আলোচনায় ফল আসেনি, কর্মবিরতি চালাবেন চা শ্রমিকরা

শ্রম অধিদপ্তরের ডিজির সঙ্গে বসেছিলেন চা শ্রমিক নেতারা

মৌলভীবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2022, 01:30 PM
Updated : 16 August 2022, 01:30 PM

দৈনিক মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনের মধ্যে চা শ্রমিক নেতারা শ্রম অধিদপ্তরের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকে বসলেও কোনো ফল আসেনি; কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণাই দিয়েছেন তারা।

মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভানুগাছ রোডের শ্রম অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ে মহাপরিচালকের সঙ্গে আলোচনা বসেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল।

বিকালে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আলোচনায় কোনো মীমাংসা আসেনি। শ্রম অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে আমরা তাতে একমত পোষণ করিনি। আমাদের আন্দোলন চলবে।”

শ্রম অধিদপ্তর কী প্রস্তাব দিয়েছিল- জানতে চাইলে এই শ্রমিক নেতা বলেন, তারা বলেছিলেন, ২৩ অগাস্ট শ্রমিক, মালিক ও শ্রম অধিদপ্তর মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসবে। সেই সময় পর্যন্ত কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে শ্রমিকদের কাজে ফেরার জন্য বলা হয়।

“আমাদের পক্ষে এখন সেই দাবি মানা সম্ভব না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।”

শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “দুপুর থেকেই আলোচনা হয়েছে শ্রমিকদের সঙ্গে। প্রথম ধাপে আড়াই ঘণ্টা বৈঠকের পর আমরা তাদের একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শ্রমিকরা সেটি সঙ্গে সঙ্গে না মানার কথা জানান। তারপরও আমরা এক ঘণ্টা সময় নিয়েছি। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন।

“পরে বিকালে আবার তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সেখানেও তাদেরকে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে ফেরার অনুরোধ করা হয় এবং ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখনও শ্রমিকরা এই প্রস্তাব মানেননি। তারা জানিয়েছেন, কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন না।”

খালেদ মামুন চৌধুরী আরও বলেন, তবে কর্মবিরতি পালন করলেও যেহেতু শোকের মাস চলছে তাই চা শ্রমিকরা মহাসড়কে কোনো ধরনের সভা বা মিছিল করবেন না বলে জানিয়েছেন। তারা বাগানের ভিতরেই তাদের আন্দোলন চালাবেন।

শ্রম অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ পরেশ কালিন্দি বলেন, “এক ঘণ্টা বিরতিতে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেছি। তারপর বৈঠকে গিয়ে জানিয়েছি যে, দাবির বাস্তবায়ন না হলে আমাদের পক্ষে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা সম্ভব না। আন্দোলন চলবে।”

শ্রম অধিদপ্তরের শ্রীমঙ্গলের উপপরিচালক নাহিদুল ইসলাম বলেন, যেকোনো শিল্পে বিবাদ দেখা দিলে শ্রম অধিদপ্তর এগিয়ে এসে তা সমাধানের চেষ্টা করে। শিল্প বন্ধ থাকলে মালিক-শ্রমিক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। সেই প্রচেষ্টা থেকেই শ্রম অধিদপ্তর শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল।

টানা তিন থেকে চারদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতির পর শনিবার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি বা ধর্মঘট পালন করেছেন মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটসহ দেশের ২৪১টি চা বাগানের শ্রমিক। রোববার সপ্তাহিক ছুটি ও সোমবার জাতীয় শোক দিবসের জন্য দুদিন কর্মসূচি শিথিল করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। মঙ্গলবার থেকে ফের ধর্মঘটে যায় শ্রমিকরা।

এভাবে ধর্মঘট অব্যাহত থাকলে বাগানের ক্ষতি হবে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রীমঙ্গলের শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগানের মালিক মহসীন মিয়া মধু।

তিনি সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চায়ের পাতা তোলার নিয়ম রয়েছে। একবার একটি গাছ থেকে পাতা তোলার সাত দিন পর আবার তোলতে হয়। সর্বোচ্চ নয় দিন পর্যন্ত তা করা যায়।

“এরপর পাতা বড় হয়ে যায়। ডাটা শক্ত হয়ে যায়। তখন তা কেটে ফেলতে হয়। আর একবার কাটার পর তাতে নতুন কুঁড়ি ও পাতা আসতে ১৫ দিনের উপর সময় লাগে।”

তিনি আরও বলেন, “এ আন্দোলনে কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন চা বাগান মালিকরা। এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষতি। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক।”

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশীয় চা সংসদের আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, পানীয় জলের ব্যবস্থা ও বোনাসসহ ন্যায্যমজুরি নিশ্চিত করবে বাগান মালিক।

মজুরি বাড়ানোর জন্য প্রতি দুই বছর পর পর বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশীয় চা সংসদের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক হবে। সেই বৈঠকে উভয়ের আলোচনায় ঐক্যমতের পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এই চুক্তি অনুযায়ী, পরবর্তীতে দুই বছর শ্রমিকরা বেতন-ভাতাসহ অনান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবেন।

চা শ্রমিকদের সঙ্গে সবশেষ দ্বি-বার্ষিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এর পর পরই বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশীয় চা সংসদের কাছে ২০ দফা দাবিনামায় ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি দাবি করেন। এ নিয়ে দফায় দফায় এ পর্যন্ত ১৩টি বৈঠকও হয় দুই পক্ষের মধ্যে। কিন্তু দাবির বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ করেন শ্রমিক নেতারা।

শ্রমিক নেতারা জানান, গত ৩ অগাস্ট চা বাগানের মালিকদের কাছে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর জন্য এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। কিন্তু তারা সেটায় কর্ণপাত করেননি।

এর প্রতিবাদে ৯ অগাস্ট থেকে সারাদেশের চা বাগানে দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করে শ্রমিকরা। কর্মবিরতি শেষে তারা কাজে ফিরছিলেন। এরপরও মালিকপক্ষ দাবি মেনে না নেওয়ায় শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে যায়।

এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হবিগঞ্জের ২৪টি চা বাগানের ১০ জন শ্রমিক নেতার সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসলেও আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। ২৮ আগস্ট বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব রেখে শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকরা এতে সম্মত হননি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের ডিজি শুক্রবার বিকেলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের কাছে একটি চিঠি দেন। এতে চা পাতা উত্তোলনের ভরা মৌসুমে আন্দোলন না করে সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করার আহ্বান জানান।

শ্রমিকদের আন্দোলনের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট শাখার চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, বাগানে কর্মবিরতি দীর্ঘ হলে প্রতিদিন অন্তত ২৫ কোটি টাকার কাচা পাতা নষ্ট হবে।