পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মাঝে মাঝে অবৈধ ক্র্যাশার মিল উচ্ছেদে অভিযান হয়, তখন কিছুদিন বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি ‘অনুকূলে এলে’ আবার চালু হয় মিলগুলো।
Published : 01 Dec 2024, 01:37 AM
কোনো ধরনের আইন, পরিবেশ বা স্বাস্থ্যঝুঁকির তোয়াক্কা না করে এক প্রকার গায়ের জোরেই সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় চলছে পাথর ভাঙার দেড় হাজার ক্র্যাশার মিল।
অবৈধ এসব ক্র্যাশার মিলের কারণে গোটা এলাকাজুড়ে ভূ-প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের শঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞরা বলে এলেও বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই।
পরিবেশবাদী একটি সংগঠনের রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে এক আদেশে যত্রতত্র ক্র্যাশার মিল বসানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আদালত। তার বদলে একটি তুলনামূলক নিরাপদ স্থানে ‘জোন তৈরি করে’ ক্র্যাশার মিলগুলো স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। আদালতের সেই আদেশ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ আজ অবধি নেওয়া হয়নি।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদীর তীর, চা বাগান, টিলার পাদদেশ, মহাসড়ক সংলগ্ন এলাকা, জনবসতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকায় ক্র্যাশার মিল বসানোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; অথচ এরকম স্থানেও অবাধে ছোট-বড় কারখানা বসিয়ে বাণিজ্য চলছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মাঝে মাঝে এসব অবৈধ ক্র্যাশার মিল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়, তখন কিছুদিন বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি ‘অনুকূলে এলে’ আবার চালু হয় মিলগুলো।
আইন অনুযায়ী, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া এসব মিলে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সে নিয়ম মানা হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট জেলার সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বলেন, “হাই কোর্টের রায় ছিল, সিলেটে ক্র্যাশার জোন না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ক্র্যাশার মিল স্থাপনে ছাড়পত্র দেবে না। সিলেটে এখনও কোনো ক্র্যাশার জোন হয়নি। তবে ক্র্যাশার মিলগুলো ছাড়পত্র ছাড়াই চালছে।”
পরিবেশ অধিদপ্তর ১৭ নভেম্বর জাফলংয়ে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় (ইসিএ) থাকা ৫২টি ক্র্যাশার মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করতে অভিযান চালিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বদরুল হুদা বলেন, একটি মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করার পর শত শত শ্রমিক দিয়ে তাদের ঘিরে ফেলা হয়।
“পরে শ্রমিকদের বাধার মুখে আমরা ওই ক্র্যাশার মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ ফের স্থাপন করতে বাধ্য হই। বিদ্যুৎ বিভাগ পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই ক্র্যাশার মিলগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে।”
দেড় হাজারের বেশি ক্র্যাশার মিলে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ কাজ করেন। এখানকার মিলগুলোতে আমদানি করা পাথরের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে টিলা ও নদী থেকে উত্তোলিত পাথরও ভাঙা হয়। বিভিন্ন আকারের পাথর, পাথরের গুঁড়া মিলিয়ে ব্যবসাটি বেশ বড়ই; যেখানে স্থানীয় বা বাইরের অনেক শ্রমিকও কাজ করছেন।
এসব অবৈধ ক্র্যাশার মিল উচ্ছেদে প্রশাসনের ‘আন্তরিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাই কোর্টে রিটকারী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগের সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার বলেন, সর্বশেষ ২০২৪ সালে সরকারিভাবে তিন শতাধিক ক্র্যাশার মিলের যে সংখ্যা দেখানো হয়, সেটা সঠিক নয়।
“কারণ, আমরা সরেজমিনে কিন্তু আরো অনেক মেশিন দেখছি। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ৫ অগাস্টের পর থেকে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর পার থেকে মেশিন সরানো হয়েছিল। কিন্তু এখন সেখানে সারি সারি ক্র্যাশার মেশিন চলছে।”
তিনি বলেন, “আমার জানার ইচ্ছা, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল; এই দীর্ঘ সময়েও কি এ অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়? প্রশাসন কি এতই দুর্বল?”
