ফুলচাষিরা বলছেন, গ্রীষ্মে বেশ কয়েকবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে যশোরে। সেই সঙ্গে বর্ষা ঘিরে ছিল দুই দফা অতিবৃষ্টির দাপট।
Published : 10 Dec 2024, 09:26 AM
দরজায় কড়া নাড়ছে বিজয় দিবস। তারপরই বড়দিন, কদিন বাদেই খ্রিস্টীয় নববর্ষ। উৎসবের এই দিনগুলোর বাজার ধরতে প্রতি বছরের মত এবারও ব্যস্ত সময় পার করছে যশোরের ফুলচাষিরা।
সারাবছর কমবেশি ফুল বিক্রি হলেও মূলত ডিসেম্বর থেকে মার্চ- মৌসুমের এই চার মাস সবচাইতে বেশি বেচাকেনা হয়। এ বছরও ভাল ফুল বিক্রির প্রত্যাশা করছেন গদখালির কৃষকরা।
যদিও চাষিরা বলছেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ফুলের উৎপাদন খুব ভালো হয়নি। তার পরও শুধু বিজয় দিবসে তিন কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন তারা।
ফুলচাষি ও বিপণনে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি বছরের গ্রীষ্মে বেশ কয়েকবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে যশোরে। সেই সঙ্গে বর্ষা ঘিরে ছিল দুই দফা অতিবৃষ্টির দাপট। এসব কারণে যশোরের গদখালির ফুলচাষিদের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তারা বর্তমানে ফুল ক্ষেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন, ১ জানুয়ারি খ্রিস্টীয় নববর্ষ, ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্তবরণ উৎসব, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানকে লক্ষ্য করে মোটা অংকের ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকে চাষিরা।
যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, “এ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পর অসময়ে বৃষ্টিতে ফুলচাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে চলতি বছর মৌসুমের চার মাসে গদখালি থেকে ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আমরা আশাবাদী। আসন্ন বিজয় দিবসকে ঘিরে ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন কোটি টাকা। আর সারাবছর ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা।”
যশোর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে ফুলের রাজধানী খ্যাত গদখালীর ছোট্ট এ বাজার। সূর্য ওঠার আগেই প্রতিদিন চাষি, পাইকার ও মজুরের হাঁকডাকে মুখর হয়ে ওঠছে।
পাইকারদের কেনা ফুল সকাল থেকেই বিভিন্ন পথের বাসের ছাদে স্তূপ করে সাজানো হচ্ছে, পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা-চট্টগ্রামের মত বড় শহরে ট্রাক-পিকআপ ভ্যান ভরে ফুল যাচ্ছে।
প্রতিদিন গড়ে অর্ধকোটি টাকার ফুল বিকিকিনি হচ্ছে জানিয়ে আব্দুর রহিম বলেন, দেশে বিভিন্ন উৎসবে যে পরিমাণ ফুল বেচাকেনা হয়, তার ৭৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় যশোরে। এবার চাহিদা বেশি, চাষিরাও আগাম প্রস্তুতি রেখেছেন।
“এই মুহূর্তে ফুলের দাম কম তারপরও বেচাকেনা ভাল হওয়ায় আমরা খুশি। উৎসবকে সামনে রেখে ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম-সবই ভাল হবে এমনটি আশা করছেন এ অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা।”
গদখালির ফুলচাষি সাইফুল ইসলাম এ বছর এক বিঘা জমিতে জারবেরা ও রজনীগন্ধার চাষ করেছেন।
তিনি বলছিলেন, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে ফুল চাষিদের জন্য সেটা কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমরা এখন ফুলের ভালো দাম না পাওয়ার শঙ্কায় ভুগছি। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে অনুষ্ঠান বা জাতীয় দিবসগুলো জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন হয় না। তাই ক্রেতা পর্যায়ে আমাদের ফুলের চাহিদা ও বিক্রি কমে যায়।
“তারপরও বাজার ধরার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করি, দিবসগুলোতে ফুলের দাম আরো বাড়বে।”
ঝিকরগাছার নন্দী ডুমুরিয়া গ্রামের ফুলচাষি গোলাম রসুল বলেন, এবার তিনি ছয় বিঘা জমিতে গোলাপ, জবা, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাসের পাশাপাশি জারবেরার চাষ করেছেন।
দু’দফা বৃষ্টিতে ফুলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন আবহাওয়া ভাল থাকায় বাগানে আগের চেয়ে বেশি ফুল এসেছে। ফলে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন গোলাম রসুল।
এক বিঘা জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করেছেন মিজানুর রহমান। তার ভাষায়, বিভিন্ন রংয়ের গোলাপ এবার কৃষকের ঘরে ‘বিশেষ উপহার’ হয়ে এসেছে।
