র্যাব বলছে, কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সাথে ২০২১ সালে জামাতুল আনসারের আমীরের সমঝোতা হয়।
Published : 21 Oct 2022, 01:57 PM
বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর পাহাড়ের সশস্ত্র দল ‘কেএনএফ’ বা বম পার্টির সঙ্গে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র চুক্তির খবর সামনে আনল র্যাব।
এই এলিট বাহিনী বলছে, কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সাথে ২০২১ সালে জামাতুল আনসারের আমিরের সমঝোতা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফ’র ছত্রছায়ায় জামাতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে জামাতুল আনসার।
গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে তিন পাহাড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ তথ্য মিলেছে বলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার মুখপাত্র খন্দকার আল মঈনের ভাষ্য।
শুক্রবার বান্দরবান র্যাব ক্যাম্পে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, নতুন ওই জঙ্গি দলের যে সদস্যদের এর আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ছত্রছায়ায়’ প্রশিক্ষণ এবং সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের তথ্য তারা পেয়েছিলেন।
এর ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাতে রাঙামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাজার এলাকায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার নেতৃত্বে র্যাব-৭ ও র্যাব-১৫ অভিযান চালায়। সেই অভিযানে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তাররা হলেন– সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মৃত সৈয়দ আবুল কালামের ছেলে সৈয়দ মারুফ আহমদ ওরফে মানিক (৩১), পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার মো. শাহ আলমের ছেলে ইমরান হোসাইন ওরফে শাওন (৩১), ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মৃত গোলাম কিবরিয়ার ছেলে কাওসার ওরফে শিশির (৪৬), সিলেটের বিয়ানীবাজারের ফজলুল হকের ছেলে জাহাঙ্গীর আহম্মেদ ওরফে জনু (২৭), বরিশালের মুলাদির নয়ন মৃধার ছেলে ইব্রাহিম ওরফে আলী (১৯), সিলেটের গোলাপগঞ্জের আতিকুল আলমের ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে বাপ্পি (২৩), সুনামগঞ্জের ছাতকের আব্দুস সালামের ছেলে রুফু মিয়া (২৬)।
এছাড়া বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার লাল মুন সয় বমের ছেলে জৌথান স্যাং বম (১৯), লাল মিন সম বমের ছেলে স্টিফেন বম (১৯) এবং জিক বিল বমের ছেলে মাল সম বমকেও (২০) গ্রেপ্তার করার কথা জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, গ্রেপ্তারদের মধ্যে পাহাড়ের তিনজন কেএনএফ’র সামরিক শাখা কেএনএ’র সদস্য বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। আর বাকিরা জঙ্গি দল জামাতুল আনসারের কর্মী।
তাদের কাছ থেকে ৯টি বন্দুক, ৫০ রাউন্ড বন্দুকের গুলি, ৬২টি কেইস কার্তুজ, ৬টি হাত বোমা, ২টি কার্তুজ বেল্ট, ১টি দেশীয় পিস্তল, বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র, ওয়াকিটকি, মানচিত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধারের হিসাব দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে।
অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য কিংবা জঙ্গি বা সন্ত্রাসীর হতাহত হওয়ার ঘটনা আছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে র্যাব মুখপাত্র মঈন বলেন, “গহীন দুর্গম পাহাড়ে অভিযান চালাতে হচ্ছে; গড়ে আড়াই হাজার ফুটের উপর পাহাড়ে অভিযান চালানো হচ্ছে।
“তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে এ অভিযান চালানো হচ্ছে; অভিযানের মুখে তারা আত্মগোপনে চলে গেছে। তবে তাদের কেউ আহত কিংবা নিহত হয়েছে কি না- এরকম কোনো তথ্য এখনও পর্যন্ত আসেনি।”
বৃহস্পতিবারের অভিযানের মধ্যে কেএনএফ’র একটি ক্যাম্পও ছিল বলে জানান তিনি।
র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে থাকা জামাতুল আনসারের সদস্য সংখ্যা ৫০ এর বেশি। সংগঠনটির আমিরের নাম মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। উগ্রবাদী এ সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্য রয়েছেন।
“তারা অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গোপনে পরিচালনার জন্য বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকাকে বেছে নেয়। এজন্য তারা স্থানীয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তা গ্রহণ করে। তারা পার্বত্য অঞ্চলের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হতে তাদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করত। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করত।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গ্রেপ্তার মারুফ আহমেদ ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও কিবরিয়া হত্যা মামলার আসামি হাফেজ নাঈমের আপন ছোট ভাই। তিনি সিলেট অঞ্চলে জামাতুল আনসারের প্রচার শাখার প্রধান এবং সামরিক শাখার দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি।
