কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী বললেন, বাজারে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৮০ টাকায় বিক্রি করতে হবে; সরবরাহও যথেষ্ট।
Published : 20 May 2023, 08:58 PM
কুষ্টিয়ার বাজারে সাত দিনের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৩০ টাকা। সবশেষ এক মাসে তিন দফায় বেড়েছে এর দাম।
অথচ ‘দামী’ এই পেঁয়াজ চাষ করে এই জেলার বেশিরভাগ কৃষককে গুনতে হচ্ছে লোকসান। বাজারে সরবরাহ থাকলেও এভাবে দাম বেড়ে যাওয়াকে পাইকার ও আড়তদারদের কারসাজি বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় পেঁয়াজ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেকেই লোকসানে পড়েছেন। এবার আবহাওয়ার কারণে তুলনামূলক কম পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। আবার সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় মাঠ থেকে তুলেই পাইকারদের কাছে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন সেই পেঁয়াজই অতিরিক্ত দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
খলিসাকুন্ডি বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা সলেমান খাজা বলেন, গত মাসে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ২৫-৩০ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ আগেও দাম ছিল ৫০-৫২ টাকা। শনিবার হঠাৎ করে আড়তেই পেঁয়াজের কেজি প্রতির দাম হয়ে গেছে ৭৫-৮০ টাকা।
কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৮০টাকায় বিক্রি করতে হবে। যথেষ্ট সরবরাহও রয়েছে।
পাইকার ও আড়তদাররা এক ধরনের কারসাজি করেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন বলে তাদের অভিযোগ।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া বাজারের খুচরা বিক্রেতা মওলা বিশ্বাস বলেন, “মাঠ থেকে পেঁয়াজ তোলার পর নিজের সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ রেখে বাকিটা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন স্থানীয় সব চাষি। এখন চাষিদের কাছেও বাড়তি পেঁয়াজ নেই। এখন পেঁয়াজের বাজার সব বড় এবং পাইকারী ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে।”
বাজারে পেঁয়াজের খুব বেশি যে চাহিদা রয়েছে তা মনে করেন না এই ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, “আমাদের এলাকায় যে পেঁয়াজ হয় তা চাষিরা তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দেয়, কারণ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এজন্য এখন দেশের অন্যান্য স্থান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে বিক্রি করতে হচ্ছে।”
পেঁয়াজ চাষে লোকসানের বিষয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন চাষির সঙ্গে। তারা প্রত্যেকেই লোকসানের কথা জানিয়েছেন।
খলিসাকুন্ডি এলাকার চাষি ইংরাজ মণ্ডল জানান, এ বছর তিনি এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন। চাষে মোট খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। এই জমিতে পেঁয়াজ পেয়েছেন ৬০ মণ। প্রতি মণ ৬০০ টাকা কেজি দরে ৩৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ মুনাফা তো হয়ইনি, উল্টো চার হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।
মৌসুমে পেঁয়াজের দাম পাওয়া যায় না উল্লেখ করে এই চাষি বলেন, “আমি ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। আর এখন বাজারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ৭৮-৮০ টাকা। তাহলে চাষ করে কী লাভ হবে?”
মিরপুর উপজেলার ক্ষুদ্র পেঁয়াজ চাষি সোহেল রানা বললেন, প্রতি বছরই ৫ কাঠা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেন। সেখান থেকে নিজেদের খাওয়ার জন্য কিছু রেখে বাকিটা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বণ্টন করেন। গত বছর যে জমি থেকে ৭ মণ পেঁয়াজ পেয়েছিলেন, এবার সে জমিতেই মাত্র ১২ কেজি উৎপাদন হয়েছে।
একই ধরনের কথা জানালেন পোড়াদহ এলাকার চাষি আনন্দ। তিনি বলেন, “এবার ফলন ভালো হয়নি। তিন বিঘা জমিতে ২০০ মণ পেঁয়াজের আশা নিয়ে চাষ করেছিলেন। সেখানে পেয়েছি মাত্র ৭০ মণ। আমার তো জমির খরচই ওঠেনি।”
জমি, বীজ, সার, কীটনাশক, পরিচর্যা ও পরিবহন দিয়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ২৫-৩০ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানালেন কুমারখালী উপজেলার কৃষক ইন্তাজ আলী। তিনি বলেন, অথচ বিক্রি করতে হয়েছে ১৫-২০ টাকায়। বড় বড় মজুতদাররা কৌশলে চাষিদের কাছ থেকে সব পেঁয়াজ কিনে গুদামে ঢুকিয়ে এখন ইচ্ছামত দাম হাঁকাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে ১৩ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে কুষ্টিয়ার ছয়টি উপজেলায় ১২ হাজার ১৩১ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। সে হিসেবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৬০৪ হেক্টর কম জমিতে আবাদ হয়েছে। এর আগে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে চাষ হয়েছিল।
এবার তাপমাত্রার কারণে কিছু এলাকায় পেঁয়াজের ফলনে ঘাটতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ।
তিনি বলেন, “চাষি পর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় তারা মাঠ থেকে তুলেই বাজারে বিক্রি করে দেন। এতে দাম কম পাওয়া যায়। তবে কৃষকরা যেন পেঁয়াজ চাষে আরও আগ্রহী হয় এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।”
এরই মধ্যে প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষকদের বিনামূল্যে পেঁয়াজের বীজসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের পেঁয়াজ চাষে উদ্বুদ্ধও করা হচ্ছে।
বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি নজরে এসেছে বলে জানালেন জেলা বাজার কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান।
তিনি বলেন, “হঠাৎ করে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই পেঁয়াজের বাজার দর অস্বাভাবিক উর্দ্ধগামীর বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি। আগামী ৫/৭ দিনের মধ্যে আমাদানি করা পেঁয়াজ বাজারে ঢুকে যাবে। এরপরেও দশি পেঁয়াজের বাজার দর সহনীয় পর্যায়ে না এলে সরকার হার্ডলাইনে যাবে বলে এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ।”
আরো পড়ুন :
দাম বাড়লে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি ‘শিগগিরই’: কৃষিসচিব
আমদানির ‘হুঁশিয়ারিতেও’ এক মাসে পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৮০
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদে ১৬ কোটি টাকা প্রণোদনা