হাড়িয়া মাঠে নিজের গোলাপ ক্ষেতে কাজ করছিলেন লোকমান হোসেন।
তিনি বলেন, “আবহাওয়া ভাল থাকলে এ মৌসুমে অন্তত ১৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারব। এবার তিন বিঘা জমিতে গোলাপ ও এক বিঘা পাঁচ কাঠা জমিতে গাঁদা ফুলের আবাদ করেছি।”
পানিসরা মাঠে কথা হয় ফুলচাষি আজিজুর রহমান সরদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, “এ বছর রেকর্ড তাপমাত্রার পর অতিমাত্রায় বৃষ্টির কারণে মাঠের অধিকাংশ ফুল খেত নষ্ট হয়ে যায়। পরে কিছুটা হলেও ফুলের বাগান ঠিক করেছি। এই মৌসুমে চার বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা, দেশি গোলাপ, চায়না গোলাপ ও গাঁদা ফুলের চাষ করেছি। এ ছাড়া ১৮ কাঠা জমিতে নতুন করে জারবেরার চাষ করেছি।”
আজিজুর জানান, এ মৌসুমে যদি রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো থাকে এবং প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হয় তাহলে এসব ক্ষেত থেকে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করেন তিনি।
ঝিকরগাছার কাগমারী গ্রামের রকিবুল ইসলাম বলেন, গত দুদিনে তিনি পঞ্চাশ হাজার টাকার জারবেরা বিক্রি করেছেন।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে বিদেশি এ ফুলের চাহিদা বাড়ায় গদখালীতে বিক্রিও বেড়েছে।
এক বিঘায় গোলাপ ও দুই বিঘায় গ্ল্যাডিওলাসের আবাদ করেছেন হাড়িয়া নিমতলা গ্রামের আসলাম হোসেন।
তিনি বলেন, এক বিঘা গোলাপ আবাদে খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। প্রথম বছর ৪০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে, তবে তাতে সাত থেকে আট বছর ফুল পাওয়া যাবে। প্রতি বছর দেড় লাখ টাকার ফুল বিক্রি করা যাবে।
এবার প্রতি বিঘায় উৎপাদিত ফুল চাষিরা গড়ে ৭০-৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন আসলাম।
গদখালী বাজারে এক পাইকারের সঙ্গে দর কষাকষি করছিলেন সৈয়দপাড়ার আতিয়ার রহমান।
ফুলের বাজার কেমন জানতে চাইলে এক গুচ্ছ গোলাপ হাতে তুলে দিয়ে বলেন, দুই দিনে ৭৫ হাজার টাকার বেশি গোলাপ বিক্রি করেছেন।
আর পটুয়াপাড়ার সাহেব আলী শুধু সোমবারই বিক্রি করেছেন ৪০ হাজার টাকার লাল গোলাপ।
ঝিকরগাছার হাড়িয়া গ্রামের চাষি শাহাজাহান আলী জানালেন, তিন দিনে ৫০ হাজার টাকার জারবেরা, এক লাখ টাকার গ্ল্যাডিওলাস ও গোলাপ বিক্রির কথা।
এখানে বাজারে রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস ছাড়াও জিপসি, ক্যালেন্ডুলা, ডালিয়া, লিলিয়াম, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানা জাতের ফুল বিক্রি হচ্ছে।
গদখালী বাজারে ফুল কিনতে আসা ফুল ব্যবসায়ী শাহাদৎ হোসেন বলেন, “ফুলের বাজার খুব ভাল। ৫০ হাজার টাকার ফুল কিনেছি, আরো কিনব।”
ফুল ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বলেন, অন্য সময় এক হাজার গাঁদা ফুল ৬০০-৭০০ টাকায় কিনলেও আজ কিনেছেন ৪০০ টাকায়।
সোমবার গদখালি ফুলের বাজারদর প্রসঙ্গে ‘ফুলের বাজার ডটকম’ নামক অনলাইনের তরুণ ফুল উদ্যোক্তা মো. আল আমিন বলেন, গদখালী ফুল বাজারে গোলাপ ফুল প্রতিটি পাঁচ টাকা, চায়না গোলাপ লংস্টিক রোজ ১০ টাকা, রজনীগন্ধা স্টিক ছয় টাকা, গ্লাডিওলাস ফুল কালার ভেদে ১২-১৫ টাকা, জারবেরা ফুল ১৪ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা তিন থেকে চার টাকা, গাঁদা ফুল প্রতি হাজার ৪০০ টাকা, জিপসি ফুল প্রতি আঁটি ১০০ টাকা ও কামিনী পাতা প্রতি আঁটি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় ৬৩০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুলচাষের সঙ্গে এখানকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কৃষক এবং প্রায় এক লাখ শ্রমিক সম্পৃক্ত রয়েছে।
তিনি জানান, এ বছর ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা এবং অন্যান্য ফুলচাষ করা হচ্ছে প্রায় ছয় হেক্টর জমিতে।
ফুলচাষিরা জানান, গদখালী অঞ্চলের এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে ১১ ধরনের ফুল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। এই এলাকার ছয় হাজার পরিবারের দেড় লাখ মানুষ ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত।
প্রতিবছর উৎপাদিত হয় ৩৫০ কোটি টাকার ফুল। বছরের অন্যান্য সময় ফুলের দাম পাওয়া গেলেও বর্ষাকালে সেগুলো তেমন বাজারে বিক্রি হয় না। তখন শ্রমিকের খরচ না ওঠায় চাষিরা ফুল গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তবে ব্যতিক্রম কেবল এবার ফুলের উৎপাদন কম হওয়ায় কৃষকরা ফুলের দাম বেশি পেয়েছে।