“তারা নাকি একটি ভোট পেলেও চেয়ারম্যান হবেন; সাধারণ ভোটারদের মাঝে এমন অপপ্রচার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”
Published : 03 May 2024, 10:19 AM
আওয়ামী লীগের দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ও লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে এবং মন্ত্রীর ছোট ভাই কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
চাচা-ভাতিজার জমজমাট লড়াই দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন এই উপজেলার ভোটাররাও। তারা বলছেন, এবার উপজেলা নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
২১ মে দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন মঙ্গলবার সাবেক মন্ত্রীর ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ এবং নুরুজ্জামানের ভাই বর্তমানের চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামান আহমেদ দুজনের কেউই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি।
নুরুজ্জামান আহমেদ লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই তার ভাই মাহবুবুজ্জামান আহমেদ টানা ১০ বছর কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
পাশাপাশি তিনি লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলার তুষভাণ্ডার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মাহবুবুজ্জামান আহমেদের স্ত্রী উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী সাজেদা জামান প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন।
কিন্তু সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদ তার ভাইয়ের স্ত্রীকে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে নুর ইসলাম নামের আরেক প্রার্থীকে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন বলে অভিযোগ করেন মাহবুবুজ্জামানের পরিবার। এ থেকেই পরিবারিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়।
এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামানের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল হকের পক্ষে অবস্থান নেন মাহবুবুজ্জামান। ওই সময় ভোটের মাঠে ভাইয়ের বিরুদ্ধে একের পর এক বিস্ফোরক বক্তব্য দিয়ে ঝড় তুলেন তিনি।
বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামানের সঙ্গে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী হতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তার ভাতিজা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুজ্জামান আহমেদ।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর ২৩ এপ্রিল বাছাইয়ের দিন জেলা শহরের একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলনে করেন মাহবুবুজ্জামান। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, রাকিবুজ্জামান হলফনামায় কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন রেখেছেন।
একই সঙ্গে উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কাও করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তার পারিবারিক দ্বন্দ্বের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার বড় ভাই লালমনিরহাট-২ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। আমি তার বিপক্ষে আরেক প্রার্থী সিরাজুল হকের পক্ষে কাজ করি।
“ওই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী দুটিই আমাদের। আপনাদের যাকে ভালো লাগে, তার পক্ষ হয়ে কাজ করেন। আমি সেটি করেছি। তারা চায় না আমি কখনোই ভালো থাকি। এ জন্যই সব সময় তারা আমার পিছে লেগেই আছে।”
মাহবুবুজ্জামান আরও বলেন, “গত জাতীয় নির্বাচনে নুরুজ্জামান আহমেদ তার হলফনামায় পুত্রের সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। আর উপজেলা নির্বাচনে তার পুত্র প্রার্থী হওয়ায় সেও সম্পদের তথ্য গোপন করে হলফনামা জমা দিয়েছেন।”
মাহবুবুজ্জামান আহমেদ বলেন, “সাবেক মন্ত্রীর ভাই হলেও তার সঙ্গে আমার তেমন কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তা দলীয় শীর্ষ নেতারাসহ জেলাবাসীও জানেন। জনগণ ভোট দিয়ে আমাকে দীর্ঘ দিন ধরে উপজেলার দায়িত্ব দিয়ে আসছেন। এবারও জনগণের দাবি পূরণে প্রার্থী হয়েছি। আশা করছি, বিপুল ভোটে ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে উপজেলার মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারব।”
বৃহস্পতিবার ঘোড়া প্রতীক পেয়েছেন মাহবুবুজ্জামান আহমেদ। প্রতীক পেয়ে সুষ্ঠু ভোট হলেই জয়লাভ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করার পাশাপাশি ভোট নিয়ে শঙ্কার কথা জানান তিনি।
প্রতিপক্ষ প্রার্থীর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “তারা নাকি একটি ভোট পেলেও চেয়ারম্যান হবেন; সাধারণ ভোটারদের মাঝে এমন অপপ্রচার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি কীভাবে তারা বলতে পারে?”
এদিকে আনারস প্রতীক পেয়ে এমপি-পুত্র রাকিবুজ্জামান আহমেদ নির্বাচনে জয়লাভের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “উপজেলার ভোটাররা তরুণ নেতৃত্ব খুঁজছেন। উপজেলার উন্নয়নে ভূমিকা রাখব। জনগণ তরুণ নেতৃত্ব চায়। নতুনত্ব চায়। জনগণের দাবি পূরণে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি।
“জনগণ আমার পাশে আছে, সৃষ্টিকর্তা সম্মান দেওয়ার মালিক। এ ছাড়া বাবা-মায়ের দোয়া সব সময় আমার সঙ্গে রয়েছেন। তাই আমার বিশ্বাস, আমি অনেক ভোটে বিজয়ী হব।”
চাচার অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি বলেন, “তিনি বরাবর আমাদের বিপক্ষে গুজব রটিয়ে থাকেন। তার এমন গুজবে কান না দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
চাচা-ভাতিজার ভোটের মাঠে এরকম লড়াইয়ের প্রভাব পড়েছে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও। তারা কোন পক্ষে যাবেন এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। প্রকাশ্যে কেউ মুখ ফুটে কোনো কথাই বলতে চাচ্ছেন না।
এ ছাড়া এই উপজেলায় হেলিকপ্টার প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে ভোট যুদ্ধে নেমেছেন তারিকুল ইসলাম। যদিও ভোটের মাঠে তার প্রভাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।
ভোট নিয়ে জানতে তার মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ভোটের পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে উপজেলার ভোটমারী এলাকার সবুজ আলী বলেন, “একই পরিবার থেকে দুজন প্রার্থী হওয়ায় ভোট কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি হবে। আমরা সাধারণ ভোটাররা কিন্তু ভোটটাকে উপভোগ করবো এবার।”
উপজেলার তুষভান্ডার বাজারে কথা হয় আজিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, “উপজেলার ভোটাররা একটি পরিবারের হাতে এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছেন। পরিবারটি থেকে পরিত্রাণের জন্য একজন যুতসই প্রার্থী খুঁজছেন এলাকার ভোটাররা।”
তবে এই ভোট নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই বলেও জানান তিনি।
কাকিনা এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, “পাঁচ বছর পর পর ভোট আসে। তাই পছন্দের মানুষকে তো ভোট দিতে যেতেই হবে।”
একই পরিবারের দুই শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় ভোট নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত তিনি।
এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে শাহজাহান প্রামাণিক (মাইক), সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবির হোসেন (টিউবয়েল), উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবদাস কুমার রায় (বৈদ্যুতিক বাল্ব), আওয়ামী লীগ নেতা কমল কৃষ্ণ সরকার (তালা), ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি সাব্বির আহম্মেদ (টিয়া পাখি) প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে লড়ছেন।
সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিলুফা আক্তার (কলস) ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নাজনীন রহমান (ফুটবল) প্রতীকে লড়ছেন।
এক নজরে
উপজেলা নির্বাচন: এমপি-পুত্রের মনোনয়ন বাতিলের দাবি চাচার
স্বতন্ত্র প্রার্থীর মঞ্চে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর ‘গীবত করলেন’ তার ভাই