“পূজার ছুটিতে দিনে অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার পর্যটক সাজেক ভ্রমণ করতো। অথচ এখন অনেক পর্যটক বুকিং বাতিল করছে।”
Published : 05 Oct 2024, 11:00 AM
সারাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাম্প্রতিক সহিংসতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে খাগড়াছড়ির পর্যটন খাত। এখানে সারাবছর পর্যটকে মুখরিত থাকলেও চিরচেনা সেই দৃশ্য যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।
খাগড়াছড়িতে চোর সন্দেহে পিটুনিতে এক বাঙালি যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে যে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তার রেশ এখনও কাটেনি। উত্তেজনা কিছুটা ‘কমে’ এলেও এক ধরনের চাপা আতঙ্ক আর ভয় ঘিরে আছে পাহাড়ে; যার প্রভাব পড়েছে পর্যটন খাতেও।
১৯ সেপ্টেম্বরের পর থেকে খাগড়াছড়িতে পর্যটক আসেনি। শারদীয় দুর্গাপূজা ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে তিনদিনের ছুটি থাকলেও হোটেল-মোটেলগুলোতে বুকিং নেই। পর্যটক না থাকায় রুমগুলো ‘ফাঁকা’ পড়ে আছে। অলস সময় কাটাচ্ছেন পর্যটকবাহী জিপ গাড়ির চালকরা।
রেস্তোরাঁগুলোতে নেই বেচা-বিক্রি। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন এলাকা ভ্রমণে দর্শনার্থীদের নিরুৎসাহিত করার পর আগাম বুকিংও বাতিল করেছেন অনেক পর্যটক।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোটেল মালিকদের দৈনিক ক্ষতি অন্তত ২৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ। সবমিলিয়ে গত দুই সপ্তাহে ১০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পর্যটন খাতে অচলাবস্থা কাটার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, “পাহাড়ে সহিংসতার পর ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে কোনো পর্যটক আসেনি। সামনে সাপ্তাহিক আর পূজার ছুটি মিলিয়ে তিন দিনের বন্ধ ছিল। এ সময় পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকে মুখর থাকার কথা ছিল।
“অথচ আমাদের হোটেলসহ অন্যান্য আবাসিক হোটেলে কোনো কক্ষ বরাদ্দ হয়নি। অর্থাৎ এই অবস্থায় কোনো পর্যটক আসবে না।”
তিনি বলেন, “খাগড়াছড়ি পর্যটন শিল্প অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত। এখানে পর্যটনের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক, কৃষিখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পর্যটক সমাগম বাড়লে পাহাড়ে উৎপাদিত ফলসহ কৃষি পণ্যের চাহিদাও বাড়ে। অথচ এখন বিপরীত চিত্র।”
‘গাইরিং’ নামের একটি হোটেলের স্বত্বাধিকারীও বিকাশ। খাগড়াছড়ি জেলা সদরে আবাসিক হোটেলের সংখ্যা প্রায় ৩৫। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল সমিতির অন্তর্ভুক্ত ২৫টি রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
তার ভাষ্য, “পর্যটক না থাকায় হোটেল মালিকদের দৈনিক ক্ষতি অন্তত ২৫ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এরইমধ্যে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
চলতি বছর জুলাই মাসজুড়ে চলা ছাত্র আন্দোলন, অগাস্টে সরকার পতনকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই মাস পাহাড়ে পর্যটনে ভাটা পড়েুছিল। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় পাহাড়ে পর্যটক সমাগমও বাড়ছিল। এরই মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মামুন হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
এর জেরে দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে আগুন দেয় হামলাকারীরা। সেখানে পাহাড়ি ও বাঙালিদের শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে। সেদিন রাতে গুলিতে খাগড়াছড়িতে তিনজন নিহত হন। খাগড়াছড়িতে সামপ্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়ে রাঙামাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।
সহিংসতা ও হামলার প্রতিবাদে ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনের অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ি ও সাজেকে পর্যটকরা আটকা পড়ে। ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে সাজেকে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এতে খাগড়াছড়িও প্রায় পর্যটক শুন্য হয়ে পড়ে। মূলত সেই থেকে খাগড়াছড়ির পর্যটনে খরা শুরু হয়।
এছাড়া ধর্ষণের অভিযোগে মঙ্গলবার শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় খাগড়াছড়িতে নতুন করে সহিংসতা হয়েছে। এতে মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক বেড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির প্রধান পর্যটন কেন্দ্র আলুটিলা, রিসাং ঝরনা, জেলা পরিষদ পার্কসহ কোনো কেন্দ্রেই কোনো পর্যটক নেই। আলুটিলা সবসময় পর্যটকে ঠাসা থাকলেও এখন সেখানে ‘সুনসান নিরবতা’।
আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা কোকোনাথ ত্রিপুরা বলছিলেন, “স্বাভাবিক সময়ে আলুটিলায় ৫০০ থেকে ৬০০ দর্শনার্থী আসে। ছুটির দিনে প্রায় এক হাজারের বেশি দর্শনার্থী আছে। অথচ এখন কেউ নেই।”
পর্যটন কেন্দ্রটির গেটম্যান রতন ত্রিপুরা বলেন, “সাজেকে পর্যটক ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে তার প্রভাব এখানেও পড়েছে। সরকারি রাজ্স্ব আদায় প্রায় শূন্যের কোটায়"
