এক সময়ের স্বচ্ছল পরিবারটি বাড়ি ফেরে পুরোপুরি শূন্য হাতে। বাড়িতে এসে দেখে, তাদের কিছুই নেই।
Published : 16 Dec 2024, 01:34 AM
হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়লে নৌকা থেকে সবাই বিলের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে। তখন মায়ের কোলে থাকা ৯ দিনের ছোটবোনটি কাদায় পড়ে যায়। কিন্তু আতঙ্কে তাকে সেখানে ফেলে রেখেই সরে পড়তে হয় অন্যদের।
পাকিস্তানি বাহিনী চলে গেলে মুমূর্ষ অবস্থায় শিশুটিকে খুঁজে বের করা হয়, প্রাণে বেঁচে গেলেও অনীশ মণ্ডলের বোনটি আজও সুস্থ হননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী হিসাবে যাত্রাপথের সেই ভয়াবহতার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন বরিশাল নগরীর অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অনীশ মণ্ডল।
১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। সে সময় তাকে পরিবারের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ‘একাত্তর: শৈশবের শরণার্থী’ নামের একটি বইয়েও কষ্টকর সেসব স্মৃতি তিনি লিখেছেন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাওয়ার পর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা। প্রাণ বাঁচাতে বিভিন্ন পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে লাখো মানুষ।
অনীশ মণ্ডলদের একান্নবর্তী পরিবার তখন থাকত খুলনার ডুমুরিয়া ঘোনা গ্রামে। তার বাবা অশোক মণ্ডল ছিলেন খুলনা সেন্ট জোসেফ স্কুলের শিক্ষক।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের কথা স্মরণ করে অনীশ মণ্ডল বলেন, যেখানে এখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল গল্লামারী রেডিও স্টেশন। সে বছরের ২৮ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা খুলনায় প্রবেশ করে সেই রেডিও স্টেশনে ঘাঁটি গড়ে। পরে ওই রেডিও স্টেশনকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বধ্যভূমিতে পরিণত করে হানাদাররা।
যুদ্ধের শুরুর দিকেই ওই ঘাঁটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। নবম সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম এ জলিল এ আক্রমণের দায়িত্ব দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সুবেদার মেজর ও বাগেরহাটের চিতলমারীর বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন মানিক মিয়াকে।
আর সমগ্র আক্রমণ সমন্বয়ের দায়িত্ব পান কামরুজ্জামান টুকু। পরে ৪ এপ্রিল গল্লামারী বেতার কেন্দ্র দখল নিতে আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু সেদিন তারা সফল হতে পারেননি।
অনীশ মণ্ডল বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাকিস্তানি বাহিনী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারা তখন আশপাশের গ্রামগুলোতে হানা দিতে শুরু করে। খুলনা শহর ও তার আশপাশের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় নির্বিচারে হত্যা, তাদের ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগের খবর আসতে শুরু করে।
আর গল্লামারী বেতার কেন্দ্রের পশ্চিম দিকেই ছিল ডুমুরিয়া ঘোনা গ্রাম। তাই সেখানেও আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনী।
এর মধ্যে খুলনা ও আশপাশের অনেক হিন্দু পরিবার তাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয় বলে জানান অনীশ।
বৈশাখ মাসের শেষদিকে কিছু লোক বাড়িতে হামলা চালিয়ে গরু ও হাঁস লুট করে নেয়।
আরও বেশি লুটেরাদের দল আক্রমণের ভয়ে দুপুরের মধ্যে বাড়ি ছাড়ে সবাই। পরে খিচিমিছি নদী পেরিয়ে পাশের ধানিবুনিয়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন সবাই।
ধানবুনিয়া গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে চলা সালতা নদী দিয়ে এগোলে কাঁঠালতলা বা চুকনগর বাজার। সেখান থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার হাঁটা পথ গেলে হাকিমপুর সীমান্ত। ইছামতি নদী পার হলেই ভারত।
অনীশ স্মৃতিচারণ করেন, এর মধ্যে শুনতে পান পাকস্তানিরা ব্যাপক লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তার শিক্ষক অনন্ত বিশ্বাস, শিশু পুত্র ও খেলার সাথীকে হত্যা করা হয়েছে।
