“খামারিরা প্রথম প্রথম বাক্স নিয়ে এলে আমরা ভাবতাম মৌমাছি ফুলে বসলে ফসলের ক্ষতি হবে। পরে দেখি ক্ষতি হয় না; ফসল আরও ভালো হয়”, বলেন এক কৃষক।
Published : 21 Mar 2025, 04:22 PM
শরীয়তপুর জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে কালোজিরার আবাদ হয়েছে। আর কালোজিরার ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য জমির পাশে বসানো হয়েছে মৌ-বাক্স। মধু সংগ্রহের পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন বাড়ায় খুশি কৃষক ও মৌয়াল।
উদ্যোক্তারা বলছেন, চলতি মৌসুমে মৌ-খামারি ও কৃষি অধিদপ্তরের সমন্বয় ঘটানো গেলে এ জেলা থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মধু আহরণ করা সম্ভব।
এ ছাড়া ফসলের উৎপাদন বাড়াতে মৌয়ালদের জমির পাশে বসতে দিয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার কথা বলেছেন শরীয়তপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোস্তফা কামাল হোসেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলার ছয়টি উপজেলায় কম-বেশি কালোজিরা চাষ হয়। আর কালোজিরার ফুলকে কেন্দ্র করে জমিগুলোর পাশে বসানো হয়েছে মৌ-বাক্স। ফুলের পাপড়ি থেকে মধু সংগ্রহ করছে মৌমাছি। আর চাষিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন পরিচর্যা ও মধু আহরণে।
চলতি মৌসুমে কালোজিরার মধু আহরণের জন্য দুই হাজার ১০টি মৌ-বাক্স বসানো হয়েছে। এখান থেকে মধু উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে নয় হাজার ৬৫০ কেজি। মধু আহরণের পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়ায় খুশি খামারিরা।
জাজিরা উপজেলার মুলনা ইউনিয়নে ঘুরে দেখা গেছে, অন্তত আটটি স্থানে কালোজিরার মধু আহরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া জেলার সেনেরচড়, বড় গোপালপুর, পালেরচর, জয়নগর, বিলাশপুর, নড়িয়ার চাকধ এলাকায় আছে মৌয়ালদের বিচরণ।
মধু আহরণের জন্য এসব জায়গায় এসে আস্তানা গেঁড়েছেন সাতক্ষীরা, মাগুরা, খুলনা, সিলেট, শেরপুর, দিনাজপুর, নাটোরসহ বিভিন্ন এলাকার খামারিরা।
জাজিরার কয়েকটি মৌ-খামারে গিয়ে দেখা যায়, কালোজিরা ক্ষেতের পাশে সারি সারি মৌ-বাক্স বসানো হয়েছে। শ্রমিক মৌমাছি মধু আহরণ করে বাক্সগুলোর ছিদ্রপথ দিয়ে ঢুকছে জমা করার জন্য। জমা করে আবার বের হয়ে যাচ্ছে মধু সংগ্রহ করতে। বিরামহীনভাবে চালছে তাদের এ কর্মযজ্ঞ। মৌচাষিরাও ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে বাক্সগুলোর দেখাশোনা করছেন। প্রত্যেকটি খামারে ১৫০টি থেকে ২০০টি মৌ-বাক্স আছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা থেকে জাজিরার টি অ্যান্ড টি এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন খামারি তরুণ কুমার মণ্ডল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন জেলা ঘুরে মধু সংগ্রহ করে আসছেন তিনি। কালোজিরার মৌসুমে শরীয়তপুরে ঘাঁটি গাড়েন তিনি। অন্য ফুলের মধুর চেয়ে কালোজিরার মধুর দাম ভালো হওয়ায় খুশি এই চাষি।
তরুণ কুমার বলেন, “শরীয়তপুর কালোজিরার জন্য বিখ্যাত। এখানে অনেক ভালো মধু পাওয়া যায়। প্রতি মৌসুমে এখানে মধু সংগ্রহ করতে আসি। এ বছর তিনজন এসেছি। আমি ১৫০টি বাক্স বসিয়েছি। যা থেকে প্রতিদিন অন্তত ১০ কেজি করে মধু পাই।
“বর্তমান বাজারে এ মধুর চাহিদা অনেক বেশি। ক্রেতাদের মধু দিতে হিমশিম খাই। এ মধু পাইকারিতে হাজার টাকা কেজি বিক্রি হয়। এতে আমরা অনেক লাভবান হই।”
ফরিদপুর থেকে মধু সংগ্রহ করতে আসা শাহাবুল ইসলাম শিহাব বলেন, “এ অঞ্চলে কালোজিরা চাষ বেশি হওয়ায় বেশি মধু পাওয়া যায়। অন্য মধুর চাইতে কালোজিরার মধু উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে পারি। তাই প্রতি মৌসুমে এ জেলার বিভিন্ন ক্ষেতে মৌ-বাক্স স্থাপন করি।”
কালোজিরার মধু সংগ্রহ শেষ হলে লিচু ফুলের মধু সংগ্রহ করতে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হবেন বলে জানান এই মৌ-চাষি।
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মৌমাছির আনাগোনা বেশি হওয়ায় ফলন ভালো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষক আব্দুল হামিদ খান।
তিনি বলেন, “২০ বছর আগে এভাবে বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করতে দেখিনি। খামারিরা প্রথম প্রথম বাক্স নিয়ে এলে আমরা ভাবতাম মৌমাছি ফুলে বসলে ফসলের ক্ষতি হবে। পরে দেখি আমাদের ক্ষতি হয় না। ফসল আরও ভালো হয়। তাই খামারিরা এলে তাদের নিরাপদে বসার ব্যবস্থা করে দেই।”
মধু আহরণকারী প্রতিষ্ঠান হাজকা এগ্রো ফার্মের মালিক শাহিদুল ইসলাম বলেন, শেরপুরের কালোজিরার মধুকে জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কৃষি বিভাগ ও খামারিদের সমন্বয় ঘটানো গেলে, এবার এ জেলা থেকে অন্তত ১০০ কোটি টাকায় মধু উৎপাদন সম্ভব।
তিনি বলেন, “কালোজিরার মধুতে বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। এ জন্য চিকিৎসকরা এ মধু খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। এখানকার মধুর গুণগত মান ভালো হওয়ায় বিদেশেও পাঠানো সম্ভব।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, “কালোজিরা থেকে বেশ ভালো মধু আহরণ হয়। সেইসঙ্গে আমরা ফসলের উৎপাদন বাড়াতে মৌয়ালদের ফসলি জমির পাশে বসতে দিয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করি।”