আলুটিলা কফি হাউস অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক মো. মামুন বলেন, “আমাদের বেহাল অবস্থা। কোনো পর্যটক নেই। সামনে পূজার বন্ধ। টানা তিন দিনের বন্ধ ছিল। কিন্ত এখন যা অস্থিরতা সেটা না কাটলে পর্যটক সমাগম হবে বলে মনে হয় না। আমাদের প্রতিদিনই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।"
চলতি বছর জুলাই মাসজুড়ে চলা ছাত্র আন্দোলন, অগাস্টে সরকার পতনকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই মাস পাহাড়ে পর্যটনে ভাটা পড়েছিল। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় পাহাড়ে পর্যটক সমাগম বাড়ছিল। এরই মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয় রাঙামাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।
সহিংসতা ও হামলার প্রতিবাদে ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনের অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ি ও সাজেকে পর্যটকরা আটকে পড়ে। ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে সাজেকে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এতে খাগড়াছড়িও প্রায় পর্যটক শুন্য হয়ে পড়ে। মূলত সেই থেকে খাগড়াছড়ির পর্যটনে খরা শুরু হয়।
এছাড়া ধর্ষণের অভিযোগে খাগড়াছড়ি সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সিভিল কন্সট্রাকশন অ্যান্ড সেফটি বিভাগের ইন্সট্রাকটর আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানাকে মঙ্গলবার পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জেলায় নতুন করে সহিংসতা হয়েছে। সঙ্গে মানুষের ভয় ও আতঙ্কও বেড়েছে।
খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি স্বপন দেবনাথ বলেন, “পাহাড়ের বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে খাগড়াছড়ি পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে। এখানে দীর্ঘ সময় পর্যটক নির্ভর ব্যবসা চলছে। আমরা দ্রুত শান্তিপূর্ণ একটা পরিবেশ প্রত্যাশা করি। ইতোমধ্যে পর্যটন ও পরিবহন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
খাগড়াছড়ি পর্যটন মোটেলের ইউনিট ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার মজুমদার বলছিলেন, “আয় না থাকায় কর্মীদের বেতন দিতে পারছি না। আগাম বুকিং বাতিল করেছে অনেকে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
“চলমান অস্থিরতা কেটে গেলে আবারও এ খাত চাঙা হবে বলে আশা করি।”
এদিকে সাজেকে পর্যটন কেন্দ্রের পরিস্থিতি আরও নাজুক। ১৯ সেপ্টেম্বরের পর সেখানেও কোনো পর্যটক ভ্রমণ করেনি। সাজেকে ১২০টি হোটেল, রির্সোট ও কটেজ রয়েছে। এছাড়ার ৪০টির বেশি রেস্তোরাঁ থাকলেও নেই কোনো বিক্রি। ফলে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন সাজেকের ব্যবসায়ীরা।
পূজার ছুটি উপলক্ষে পাওয়া অগ্রীম বুকিংয়ের টাকা রিফান্ড করতে হচ্ছে বলে জানালেন ‘মেঘপল্লী রির্সোটের’ স্বত্বাধিকারী শাহ আলম।
তিনি বলেন, “আমাদের কটেজে ছুটির দিন ছাড়াও রুম বুকিং থাকত। দুই সপ্তাহে আমাদের ক্ষতি প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। পূজার ছুটিতে দিনে অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার পর্যটক সাজেক ভ্রমণ করতো। কয়েক দিনে সাজেক পর্যটন কেন্দ্রে কয়েক কোটি টাকা আয় হতো।
“অথচ দেখেন, এখন অনেক পর্যটক বুকিং বাতিল করছে। তাদের বুকিং মানিও ফেরত দিতে হচ্ছে।”
সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুপর্ণ দেব বর্মণ বলেন, “আমাদের যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা বলে বোঝানোর মতো না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তিন দিন করে নয় দিনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখন তা অনিদিষ্টকালের জন্য নিরুৎসাহিত করা হল।”
চলমান অবস্থার কারণে পর্যটন খাতে ক্ষতির কথা জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামানও স্বীকার করেছেন। অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে হয়েছে।
তিনি বলেন, “স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আমরা সমন্বয় করছি। নতুন করে যাতে কোনো সহিংসতা না হয়, সেজন্য উপজেলাগুলোতেও সম্প্রীতি সভা করেছি। মানুষের মনে যে ভীতি ও আতঙ্ক রয়েছে তা দূর করার চেষ্টা করছি। পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করতে পারে তেমন একটা পরিবেশ আমরা তৈরি করছি।”
আরও পড়ুন
খাগড়াছড়িতে দুপক্ষের সংঘর্ষ থেকে দোকানে অগ্নিসংযোগ
খাগড়াছড়িতে মামুন হত্যা: সাবেক মেয়র-চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা
থমথমে রাঙামাটি-দীঘিনালা, শান্তি ফেরানোর আহ্বান
দীঘিনালায় অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের ঘটনায় মামলা, আসামি অজ্ঞাত
খাগড়াছড়িতে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা, থমথমে পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা
শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা: খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত কমিটি,
খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে যা বলল বিটিআরসি