তখন নৌকা ভাড়া করে দেশত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। নৌকায় কাঁঠালতলা নামক এলাকায় এসে পৌঁছান তারা। সেখান থেকে ভারতীয় সীমানা ২৮ কিলোমিটারের মত।
সেসময় পাকিস্তানি বাহিনীর মুখে পড়ার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েন অনীশদের পরিবার।
সেই বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “কাটাখালী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী পার হওয়ার সময় হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হই আমরা।
“তখন সবাই নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়ে বিলের মধ্যে আশ্রয় নেন। কিন্তু মায়ের কোলে থাকা ৯ দিন বয়সী ছোট বোন কনিকা কাদা-পানিতে পড়ে যায়। কিন্তু আর্মিদের গোলাগুলির মুখে বোনকে সেখানে ফেলে রেখেই আমাদের সরে পড়তে হয়।”
“গোলাগুলি থেমে গেলে ও পাকিস্তানি বাহিনী চলে গেলে খুঁজতে খুঁজতে এসে বোনকে বিলের মধ্যে পাই। সে বেঁচে ছিল কিন্তু মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এরপর থেকে আর সে সুস্থ হয়নি।”
অনীশ মণ্ডল বলেন, “পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ দিশেহারা হয়ে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করি। কিন্তু ডুমুরিয়ার পালপাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় আবার আক্রান্ত হই। কোনোভাবে শরণার্থী দলটি দৌড়ে চুকনগর বাজার পার হয়।”
চুকনগর বাজারটি শরণার্থীদের জন্য একটা ট্রানজিট পয়েন্ট ছিল জানিয়ে অনীশ বলেন, শরণার্থীরা সেখানে এসে জড়ো হয়। পরে সেখান থেকে ভারতের সীমান্তের দিকে যেত। ভোমরা বর্ডারের ইছামতি নদী পার হয়েই ভারত।
পরে নৌকায় করে ইছামতি নদী পার হওয়ার সময়ও সবার মধ্যে চরম একটা আতঙ্ক ছিল। এই বুঝি পাকিস্তানি সেনারা এসে পড়ছে।
সেই ভয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ফের বিপদে পড়ে অনীশদের পরিবার। তিনি বলেন, ইছামতি পাড়ি দেওয়ার সময় সবাই এত আতঙ্কে ছিল যে একসঙ্গে অনেকে নৌকায় উঠে পড়ে। পরে মাঝ নদীতে গিয়ে সেই নৌকাটি ডুবে যায়।
“তখনও মা নয়দিনের ছোট বোনকে হাতের উপর নিয়ে স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলেন। পরে অন্যরা তাদের টেনে উপরে তোলে।”
তবে তড়িঘড়ি করে ইছামতি নদী পার হওয়ায় তারা বেঁচে যান। কারণ তারা পার হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকটি জিপ গাড়ি চলে আসে। পারাপারের অপেক্ষায় থাকা বেশ কয়েকজনকে তারা গাড়িতে উঠিয়ে নেয়।
অনীশ বলেন, “তখন আমার নানা, নানার ভাই, এক মামা সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা স্বর্ণালংকারসহ যা ছিল সব দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত-পা ধরতে থাকে। শেষে নারীদের নামিয়ে দিয়ে যায়।”
ছোট নদী হওয়ায় পাড়ে দাঁড়িয়ে সেসব দৃশ্য দেখার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে যে যেভাবে পারে পৌঁছেন ভারতের মছলন্দপুর। তার পাশের চণ্ডিপুর এলাকায় বিশাল একটা মাঠ, সেখানে শরণার্থী শিবির করা হয়েছে।
সেই শিবিরের এক তাঁবুর মধ্যেই শরণার্থী জীবনের শুরু হয় অনীশ মণ্ডলদের। সেসব দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, সানকিতে খিচুড়ি দেওয়া হত তাদের। প্রতিদিন সকালে ও বিকালে মাটির সানকি নিয়ে তারা লাইনে দাঁড়াতেন সেই খাবারের জন্য।
এখনকার মত ভারত ওই সময় এত উন্নত ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, “শরণার্থী শিবিরে অব্যবস্থাপনায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রতিদিন শিশু ও বয়স্করা মারা যেত। প্রতিটি তাঁবুতে কলেরা আর ভেদবমিতে মানুষ মারা যেতে থাকল। ইউনেস্কোর হিসাবে শরণার্থী শিবিরে পাঁচ লাখ শিশু মারা গেছে।
“কলেরা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে কলেরা। আমাদের অনেক খেলার সাথী কলেরায় মারা গেছে।”
অনীশ মণ্ডল বলেন, “শরণার্থী শিবিরের সেই জীবনেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই। রোগ-ব্যাধি গা সওয়া হয়ে যায়। এক সময় কলেরা-আমাশয় কমে গিয়ে শুরু হলো চোখ ওঠা রোগ। সবাই রোগটির নাম দিল ‘জয় বাংলা রোগ’।”