রিট মামলা
সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলায় অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে পাথর ভাঙার ক্র্যাশার মেশিন স্থাপন ও পরিচালনা বন্ধের জন্য ২০১৫ সালে বেলার পক্ষ থেকে সেই রিট আবেদন করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত রায়ে, অবৈধ ক্র্যাশার মেশিন উচ্ছেদ, একটি জোন করে সব বৈধ ক্র্যাশার মেশিনকে স্থানান্তর এবং পাথর ভাঙার ক্র্যাশার মেশিন স্থাপন নীতিমালা-২০০৬ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
উচ্চ আদালতে আদেশের আলোকে পরিবশ ও বন মন্ত্রণালয় সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন জাফলং-ডাউকী নদী ও পিয়াইন নদীর মধ্যবর্তী খাসিয়াপুঞ্জিসহ মোট ১৪ দশমিক ৯৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা-ইসিএ ঘোষণা করে।
পর্যটনকেন্দ্র জাফলংকে পাথর কোয়ারির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু পাথর আহরণ বা ক্র্যাশার মিল বন্ধ হয়নি।
বেলার একজন কর্মকর্তা বলেন, জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, লোভাছড়াসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর পাড়, কৃষিজমি, টিলা, বন কেটে যথেচ্ছভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। সিলেটে অবৈধ ও অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলন বন্ধের নাগরিক দাবি দীর্ঘদিনের। ২০২০ সালে সরকারি এক আদেশে পাথর উত্তোলন বন্ধ হলেও সম্প্রতি আবার তা শুরু হয়েছে।
পাথর উত্তোলন বন্ধের নাগরিক এ দাবি সামনে রেখে সিলেটের সব উপজেলায় পাথর উত্তোলন বন্ধ, জাফলংয়ে ইসিএ বাস্তবায়ন এবং পাথর ভাঙার কারখানা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমমনা সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বল্পমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
কত মেশিন, কেউ জানে না
সিলেটে আসলে কতগুলো পাথর ভাঙার ক্র্যাশার মেশিন আছে তার কোনো হিসাব কারো কাছে নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে সামগ্রিক তালিকা না থাকলেও উপজেলা প্রশাসনের কাছে একটি তালিকা আছে। কিন্তু এই তালিকা নিয়ে পরিবেশবিদদের প্রশ্ন রয়েছে।
স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ী সমিতির নেতা, সাধারণ ব্যবসায়ী, এলাকাবাসী ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোটা এলাকায় অন্তত দেড় হাজার ছোট-বড় ক্র্যাশার মেশিন রয়েছে।
এসব মিলে বড় পাথর ভেঙে ছোট ছোট বিভিন্ন আকার দেওয়া হয়। সেসব টুকরো পাথর ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়; যেগুলো মূলত নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়।
সবচেয়ে ছোট পাথরগুলোকে ভেঙে ডাস্ট বা গুঁড়া করা হয়। এগুলো ট্রাকে করে চলে যায় সিমেন্ট ও টাইলস কারখানায়।
পাথর ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাদা ভাঙা পাথরের গুঁড়া বা ডাস্ট প্রতিফুট ১২ থেকে ২০ টাকা ধরে বিক্রি হয়। আর কালো পাথরের ডাস্ট প্রতিফুট ২৫ থেকে ৩০ টাকা ধরে বিক্রি হয়। ফুট ছাড়াও আন্দাজের ওপর গাড়ি হিসাবেও বিক্রি হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা-ইসিএ পর্যটন কেন্দ্র জাফলংয়ে রয়েছে ৫২টি ক্র্যাশার মিল। এ ছাড়া জাফলংয়ে ইসিএর বাইরে আছে ৫৫টি, কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে ৬০টি, ধোপাগুলে ৩০টি ও বিয়ানীবাজারে ৪০টি, জৈন্তাপুরে ৬৫টি ক্র্যাশার মিল রয়েছে।
