বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরাতে কাজ করায় মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে ‘আরসা’ গোষ্ঠী খুন করে বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।
Published : 13 Jun 2022, 06:27 PM
আরসা রোহিঙ্গাদেরই রাখাইনভিত্তিক একটি সশস্ত্র সংগঠন, পুরো নাম আরাকান রিপাবলিকান স্যালভেশন আর্মি।
আর বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মুহিবুল্লাহ গড়ে তুললেছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নামে আরেক সংগঠন।
গত বছর মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যদেরও সন্দেহ ছিল ‘আরসা’র দিকে।
প্রায় সাড়ে আট মাস তদন্তের পর আলোচিত এই মামলায় সোমবার দেওয়া অভিযোগপত্রেও পুলিশ একই কারণই খুঁজে পাওয়ার কথা জানাল।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, দুপুরে জেলার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় কক্সবাজার পুলিশ। সেখানে মোট ২৯ জনকে আসামি করা হয়েছে, তাদের সবাই রোহিঙ্গা।
কক্সবাজার আদালতে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম হত্যার কারণ সম্পর্কে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করায় এর বিরোধীরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। আরসা নামধারী কথিত সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় আরসাসহ প্রত্যাবাসন বিরোধী মহল তার উপর ক্ষিপ্ত ছিল।”
২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার ১-ইস্ট লম্বাশিয়া ক্যাম্পে ৪৮ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে একদল অস্ত্রধারী।
মামলার তদন্তকারীরা জানান, হত্যাকাণ্ডে মোট ৩৬ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পেলেও সাতজনের ঠিকানা ও অবস্থান জানতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ২৯ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হল।
অভিযোগপত্রে নাম থাকা ২৯ আসামির মধ্যে ১৫ জন গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন, বাকি ১৪ জন পলাতক।
গ্রেপ্তার ১৫ জনের মধ্যে ৪ জন তদন্ত চলাকালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
বেশ কয়েক বছর আগে জীবন বাঁচাতে নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে সপরিবারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা হন মুহিবুল্লাহ। থাকতেন উখিয়ার ১-ইস্ট লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে।
মিয়ানমারের রাখাইনে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মুসলিম রোহিঙ্গার সংখ্যা ইতোমধ্যে ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কয়েক বছর আগে চুক্তিবদ্ধ হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হওয়াটা এখনও অনিশ্চিত।
স্বজাতির কাছে ‘মুহিবুল্লাহ মাস্টার’ নামে পরিচিত চল্লিশোর্ধ্ব মুহিবুল্লাহ যে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) গড়ে তুলেছিলেন, সেই সংগঠনটি ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিল।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় আসেন মুহিবুল্লাহ। জেনিভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায়ও রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি।
ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টায় উখিয়া উপজেলার ১-ইস্ট নম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে নিজের সংগঠনের কার্যালয়েই আক্রান্ত হন মুহিবুল্লাহ। তার উপর গুলিবর্ষণ হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই রাত সোয়া ১০টার দিকে তিনি মারা যান।
তার ভাই আহমদ উল্লাহ তখন বলেছিলেন, মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের ‘সর্বজনগ্রাহ্য’ নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার সঙ্গে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গের যোগাযোগ ছিল। এ কারণে পুরনো সংগঠন আরসা তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল।
পরিবার থেকে দাবি করা হয়, আরসার সদস্যরা মুহিবুল্লাহকে নেতা মানতে রাজি ছিল না। তারাই (আরসা) প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
এর আগে থেকে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ না করতে আরসা’র সদস্যরা তাকে নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল বলেও জানান তারা।
মুহিবুল্লার ভাই হাবিবুল্লাহ ওই হত্যাকাণ্ডের পর উখিয়া মামলা দায়ের করেন; ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়। হাবিবুল্লাহর দাবি ছিল, খুনিদের ১৫ থেকে ২০ জনের দলের প্রত্যেকের মুখ মাস্ক এবং গামছায় ঢাকা ছিল।
হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মুহিবুল্লাহর স্বজন ও অনুসারীরা নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থেকে হন্যে হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন তারা। এর ধারাবাহিকতায় তার পরিবারের ১১ সদস্য গত ১ এপ্রিল কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।
ওই দলে মহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা খাতুন, নয় ছেলে-মেয়ে এবং এক মেয়ের জামাইও ছিলেন। তাদের ‘রিফিউজি’ মর্যাদা দিয়ে কানাডায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
আরও খবর