ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
Published : 19 Mar 2025, 06:54 PM
ময়মনসিংহ শহরের ব্যস্ততম এলাকার যে বহুতল ভবন থেকে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসার চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই ভাড়ার ফ্ল্যাটে তারা চার মাস আগে স্থানীয় পরিচয়ে ওঠেছিলেন এবং তাদের চলাচল ছিল খুবই সীমিত।
রোববার গভীর রাতে র্যাবের এই অভিযানের পর থেকেই নগরীর নতুনবাজার মোড়ের ১৫ তলার ‘সিটি গার্ডেন’ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
র্যাব-১১ এর সদস্যরা ওইদিন রাত ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ভবনটির দশম তলার ‘এ’ ব্লকের একটি ফ্ল্যাট থেকে দুজন নারী এবং দুজন পুরুষকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের সঙ্গে দুটি শিশুও ছিল।
তারা হলেন- আসমত উল্লাহ (২৪) মো. হাসান (৪৩), মোছা. শাহিনা (২২) এবং ১৭ বছরের এক কিশোরী। তাদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা এবং ১২ ভরি স্বর্ণালঙ্কার জব্দের কথাও জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
একই অভিযানের অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমি পল্লি থেকে আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; যাদের ছয়জন এখন রিমান্ডে আছেন। সেই খবর দেখে এখন ময়মনসিংহের ভবন মালিকরা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক বলে জানিয়েছেন।
বুধবার ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়, এখনো পুরো নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। ভবনটি দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন দারোয়ান নিজাম উদ্দিন। তিনি জানান, ভবনটি মালিক মাজহারুল হক। তিনি নরসিংদীতে বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত।
বাসাটির ভাড়া নিজেই দিয়েছিলেন জানিয়ে দারোয়ান নিজাম উদ্দিন বলেন, নোটিস দেখে চার মাস আগে দুই ব্যক্তি বাসাটি ভাড়া নিতে চান। তখন তারা নিজেদের বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের তারুন্দিয়া ইউনিয়নে বলে পরিচয় দেন। একজনের নাম বলেন মনিরুজ্জামান।
“আমার বাড়িও ঈশ্বরগঞ্জ হওয়ায় তাদের বিশ্বাস করে মালিকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেই। পরে মাসিক ২০ হাজার টাকায় ভাড়া চুক্তি হয়। ভাড়া দেওয়ার সময় তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চাই। কিন্তু আজ দেই কাল দেই বলে সময়ক্ষেপণ করেন।”
তিনি বলেন, পরে মনিরুজ্জামান একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেন, যেখানে বাড়ি উচাখিলা ইউনিয়নের চর আলগী লেখা। বাবার নাম লেখা ছিল মো. আতিকুল ইসলাম। কিন্তু বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় বলেছিলেন তার বাড়ি তারুন্দিয়া। তখন আর বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
দুই ব্যক্তি যখন ভাড়া নিতে আসেন, তখন নিজেদের ভাই বলে পরিচয় দেন বলেও জানান দারোয়ান নিজাম উদ্দিন।
“তারা বলেছিল, তাদের মা-বাবা এই ফ্ল্যাটে থাকবেন। তাদের বাবা গাজীপুরে একটি মাদ্রাসায় চাকরি করেন। একজন বয়স্ক ব্যক্তি এই বাসায় থাকতেন। তার হাঁটাচলা খুব ধীরগতিতে ছিল। মহিলারা পর্দা করায় তাদের রুমে যাওয়া হত না। চলাফেলা মনিরুজ্জামান নামের ব্যক্তিই একটু বেশি করতেন। বাকিরা তেমন এটা বের হতেন না।”
ভবনটির মালিক মাজহারুল হক বলেন, “বিদ্যুৎ বিভাগে কাজ করার সুবাদে নরসিংদীতে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে বসবাস করছি। আমার গ্রামের বাড়ি নান্দাইলে। এমন একটি ঘটনায় আমি নিজেও মর্মাহত। তারা আমার বাসার দ্বিতীয় ভাড়াটিয়া হিসেবে ওঠেছিলেন। দারোয়ান নিজাম উদ্দিনই তাদের সঙ্গে বাসা ভাড়ার বিষয়ে কথা বলেন। পরে আমাকে মোবাইলে কথা বলিয়ে দেন। আমি এতকিছু আর চিন্তাভাবনা করিনি।”