যদিও পাথর ব্যবসায়ী আহমেদ হোসেন বলেছেন, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট মিলে ছোট-বড় মিলেয়ে ৫০০টি ক্র্যাশার মিল রয়েছে। মিলগুলো এখন আমদানি করা পাথরের ওপর নির্ভরশীল। তবে আমদানির সঙ্গে স্থানীয় পাথরও ভাঙা হয় মিলে। আর সিলেট জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে দেড় হাজার ক্র্যাশার মিল আছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পাথর ব্যবসায়ী ফখর উদ্দিন জানান, কোম্পানীগঞ্জে বড় ও ছোট মিলেয়ে ৩০০ থেকে ৩৫০টি ক্র্যাশার মিল রয়েছে। ক্র্যাশার মিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় ১০ হাজার মানুষ আছেন। কোম্পানীগঞ্জে বড় মিলগুলোতে পানি ব্যবহার করা হয়। তবে ছোট মিনি ক্র্যাশার-টমটম মিলে পানি ব্যবহার করা হয় না।
সড়কের পাশে শুধু মেশিন আর মেশিন
শনিবার মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জৈন্তাপুর উপজেলা সদর থেকে বাংলাবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সিলেট-তামাবিল সড়কের দুইপাশের খালি জায়গা, পাহাড়-টিলা, নদীর পাড়, হাওরসহ পর্যটন কেন্দ্র জাফলং পর্যন্ত সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে পাথর ভাঙার ক্র্যাশার কারখানা।
চারপাশে বিকট শব্দ আর পাথর ভাঙা গুঁড়া চারপাশে উড়ছে। আশপাশের দোকানপাট, রাস্তাঘাট, ধানক্ষেত, মাঠের ঘাস, ঘরবাড়ির টিনে জমে আছে ভাঙা পাথরের গুঁড়া। গাছপালা, পাকা ধান, ঘাসের রং বদলে গেছে গুঁড়ার জন্য। যেখানে হাত রাখা যায় সেখানেই পাথরের গুঁড়া।
এসবের মধ্য দিয়েই চলাচল করছেন স্থানীয় বাসিন্দা, পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে আসা পর্যটকরা। এ সময় বাংলাবাজার এলাকায় রাংপানি নদী থেকে ইজারাবিহীন বালু-পাথর উত্তোলন করেতে গেছে। বাংলাবাজার পেরিয়ে আসামপাড়া, মোকামবাড়ি-আলুবাগান এলাকায়ও একই অবস্থা। আলুবাগান-মোকামবাড়ি ও তামাবিল বন্দর এলাকায় মানুষজনের বাসাবাড়ির পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে বড়-বড় ক্র্যাশার কারখানা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে অপরিকল্পিতভাবে আবাসিক এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে এসব কারখানা। দেখার কেউ নেই। তাদের ভালভাবে বেঁচে থাকতেও সমস্যা হচ্ছে।
পানি ছাড়াই পাথর গুঁড়া
স্থানীয়দের অভিযোগ, পাথর ভেঙে গুঁড়া করার সময় পানি ব্যবহার করলে তা আর ধুলার মত উড়ে যেতে পারে না। কিন্তু পানি ব্যবহার করলেও পাথরের আর গুড়া পাওয়া যায় না; সেটা খালে-নদীতে মিশে চলে যায়। ফলে পাথর থেকে গুঁড়া পেতে মিল মালিকরা পানি ব্যবহার করেন না। যেটা স্থানীয় মানুষদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের হুমকির একটি বড় কারণ।
তবে মাঝে মধ্যে দু-একটা মিলে পানি ব্যবহার করে পাথর ভাঙতেও দেখা গেছে। আর এসব কারখানায় আমদানি করা পাথরের পাশাপাশি টিলা থেকে উঠানো লাল পাথর ভাঙা হচ্ছে।
সিলেটের পাথর ব্যবসায়ী আফজাল হক বলেন, “বর্তমানে মিল মালিকরা ভাঙা পাথরের ডাস্ট বিক্রি করার জন্য পানি ব্যবহার করেন না। কারণ, পানি ব্যবহার করলে ডাস্ট পানির সঙ্গে নদী বা খালে মিশে যায়। সেটি আর বিক্রি করা যায় না।