আর ইমরান হোসাইন শাওন মূলত বরিশাল অঞ্চলের কোমলমতি তরুণদের খুঁজে বের করে তাদেরকে জামাতুল আনসারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের মাধ্যমে ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিরুদ্দেশ হতে উৎসাহ দিতেন। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তরুণদের ‘মোটিভেশন’ দিতেন।
গ্রেপ্তার জাহাঙ্গীর বিভিন্ন মাধ্যমে সংগঠনের জন্য উত্তোলিত অর্থ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিকট পৌঁছে দিতেন। নিরুদ্দেশ তরুণদের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংগঠন থেকে তাকে একটি মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া হয়েছিল।
কেএনএফ’র সামরিক শাখা কেএনএ’র সদস্য জৌথান স্যাং বম, স্টিফেন বম ও মাল সম বম জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব বলছে, গ্রেপ্তার জামাতুল আনসার সদস্যরা দেড় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন আছেন। তাদের কেউ কেউ নিকটাত্মীয়, কেউ বন্ধু, কেউ স্থানীয় ব্যক্তি/পরিচিতজনদের মাধ্যমে উগ্রবাদী এ সংগঠনে জড়িত হয়।
তাদেরকে সংগঠনের তরফে শারীরিক প্রশিক্ষণ ও তাত্ত্বিক জ্ঞান দেওয়ার জন্য পটুয়াখালী, ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জ্যেষ্ঠ সদস্যদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ‘সেইফ হাউজে’ রাখা হতো। পরবর্তীতে প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ তরুণদেরকে বান্দরবানের দুর্গম পার্বত্য এলাকায় পরবর্তী ধাপের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হতো। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হত।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া কয়েকজন তরুণের বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়ে সম্প্রতি ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন এক জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় র্যাব।
এ বাহিনী বলছে, উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে গত দুই বছরে বাড়ি ছাড়া ৫৫ তরুণের খোঁজ তারা পেয়েছে, তাদের মধ্যে ৩৮ জনের একটি তালিকাও তারা প্রকাশ করেছে।
দুই দফায় ওই দলের ১২ জনকে গ্রেপ্তারের পর গত ১০ অক্টোবর র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি অংশ পৃষ্ঠপোষকতা করছে। সেখানে তাদের প্রশিক্ষণও চলছে।
র্যাব ওই সংগঠনের নাম সে সময় বলেনি। পাহাড়ে ‘কেএনএফ’ বা বম পার্টি নামে কোনো সশস্ত্র দলের অস্তিত্বের বিষয়েও সরকারের কোনো বক্তব্য তখনও আসেনি।
পরে ১৬ অক্টোবর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন,কেএনএফ বা বম পার্টির সঙ্গে নতুন জঙ্গি সংগঠনের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জুম্ম জাতীয়তাবাদী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) গঠিত জনসংহতি সমিতি ভেঙে তৈরি হওয়া কয়েকটি দল বহু বছর ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয়। তার মধ্যেই কেএনএফের সক্রিয় হয়ে ওঠার খবর গত কিছুদিন ধরে আসছিল।
পাহাড়িরা কেএনএফ সংগঠনটিকে ‘বম পার্টি’ নামে চেনে। নিজেদের তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর জনজাতিগুলোর ‘প্রতিনিধিত্বকারী’ হিসেবে তুলে ধরে।
এ সংগঠন ‘কুকি-চিন রাজ্যে’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চায়; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না; থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা।
নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগের’ তথ্য সামনে আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বিত অভিযান শুরু করার কথা জানায় র্যাব; যার অংশ হিসেবে দুর্গম এলাকায় প্রচারপত্র বিলি, মাইকিংও শুরু হয়।
জঙ্গিদের অবস্থানের তথ্য প্রদানকারীকে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় ওই লিফলেট। পাশাপাশি জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় সেখানে।
প্রচারপত্রে ‘জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকদের’ তাদের হেফাজতে থাকা জঙ্গিদের শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তরের আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়, “তা না হলে আশ্রয় প্রদানকারীদের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।”
পুরনো খবর
৭ জঙ্গির সঙ্গে এবার ৩ পাহাড়িও গ্রেপ্তার: র্যাব
জঙ্গিদের সঙ্গে বম পার্টির যোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
নতুন জঙ্গি দল: পাহাড়ে অভিযান, তথ্য দিলে লাখ টাকা পুরস্কার
নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগ’ পেয়েছে র্যাব
জঙ্গি আর পাহাড়ি দলের মিলে যাওয়ার বিপদ যেখানে
র্যাবের জালে নতুন জঙ্গি দল, কারা এরা?
নিখোঁজ ‘৫৫ জন’ নতুন জঙ্গি দলে, ৩৮ জনের তালিকা দিল র্যাব
জঙ্গি নেতারা সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন: ফিরে আসা নিলয়
নিখোঁজ ৪ তরুণসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানাল নতুন জঙ্গি দলের নাম