প্রশাসনের তদন্তের প্রয়োজনে এখন বাসাটি আপাতত তালাবদ্ধ থাকবে বলেও জানান মাজহারুল হক। তিনি বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের সময় বাসার দরজা এবং ভেতরে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেগুলো মেরামত করে তারপর নতুনভাবে বাসা ভাড়ার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে।
সিটি গার্ডেনের সাত তলায় বসবাস করেন ফিরোজ আহমেদ। তিনিও সরকারি চাকরিজীবী। তিনি বলছিলেন, “১৫ তলা ভবনের পাঁচতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক। চার ইউনিটের বাসার বাকি ফ্লোরে ৩৬টি পরিবার বসবাস করে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর সবাইকে ডেকে আলোচনা হয়েছে। সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বাসায় কেউ প্রবেশ করলেও নাম এবং মোবাইল নম্বর লিখে প্রবেশ করানোর জন্য বলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সরকারি চাকরি করায় আমাকে দিনভর বাইরে থাকতে হয়। ওই বাসার ভাড়াটিয়া মনিরুজ্জামান নামে পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে আমার একদিন দেখা হয়েছিল। তবে শুনেছিলাম, তারা খুব ছিমছাম চলাফেরা করতেন।”
নতুন বাজার এলাকায় একটি বাসার মালিক আব্দুল লতিফ বলেন, “এমন এলাকায় সন্ত্রাসী লোকজন বাসা ভাড়া নেবে তা কল্পনার মধ্যেও আসেনি। আমরা সাধারণত ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকি। এখন আরও সতর্ক হতে হবে। না হয় কখন কোন বিপদে পড়ি বলা তো যায় না।”
গ্রেপ্তারদের তিনজন ভাইবোন
র্যাব-১১ এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালিয়ে আরসা প্রধানসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে কোতোয়ালি মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। র্যাব-১১ এর নায়েক সুবেদার হারুন অর রশিদ মামলা দুটি করেন।
আরসা প্রধান জুনুনি গ্রেপ্তার, ১০ দিনের রিমান্ডে
ময়মনসিংহে ভবন ঘিরে আটক করা 'চারজন' কারা?
তমব্রু সীমান্তে ডিজিএফআই কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় মামলা
এতে আসামি করা হয়েছে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি (৪৮), মোস্তাক আহাম্মদ (৬৬), মনিরুজ্জামান (২৪), সলিমুল্লাহ (২৭) ও তাঁর স্ত্রী মোসা. আসমাউল হোসনা (২৩), ১৫ বছর বয়সী কিশোর, আসমত উল্লাহ (২৪), মো. হাসান (৪৩), মোছা. শাহীনা (২২) ও ১৭ বছর বয়সী কিশোরী।
কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ জানায়, ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের মধ্যে তিনজন ভাইবোন। আসমত উল্লাহ, শাহিনা আক্তার ও ১৭ বছর বয়সী কিশোরী- তারা ভাইবোন। তারা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের কাউনিয়া বিল এলাকার বাসিন্দা হলেও উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের থাকতেন।
গ্রেপ্তার অপরজন মো. হাসান। তিনি আরাকানের খুনকুন এলাকার বাসিন্দা হলেও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকতেন।
মামলায় আরসার সদস্যদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা, ১২ ভরি স্বর্ণ, বিদেশি মুদ্রা, আরসা আর্মি লেখা ১৫টি নেমপ্লেট, মিলিটারি শার্টসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ দেখানো হয়েছে।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, “গ্রেপ্তাররা ময়মনসিংহে বাসাভাড়া নিয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আদালতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাদের ময়মনসিংহে আনা হবে। পরে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।
“কারা কেন তাদেরকে বাসাভাড়া দিল বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”