সিমেন্ট ও টাইলস কারখানায় ডাস্টের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে জানিয়ে আফজাল হক বলেন, “তাই ব্যবসায়ীরা পানি ব্যবহার করতে চান না। পানি ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ খরচও বেশি হয়। ভাঙা পাথরের ডাস্ট গাড়ি হিসাবে বা প্রতি ফুট ধরে বিক্রি করা হয়।’’
আলুবাগান এলাকায় রাফি স্টোন ক্র্যাশারে গিয়ে দেখা যায়, পাথর ভাঙার সময় পানি ব্যবহার করা হচ্ছে না।
জানতে চাইলে কারখানার চালক আক্তার হোসেন বলেন, “পানি মারতেছি, তবে অতিরিক্ত পানি না থাকার কারণে সমস্যা হচ্ছে। আর ছোট মাল থাকার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। এই এলাকার সব মিলেই একই অবস্থা।’’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জৈন্তাপুর আলুবাগান ক্র্যাশার সমিতির সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হোসেন ছেদু বলেন, “আমাদের সমিতির ১৮টি ক্র্যাশার কারখানা রয়েছে; এর মধ্যে কোনো একটি মিলও পানি ছাড়া চালাতে পারবে না। সেটি সমিতির পক্ষ থেকে মালিকদের জানানো হয়েছে। এটি দেখার জন্য আমরা লোক রেখেছি। এ বিষয়ে গত কিছু আগে ইউএনওর সঙ্গে মিটিং হয়েছে।”
শনিবার গিয়ে পানি ছাড়া অনেক মিল চলতে দেখতে পাওয়া গেছে জানালে সরোয়ার হোসেন ছেদু বলেন, “এটি হওয়ার কথা না। আমি শনিবার একটু বাইরে ছিলাম। আপনি আসেন, দেখে যান, আমাদের মিলগুলো পানি দিয়েই চলছে।”
সিলেটের নয়নাভিরাম পর্যটনকেন্দ্র ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন জাফলংয়ের বল্লাঘাট-মামারবাজার ও জাফলং বাজার এলাকার পাথার ভাঙার ক্র্যাশার কারখানাগুলোতে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে।
‘পড়তেও পারি না, ঘুমাতেও পারি না’
শনিবার বিকালে জৈন্তাপুরের আলুবাগান-মোকামবাড়ি এলাকায় সাংবাদিক এসেছেন জেনে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই মতিন কনস্ট্রাকশন ক্র্যাশার মিলের সামনে আসেন। তাদের মধ্যে যুবক, মাঝ বয়সী পুরুষদের পাশাপাশি স্কুলপড়ুয়া শিশুরাও ছিল।
স্কুল-কলেজে পড়ুয়া এসব শিশু-কিশোরদের অভিযোগ, ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব ক্র্যাশার মিল চলে। এত প্রচণ্ড শব্দ যে বাড়িতে তারা পড়তে পারে না, ঘুমাতেও পারে না।
জৈন্তাপুর সরকারি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র রূপন দে বলে, “ধুলোবালির কারণে আমাদের সমস্যা হয়। পড়ালেখা করতে পারি না। সামনে আমাদের পরীক্ষা। এখন যদি মিলটা চালু থাকে আমি পরীক্ষা দেব কীভাবে?
“ধুলোর কারণে কোনো দরকারে বের হলে প্রতিদিন দুই-তিনবার স্নান করা লাগে। কাপড়-চোপড়, খাবার নষ্ট হয় ধুলোর কারণে। যাদের শ্বাসকষ্ট, সর্দি আছে তাদের ক্ষতি হতে পারে। দুইদিন বাদে আমাদের পরীক্ষা, এখন মিল যদি সারা দিনরাত চালু থাকে শব্দের কারণে আমরা পরীক্ষা দেব কীভাবে?”
ঋতু রানী পাল উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়াশোনা করছেন। সামনে তার ভর্তি পরীক্ষা রয়েছে। তার আবার মাইগ্রেনের সমস্যা। তার বাড়ির পাশেই একটি ক্র্যাশার কারখানা রয়েছে।
তিনি বলছিলেন, “বাড়ির এত কাছে মিল হওয়াতে আমার মাইগ্রেন, শ্বাসকষ্ট ও চোখের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই শব্দের কারণে না পাড়ি পড়তে, না পাড়ি ঠিকমত ঘুমাতে। এখন আমি পরীক্ষাটা কেমনে দেব? আমার শারীরিক-মানসিক অবস্থার অবনতি দায় কে নেবে?”
