বান্দরবানের রুমা উপজেলার মুয়ালপি পাড়ায় ভোর থেকে দুটি সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মোয়ালপি পাড়া থেকে আতঙ্কের মধ্যে ৪৯টি মারমা পরিবার বাড়ি ছেড়ে আসার পাঁচদিনের মাথায় এই গোলাগুলির ঘটনা ঘটল। এখন বম সম্প্রদায়ের মানুষও পাড়া ছেড়ে গেছে।
রুমা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই মনির হোসেন মঙ্গলবার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোর ৪টা থেকে মুয়ালপি পাড়ায় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক ও কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে বলে জানতে পেরেছি।
“থেমে থেমে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এই গোলাগুলি হয়েছে। এরপর আর গোলাগুলি শোনা যায়নি। মনে হয়, আপাতত বন্ধ আছে।“
এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি বলে জানান ওসি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মোয়ালপি পাড়ায় মূলত মারমা ও বম সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। এখানে ৫০টির মতো মারমা পরিবার এবং ৮০টির মতো বম পরিবার বাসবাস করে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি এই গ্রামে পৌঁছাতে হেঁটে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে।
বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে এই পাড়া থেকে ৪৯টি মারমা পরিবার বাড়ি থেকে এসে রুমা উপজেলা সদরে মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে আশ্রয় নেয়।
তখন পাড়াবাসী জানিয়েছিলেন, তাদের পাড়া থেকে দুজনকে কেএনএফ (যা স্থানীয়দের কাছে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত) ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতন করে। পরে পাড়াবাসীর অনুরোধে ছেড়ে দেওয়া হলেও ১৮ এপ্রিল আবার ধরে নিয়ে যায়।
এ নিয়ে ১৯ এপ্রিল রুমা বাজারে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হলে মুয়ালপি পাড়াবাসীদের প্রাণনাশে হুমকি দিতে থাকে। ঘরে ঘরে ঢুকে দরজায় আঘাত করে। ভয়ে সবাই পালিয়ে যায়।
এর মধ্যে সেখানে দুই সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটল।
পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লা মং মারমা বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, “আমিও গোলাগুলির ঘটনা শুনেছি। তবে সেখানে তো অনেকেই আছে। কাদের কাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে সেটা জানি না।
“পাহাড় বাসিন্দাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাচ্ছি। হয়তো তারা পাড়া থেকে চলে গেছে। কোথায় গেছে আমি তাও জানি না।”
পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অং সা প্রু মারমা সাংবাদিকদের বলেন, “গোলাগুলির ঘটনার আগেই পাড়া থেকে মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন চলে গিয়েছিলেন। এখন বম সম্প্রদায়ের লোকজনও চলে গেছে। পাড়া খালি হয়ে গেছে, কেউই নেই। বম সম্প্রদায়েরর লোকজন কোথায় গেছে এখনও জানতে পারিনি।”
গত ৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার মাঝামাঝি পাইন্দু ইউনিয়নের খামতাং পাড়া থেকে আটজনের লাশ উদ্ধারের পর কয়েক দিনে খামতাং পাড়া, মুয়ালপি পাড়া, পাইক্ষ্যং পাড়া, ক্যপ্লং পাড়া থেকে আটশর বেশি মারমা, বম, খিয়াং সম্প্রদায়ের মানুষ পাড়া ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। তারা এসে রুমা ও রোয়াংছড়ি সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেন। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও উঠেন।
পাড়াবাসী বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর তাদের অনেকের বাগান পুড়িয়ে দেওয়া হয়, বাড়িঘর ভেঙে মালামাল লুট করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন খিয়াংরা।
ঈদের আগ থেকে অনেকেই পুলিশ ও প্রশাসনের আশ্বাস পেয়ে আতঙ্ক ও শঙ্কা মাথায় নিয়েই পাড়ায় ফিরতে শুরু করেন। তার মধ্যে আবার গোলাগুলির ঘটনা পাড়াবাসীর মনে ভয়ের সৃষ্টি করেছে।
গত বছরের অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কেএনএফ, স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’নামে পরিচিত, এবং নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া’র বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ও র্যাব। কখনও কখনও তাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে।
এর জের ধরে জানুয়ারির শেষে রুমার কয়েকটি পাড়া থেকে মারমা ও বম জাতিগোষ্ঠীর লোকজন গহীন পাহাড়ের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে শহরে চলে আসেন। সেসময় পাইন্দু ইউনিয়নের অন্তত ৫১টি মারমা ও ২০টি বম পরিবার সবকিছু ফেলে রুমা বাজারের মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হল রুমে এবং বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেয়। চার-পাঁচদিন পরে তারা আবার পাড়ায় ফিরে যায়।
মার্চের শুরুর দিকে অভিযানের মধ্যে ‘আতঙ্কে’ রুমা ও আশপাশের এলাকা থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। অন্তত ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সে সময় বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: