ (১১) ও আবু রায়হান (২) এবং এক মেয়ে আরিফা (৮)।
বাদ মাগরিব রৌহা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে আসলাম মিয়ার দাফন সম্পন্ন হয়। তার আগে স্থানীয় মাঠে তার জানাজা হয়। সেখানে পরিবারের আত্মীয়-স্বজনরা ছাড়াও গ্রামের শত শত মানুষ অংশ নেয়।
বিকালে আসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িভরতি লোকজন। কেউ আত্মীয়, কেউ আবার প্রতিবেশী। উঠানের দুই পাশে দুটি টিনের ঘর। একটি চৌচালা, একটি চালা ঘর। চৌচালা ঘরেই পরিবার নিয়ে থাকতেন আসলাম।
শালটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল হক বলেন, “প্রায় প্রতিদিনই কাঁচামাল নিয়ে ট্রেনে যাতায়াত করতেন আসলাম। মঙ্গলবার রাতেও তিনি সবজি নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে। পরিবারটি অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে।”
বাড়ির উঠানে বসে বিলাপ করছিলেন আসলামের মা হোছনা খাতুন। বলছিলেন, “আমার বাবা লাশ হয়ে গেছে। আমার বাবাকে কেন মারল, যারা মারল আমি তাদের বিচার চাই।”
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া আসলামের ছেলে শুভ মিয়া বলে, “যাদের জন্য ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বাবা মারা গেছে তাদের বিচার চাই।”
প্রতিবেশী জলিল মোল্লা বলেন, “৫-৬ জনের সংসার, আসলামের উপার্জনেই চলত। সে মারা গেল। গরিব মানুষ, এখন এই সংসার কেমনে চলবে?
“আসলামের পরিবারের জন্য সরকারের কাছে সহায়তা চাই এবং যারা এই ঘটনায় দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”