জনবসতির মধ্যে মিল থাকার কথা না মন্তব্য করে ঋতু বলেন, “দেশে তো আইন-কানুন আছে, কেউ কিছু করে না ক্যানে? আমার বাবা একজন সীমিত আয়ের মানুষ। তিনি আমার চিকিৎসা করাবেন, নাকি আমাকে পড়াবেন, কী করব আমরা?”
ঋতু পাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার একজন পিসা দুইমাস আগে মারা গেছেন। মিলের পেছনে উনার বাড়ি। এই মিলের শব্দের কারণে উনি তিন তিনবার ব্রেইন স্টোক করে মারা গেছেন। আমরা উনাকে বাঁচাতে পারিনি। এই যে জীবনের দায় এগুলো কে নেবে? এসবের আইনি ব্যবস্থা হওয়া জরুরি। আমাদের ভবিষ্যৎ তো একেবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই বলেছেন জৈন্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিলাদুর রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আগের থেকে শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগজনিত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়েনি।’’
ধুলোবালি বা পাথর ভাঙার গুঁড়োয় ওই এলাকার মানুষদের স্বাস্থ্যগত কী সমস্যা হতে পারে- প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসক বলেন, “নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও চর্মজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আর দীর্ঘদিন এ রকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসজনিত ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।”
কারখানা অপসারণের দাবি
পাথর ভাঙার কারখানার জন্য সরকার নির্দিষ্ট জায়গা করে দিক, সেখানে গিয়ে তারা পাথর ভাঙুক- এটা চান স্থানীয় বাসিন্দারা।
তাদের একটা বড় অভিযোগ, শব্দ দূষণ তো হচ্ছেই। তার চেয়ে বড় বিষয়, কারখানাগুলো পাথর থেকে গুঁড়া বের করার সময় পানি ব্যবহার করে না। এটাই দিন দিন তাদের জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আলুবাগান এলাকার বাসিন্দা মো. আদ্দুর শুকুর বলছিলেন, “পাথরের ডাস্টে চারপাশের সব পান বাগান নষ্ট হয়ে গেছে। টি গার্ডেন এলাকায় মিল করার তো কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু এখানে করা হয়েছে। কেউ দেখার নেই। কারো কথা শুনে না। আমরা মিলটি সরানোর দাবি জানাই।”
একই এলাকার যুবক মো. হান্নান মিয়া মতিন কনস্ট্রাকশন ক্র্যাশার মিল দেখিয়ে বলেন, “এটা দুই বছর ধরে চলছে। কোনো ধরনের পানি দেয় না। আমরা পানির কথা বারবার বললেও তারা আমাদের দেখায় পানি দিচ্ছে। আমরা সরে গেলে পানি দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
“এই মিলের পাশেই একটা মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটা এই এলাকার সাতটা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির। মন্দিরটি মিল থেকে প্রায় ১০ হাত দূরে হবে। পাশে আছে পর্যটন এলাকার রিসোর্ট। আর চারপাশে আছে পান বাগান। এলাকার ২৫০ থেকে ৩০০ পরিবার রয়েছে। কিন্তু মিল মালিকরা পরিবারগুলোর তোয়াক্কা করে না। মিলের লোকেরা দেখায়, তারা বড় একটা কোম্পানি।
তিনি বলেন, “আমাদের আবেদন, এই মিলটা এখান থেকে তুলে নেওয়া হোক। এটি টি গার্ডেনের জায়গা। এখানো কোনো ক্র্যাশার মিলের জোন না। এটা টি গার্ডেনের জন্য লিজ আনা হয়েছে। টি গার্ডেন এলাকায় কিভাবে ক্র্যাশার মিল বাসানো হল?”
মোকামবাড়ী-আলুবাগান মহল্লা আলুবাগান, মাঝহাঁটি, দাউদাটিল্লা এলাকার প্রবেশ মুখে ডাবল প্লান্টের বড় ক্র্যাশার মেশিন স্থাপন করা হয়েছে।
ওই এলাকায় তিন-চারটি মহল্লায় হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে প্রায় ৩০০ পরিবার বসবাস করে। মিলের ২০০ মিটারের মধ্যে সনাতন ধর্মালম্বীদের মন্দির। যেখানে প্রতিদিন সকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। মিলটি স্বয়ংক্রিয় অটোলোডেড স্টিস্টেম হওয়ার ফেলুডার যন্ত্র দিয়ে বিশাল আকৃতির পাথর লোড করা হয়। যাতে করে মধ্যরাতে বিকট আওয়াজে কেঁপে ওঠে এলাকার চারপাশ।
মোকামবাড়ী আলুবাগান এলাকায় ভারতীয় চুনাপাথর আমদানি-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী সৈয়দ শামীম আহমদ বলেন, “বড় ফেলুডার-ভেকু দিয়ে মাল লোড-আনলোড করা হয়। তখন বিকট আওয়াজ হয়। সকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত উনারা মিল চালায়। তবে ক্র্যাশার জোনের মধ্যে মিল চালানোর শিডিউল হল, সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা। উনারা শিডিউল মানেন না। মিলের ম্যানেজারকে বার বার বলার পরও শোনে না।”
একই কথা বলেন মোকামবাড়ী প্রাক-প্রাথমিক স্কুলের সনাতন ধর্মীয় শিক্ষিকা রিংকু রানী পাল। তিনি বলেন, “মন্দিরটা কিছুটা নিচে হওয়ায় প্রতিদিন বৃষ্টির মত ধুলোবালি মন্দিরে প্রবেশ করে। স্কুলে আসা বাচ্চাদের মাথা ব্যথা হয়। বাচ্চাদের সঙ্গে ঠিকমত কথা বলা যায় না। বাচ্চাদের সর্দি-কাশি লেগেই আছে।’’
একই এলাকার গৃহিণী লাকি রানী পাল বলেন, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মিল চলে। মেয়ে পরীক্ষার্থী। তার মাথাব্যাথা লেগেই থাকে।
মিল মালিকরা যা বলছেন
গোয়াইনঘাটের জাফলং ক্র্যাশার মিল সমিতির সভাপতি বাবলু বখত বলছেন, জাফলংয়ে ৪০০ থেকে ৪৫০টি ক্র্যাশার মিল রয়েছে। সংগঠনের সদস্য ২২০ জন।
“আমাদের ক্র্যাশার জোন করে দিলে আমরা ইসিএ এলাকা ছেড়ে জোনে চলে যাব। ক্র্যাশার জোন করার বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মিটিং হয়েছে। এজন্য ডিসি সাহেব বলেছেন, আমাদের তথ্য দেওয়ার জন্য। আমরা তথ্য দিচ্ছি। আর পাহাড়, টিলা এলাকায় শুকনাকালে পানি কম থাকার কারণে অনেকে ঠিকমত পানি ব্যবহার করতে পারছে না। তবে অনেক মিল মালিক আবার ডিপ টিউববেল করে পানি ব্যবহার করছেন।”
নিজেও পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত জানিয়ে তিনি বলেন, “২০১৮ সালের পর থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিচ্ছে না। আর আগে আমাদের ছাড়পত্র ছিল। আমরা চাই, জাফলং একবারে ক্লিন হয়ে থাকুক, আর সেটা ক্র্যাশার জোন হলেই সম্ভব। তখন পর্যটন ব্যবসা আরো বাড়বে।”
জৈন্তাপুর ছিন্নমূল মিনি স্টোন ক্র্যাশার মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবু সুফিয়ান বেলাল দাবি করেন, তাদের সমিতির ১২২ জন সদস্য সবাই পানি ব্যবহার করেন।
“ক্র্যাশার জোন করে না দেওয়া পর্যন্ত ব্যবসাযীদের এভাবেই ব্যবসা করতে হবে। আমরা শতভাগ চেষ্টা করছি পরিবেশ ঠিক রেখে ব্যবসা করতে। এই এলাকার মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস এটি।”
শনিবার দুপুরে গিয়ে পানি ছাড়া মিল চলতে পাওয়া গেছে জানালে তিনি দাবি করেন, “পানি ছাড়া মিল চলেনি?’’
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ মিনি ক্র্যাশার (টমটম) মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছানুর আহমদ বলেন, তাদের আগে ২০০ সদস্য ছিল, এখন সেটা ১০০। শুকনা মৌসুমের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে; তাই পানি ব্যবহার কমে গেছে। তবে বর্ষা মৌসুমে সবাই পানি ব্যবহার করে।
দি সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফয়েজ হাসান ফেরদৌস বলেন, “সিলেটে বিপুল পরিমাণ পাথর আমদানি করা হয়। বর্তমানে পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকার কারণে এ শিল্প আমদানি নির্ভর। তবে কিছু স্থানীয় পাথরও মিলে।
পাথর শিল্পের সঙ্গে তিন লাখ মানুষ জড়িত দাবি করে চেম্বার নেতা বলেন, “এর মধ্যে ব্যবসায়ী, পাথর ভাঙা ও লোড-আনলোড শ্রমিক এবং পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকদের পরিবার জড়িত। বর্তমানে পাথর আমদানি করার কারণে ব্যবসায়ীরা লাভবান নন, তাই অনেক মিল বন্ধ রয়েছে।
“এজন্য সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো খোলার দাবি জানাই।”
পরিবেশবিদরা কী বলছেন
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রোমেল আহমেদ বলেন, পাথরের ধূলিকণা যখন আশপাশের গাছের পাতার উপর জমে পড়ে, তখন এটি সূর্যালোকের শোষণ ও গাছের ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে। ফলে উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। এতে গাছগুলো এক সময় মারাও যেতে পারে।
“এ ছাড়া এসব ধূলিকণা মাটির উপর জমে মাটির বায়ু চলাচল বাধাগ্রস্ত করে। এতে মাটির উর্বরতা কমে এবং উদ্ভিদের শিকড়ের সঠিকভাবে বৃদ্ধি ও পুষ্টি শোষণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বৃষ্টি হলে পাথরের ধূলিকণা পানিতে দ্রবীভূত খনিজ পদার্থের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং উদ্ভিদের জন্য পানির গুণগত মান কমিয়ে দেয়।”
সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরা’র সংগঠক অদ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, “নির্ধারিত ডেসিবলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ডিসিবল শব্দ সৃষ্টি করছে এসব মেশিনগুলো। এতে অনেক বধির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটা পরিবেশ আইনের স্পষ্ট লংঘন। প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।”
প্রশাসন যা বলছে
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, “ক্র্যাশার মিল মালিকদের কাগজপত্র দেখাতে বলেছি। তবে উনারা কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। জৈন্তাপুরে ১২০টির উপরে ক্র্যাশার মিল রয়েছে। এজন্য আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি।
“আর অবৈধ বিদ্যুৎ সংয়োগ বন্ধে আমরা কাজ করছি। মিলে পানি ব্যবহারে উপজেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযানের পরও মিল মালিকেরা নিয়মিত পানি ব্যবহার করছেন না।”
এ বিষয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিলেটের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সঞ্জীব কুমার রায় বলেন, “পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া নতুন করে সংয়োগ আমরা দিচ্ছি না। আগের দেওয়া সংয়োগগুলো ফাইল দেখে বলতে হবে ছাড়পত্র আছে কি-না?”
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, “পানি ছাড়া ক্র্যাশার মিল চালানো হলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এজন্য প্রশাসন আগেও অভিযান করেছে; আরও করা হবে।”
‘ক্র্যাশার জোন’ করার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে বৈঠকে মিল মালিকেরা ক্র্যাশার জোন চেয়েছেন। তবে তাদের কোনো বৈধতা নেই, কোনো কাগজপত্র নেই। তারা বৈধ পথে আসুক; তাহলে সেই ক্ষেত্রে তাদের দেখার সুয়োগ আছে। অবৈধ জিনিসকে তো আর দেখার সুয়োগ নেই।”