সেসময় প্রবাসী সরকারে থাকা সালাউদ্দিন ইউসুফ তাদের দেখতে গিয়েছিলেন। তখন সবার দাবি ছিল, দ্রুত দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা। কারণ শরণার্থী শিবিরে যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছিল, সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।
ওই পরিস্থিতি অনীশের বাবা তাদের নিয়ে ক্যাম্পের বাইরে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন।
স্থানীয় লোকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অনীশ বলেন, শরণার্থীদের কারণে তারা অনেক দুর্ভোগ সহ্য করেছেন। মাঠ, বাড়ির পাশের জঙ্গলে তারা প্রাকৃতিক কাজ সেরছেন। তাদের কাছে বিষয়টি অসহ্য হলেও করার কিছু ছিল না।
অনীশ বলেন, “আমরা একটা অমানবিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে ছিলাম। আমরা যারা বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছি। এটা আমাদের বড় সৌভাগ্য।”
সেসময় জীবন স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “সিদ্ধান্ত হলো যুবকরা যুদ্ধে যাবে আর শিশুরা স্কুলে যাবে। তাই শরণার্থী শিবিরে শিশুদের জন্য হাকিমপুর-মছলন্দপুর রাস্তার পাশে স্থানীয়দের সহায়তায় স্কুল করা হয়েছিল। কিন্তু স্কুলে লেখাপড়ার কোনো তাড়া ছিল না। কারণ কোনো বই-খাতা ছিল না।”
অনীশ বলেন, শরণার্থী জীবনে কোনো ছন্দ ছিল না। তাই ছন্দ পতনের প্রশ্ন আসে না। তার মধ্যেও চণ্ডিপুরের রিফিউজি ক্যাম্পের পাশে চাতরায় নট্ট কোম্পানির যাত্রাপালা দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাবা। ত্রাণের পাওয়া ইংলিশ প্যান্ট পড়ে সেই যাত্রাপালা দেখতে যাওয়া ছিল তখনকার জীবনের নতুন ঘটনা।
পাশের রামচন্দ্রপুর রিফিউজি ক্যাম্পে থাকতেন অনিশের মামারা। বাবার সঙ্গে তিনি সেখানেও গিয়েছিলেন।
বড় একটি আমবাগানের কাছে ক্যাম্পটি বাঁশ, পলিথিন ও চাটাই দিয়ে তৈরি। ছোট ছোট ঘরে পরিবারগুলো গাদাগাদি হয়ে থাকত। আশপাশের পরিবেশ ছিল মল-মুত্রের দুর্গন্ধে ভরা। শুধু মাছি ভনভন করত।
সেই ক্যাম্পের দুগ্ধপোষ্য শিশুদের বাঁচাতে দুধ দেওয়া হত। মায়েরা শিশুদের কোলে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য হুড়োহুড়ি লাগত। সেখানে দুইদিন কাটিয়ে চণ্ডিপুর রিফিউজি ক্যাম্পে ফিরে আসেন অনীশরা।
তবে জীবন তো থেমে থাকে না; ক্যাম্পের জীবনেই অনীশের এক দিদির বিয়ে হয়। ভারত সরকারের চাকরিজীবী ভগ্নিপতি এক সময় বাংলাদেশের বাসিন্দা ছিলেন।
শরণার্থী শিবিরে সাড়ে সাত মাস ছিলেন অনীশরা। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলেও টাকার অভাবে তখনি ফিরতে পারেননি। পরে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তারা দেশে ফিরে আসেন।
অনীশ বলেন, “অনেকে আগেও ফিরে এসেছে। কিন্তু আমাদের ফিরে আসার মত আর্থিক অবস্থা না থাকায় শরণার্থী হাই কমিশনের পক্ষ থেকে দেওয়া ট্রাকে করে দেশে ফিরে আসি। সেই ট্রাকের সিরিয়াল পেতে পেতে জানুয়ারি প্রথম সপ্তাহ লেগে যায়।”
ফেরার যাত্রার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “ট্রাকে আমাদের বনগাঁ রেল স্টেশনে দিয়ে যায়। সেখান থেকে ট্রেনে করে খুলনা স্টেশনে নামি। সেখানে লঞ্চের ব্যবস্থা করে সরকার। সেই লঞ্চে পাশের গ্রাম ধানিবুনিয়াতে এসে নামি। সেখান থেকে তিন চার ঘণ্টা হেঁটে বাড়ি ফিরি।”
এক সময়ের স্বচ্ছল পরিবারটি বাড়ি ফেরে পুরোপুরি শূন্য হাতে। বাড়িতে এসে দেখে, তাদের কিছুই নেই।
তিনি বলেন, “ফিরে দেখি শূন্য ভিটা। সন্ধ্যার দিকে এসে পৌঁছানোর পর দাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসা আটা দিয়ে পাতায় আগুন দিয়ে কয়েকটা রুটি বানালো। ওই রাতে সেই রুটি খেয়ে কাটিয়েছি।”
অনীশ জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এত অভাব দেখা দেয়, যে গ্রামের মানুষ কচু শাক, বিভিন্ন পাতা সেদ্ধ করে খেত। তার ছোট চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি কিছু চাল সংগ্রহ করেছিলেন। ওই চাল দিয়ে ফেন-ভাত খেয়ে তারা কাটিয়েছেন।
বাবার স্কুলের চাকরির বেতনের টাকায় কোনো রকম প্রাণে বেঁচে ছিলেন জানিয়ে অনীশ বলেন, “এভাবে ৭৪ সাল পর্যন্ত কাটিয়েছেন। ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের আঁচ আমরাও পেয়েছিলাম। আমাদের দুবেলা ভাত জুটত না।”