রুমায় গলিত লাশ, পুলিশের ধারণা ‘দুদিন আগে গোলাগুলিতে নিহত’

গত মঙ্গলবার মুয়ালপি পাড়ায় সাড়ে ১০ ঘণ্টাব্যাপী দুপক্ষের গোলাগুলি হয়; ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক ও কেএনএফের মধ্যে গোলাগুলির কথা পুলিশ বললেও ওইদিন হতাহতের খবর দিতে পারেনি।

উসিথোয়াই মারমাবান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2023, 07:05 PM
Updated : 27 April 2023, 07:05 PM

বান্দরবানের রুমার দুর্গম মুয়ালপি পাড়ায় একটি অর্ধগলিত লাশ পাওয়া গেছে, দুদিন আগে গোলাগুলিতে যার মৃত্যু হয় বলে ধারণা করছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে পাইন্দু ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়ার পাশে মাটি খুঁড়ে লাশটি উদ্ধার করা হয় বলে রুমা থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান।

মৃত বমরামসাং বম রোয়াংছড়ি উপজেলার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পাইক্ষ্যং পাড়ার বাসিন্দা।

গত মঙ্গলবার ভোর ৪টা থেকে থেমে থেমে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত মুয়ালপি পাড়ায় দুপক্ষের গোলাগুলি হয়েছে।

ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক ও কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনার কথা পুলিশ জানতে পারার কথা বললেও কোনো হতাহতের খবর দিতে পারেনি।

বৃহস্পতিবার রুমা থানার ওসি আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মুয়ালপি পাড়ায় মঙ্গলবার কেএনএফের সঙ্গে অন্য একটি সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মারা যেতে পারেন তিনি। মুয়ালপি পাড়ার পাশে মাটিচাপা দেওয়া একটি কবরের মতো দেখতে পায় স্থানীয়রা।

খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মাটি খুঁড়ে লাশটি উদ্ধার করা হয় বলে ওসি জানান।

তিনি বলেন, “মৃতদেহটি পাহাড়ি তাঁতে বোনা চাদর দিয়ে জড়ানো ছিল। তিনি নির্দিষ্ট কোন সংগঠনের সদস্য জানি না। তবে একটা ‘পাহাড়ি দলের’ কর্মী। শরীর অর্ধগলিত হওয়ায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে কিনা জানা যায়নি।”

লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য বান্দরবান সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

‘৫০ পরিবার’ মারমা মুয়ালপি পাড়ায় ফিরেছে

ওসি আলমগীর হোসেন বিডিনিউ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কয়েক দিন আগে পালিয়ে আসা মারমা সম্প্রদায়ের ৫০ পরিবার বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে মুয়ালপি পাড়ায় ফিরেছে। পরিস্থিতি আপাতত শান্ত রয়েছে। পালিয়ে আসা লোকজন নিরাপদ মনে করে তারা নিজেদের ঘরে ফিরেছে।

“কিন্তু বম সম্প্রদায়ের লোকজন এখন পাড়ায় নেই। তারা অন্য কোনো বম পাড়ার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে।”

মুয়ালপি পাড়াবাসীরা জানিয়েছিল, ১৭ এপ্রিল পাড়ার দুই মারমা যুবককে ধরে নিয়ে মারধর ও নির্যাতন চালায় কেএনএফ সদস্যরা। পাড়াবাসীর অনুরোধে ওইদিন রাতে ছেড়ে দিলেও পরের দিন সকালে আবারও ধরে নিয়ে যায় তারা। পরে ভয়ে পাড়া ছেড়ে পালিয়ে এসে রুমা সদরে মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে আশ্রয় নেন মারমা সম্প্রদায়ের ৫০টি পরিবার।

পালিয়ে আসা মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন তখন জানিয়েছিল পাড়ার বম সম্প্রদায়ের লোকজনও অন্য কোথাও চলে গেছে। তবে ঠিক কোথায় চলে গেছে তা বলতে পারেননি।

যোগাযোগ করা হলে রুমার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য অংসাপ্রু মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মুয়ালপি পাড়া ছেড়ে পালিয়ে আসা মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন বৃহস্পতিবার আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই। কিন্তু সব পরিবার এখনও পাড়ায় যায়নি।

“কিছু পরিবার আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে রুমা সদরে আত্মীয়-স্বজনের ঘরে উঠেছে। তারা আরও কয়েকদিন পর পাড়ায় ফিরবে বলে শুনেছি।”

তবে বম সম্প্রদায়ের লোকজন পাড়া ছেড়ে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে বলা যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “মাঝে মাঝে জঙ্গলে পালিয়ে যায় তারা। শিশু ও বয়স্ক নিয়ে জঙ্গলে বড়জোর একরাত দুইরাত থাকতে পারে। এভাবে দিনের পর দিন থাকা সম্ভব না। ধারণা করা হচ্ছে, আশপাশে কোনো বম পাড়ার আত্মীয়-স্বজনের ঘরে গিয়ে উঠতে পারে।”

বৃহস্পতিবার মুয়ালপি পাড়া থেকে ঘুরে এসে রুমার স্থানীয় সাংবাদিক চনুমং মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন দুপুরে দুটি জিপে করে মুয়ালপি পাড়ায় এসে পৌঁছেছে। তারা যার যার ঘরে উঠেছে। তবে ঠিক কতজন চলে আসছে জানা যায়নি।

মুয়ালপি পাড়ায় বসবাস ৮০টি বম, ৫০টি মারমা পরিবারের

রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের দুর্গম মুয়ালপি পাড়ায় রয়েছে বম সম্প্রদায়ের ৮০ পরিবার ও মারমা সম্প্রদায়ের ৫০ পরিবার। মারমা পরিবারের অংশ পড়েছে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে এবং বম সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো পড়েছে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। তবে দুই সম্প্রদায়ের লোকজন একটি পাড়া (মুয়ালপি পাড়া) নামে বসবাস করে আসছে দীর্ঘদিন।

গত বছরের অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কেএনএফ [স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’নামে পরিচিত] এবং নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া’র বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ও র‌্যাব। কখনও কখনও তাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে।

এর জের ধরে জানুয়ারির শেষে রুমার কয়েকটি পাড়া থেকে মারমা ও বম জাতিগোষ্ঠীর লোকজন গহীন পাহাড়ের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে শহরে চলে আসেন। সে সময় পাইন্দু ইউনিয়নের অন্তত ৫১টি মারমা ও ২০টি বম পরিবার সবকিছু ফেলে রুমা বাজারের মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হল রুমে এবং বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেয়। চার-পাঁচদিন পরে তারা আবার পাড়ায় ফিরে যায়।

মার্চের শুরুর দিকে অভিযানের মধ্যে ‘আতঙ্কে’ রুমা ও আশপাশের এলাকা থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। অন্তত ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সে সময় বন্ধ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন:

Also Read: পাহাড়ের সেই মুয়ালপি পাড়ায় দিনভর গোলাগুলি

Also Read: পুড়েছে বাগান, লুট হয়েছে ঘর; শঙ্কা মাথায় পাড়ায় ফিরছেন সেই পাহাড়িরা

Also Read: কেএনএফের ভয়ে এবার পাড়া ছাড়ল ৪৯ মারমা পরিবার

Also Read: বান্দরবানে ৮ খুন: নেপথ্যে কী?

Also Read: বান্দরবানে ৮ হত্যাকাণ্ডের পর বাড়ি ছেড়েছে আরও প্রায় ৩০০ পাড়াবাসী

Also Read: বান্দরবানে গোলাগুলিতে নিহত ৮ জনই বম জনগোষ্ঠীর