এবার আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’বিহীন ভোট-কৌশলের পরীক্ষা

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্দলীয় পরিচয়ে ভোট করার সুযোগে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, স্থানীয় সরকারের ভোটে ভোটারদের উপস্থিতিও বাড়তে পারে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2024, 07:31 PM
Updated : 8 March 2024, 07:31 PM

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘ডামি’ প্রার্থীর কৌশল চমকপ্রদ ফল এনে দিয়েছিল, দুই মাসের মাথায় এবার স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রতীক না দেওয়ার নতুন কৌশলের পরীক্ষা।   

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচন হচ্ছে শনিবার। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে হচ্ছে মেয়র পদের উপ নির্বাচন। এছাড়া ছয়টি পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের দুই শতাধিক পদে ভোট হতে যাচ্ছে এদিন।

সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকাগুলোতে ভোটগ্রহণ চলবে। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, সব ধরনের প্রস্তুতিই তারা সেরে ফেলেছেন। আইন-শৃঙ্খলা নিয়েও শঙ্কার কিছু দেখছে না ইসি। 

দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে ভোট পড়ে প্রায় ৪২ শতাংশ।

জাতীয় নির্বাচনের পর শনিবারই বড় পরিসরে স্থানীয় সরকারের প্রথম ভোট হচ্ছে। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিত কেমন হয়, সে দিকে নজর থাকবে পর্যবেক্ষকদের। 

তারা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন বা দলীয় প্রতীক দেয়নি, এটাই এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। সহিংসতা রোধ করে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটার আনতে এই কৌশল কতটা ফলদায়ক হবে, সেই পরীক্ষাও শনিবারের ভোটের মাঠে হয়ে যাবে।

আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ায় ময়মনসিংহে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়া পাঁচজনের মধ্যে চারজনই আওয়ামী লীগের। এর বাইরে আছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী, কেবল তিনিই দলীয় প্রতীকে লড়ছেন। 

কুমিল্লায় চার প্রার্থীর মধ্যে দুজনই আওয়ামী লীগের। ভোট বর্জন করা বিএনপির দুই বহিষ্কৃত নেতাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে আছেন। এই সিটিতে দলীয় প্রতীকে কোরো প্রার্থী নেই। 

কোথাও কোথাও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ থাকলেও বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত প্রচার পর্বে বড় কোনো গোলযোগ কোথাও ঘটেনি। নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু ভোট নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্দলীয় পরিচয়ে ভোট করার সুযোগে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, স্থানীয় সরকারের ভোটে ভোটারদের উপস্থিতিও বাড়তে পারে।

তবে ছোট পরিসরের এ নির্বাচন দিয়ে ভোটারদের আস্থার বিচার কিংবা জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না বলেই মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম।

আর নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলছেন, এক দল থেকে একাধিক প্রার্থী দাঁড়ালে নির্বাচনকে ‘সেই অর্থে’ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বলা যায় না। আর ভোটাররাও অনেকসময় আগ্রহ পান না।

কোথায় কীভাবে ভোট

ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন সাধারণ নির্বাচন ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের শূন্য পদে উপনির্বাচন হবে শনিবার। 

পটুয়াখালী জেলার পটুয়াখালী পৌরসভা, জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ পৌরসভা এবং বরগুনা জেলার আমতলী পৌরসভায় হবে সাধারণ নির্বাচন। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল পৌরসভা, মুন্সিগঞ্জ জেলার মুন্সিগঞ্জ পৌরসভা এবং বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র পদে উপনির্বাচন হবে। 

সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ সব মিলিয়ে স্থানীয় সরকারে বিভিন্ন পর্যায়ের ২৩৩টি পদে নির্বাচন হবে এদিন। 

জেলা পরিষদে ভোট হবে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। বাকি সব নির্বাচনে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট চলবে।

ইসির জনসংযোগ পরিচালক শরীফুল আলম জানান, পৌরসভা, জেলা পরিষদ এবং সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণ হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে। বাকি নির্বাচনগুলো ব্যালট পেপারের মাধ্যমে হবে।

দুই সিটি নির্বাচনে সাধারণ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর ১৬ জনের ফোর্স এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জনের ফোর্স মোতায়েন থাকছে। পৌরসভাগুলোতে ১২ থেকে ১৪ জনের এবং ইউপি নির্বাচনগুলোতে ২২ জনের ফোর্স নিয়োজিত করা হয়েছে। 

নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, "আইন শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। যেসব জায়গা থেকে চাহিদা এসেছে, সেখানে বেশি ফোর্স দিয়েছি। অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটও দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের যে মূল্যায়ন, তাতে পরিবেশ ভালো। আশা করি নির্বাচন ভালোভাবেই হবে। আমাদের প্রস্তুতি সব দিক থেকেই ভালো।" 

এ নির্বাচন কমিশনারের ভাষায়, সব প্রার্থীই নির্বাচনে জিততে চায়। ফলে ভোটের ক্ষেত্রে উত্তেজনা থাকেই।  

"তবে এরকম কোনো শঙ্কা নেই যে কোথাও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে, এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নাই। তারপরও সতর্কতা হিসেবে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন থেকে চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত ফোর্স দিয়েছি। পরিস্থিতি কোথাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা বন্ধ না করলে আমরা বন্ধ করে দেব।" 

ময়মনসিংহ সিটি 

  • ১২৮টি ভোটকেন্দ্র

  • ভোটার ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন

  • প্রার্থী: মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু (দেয়াল ঘড়ি), জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম (ঘোড়া প্রতীক), শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদেক খান মিল্কী টজু (হাতি প্রতীক), কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাবেক সদস্য কৃষিবিদ ড. রেজাউল হক (হরিণ প্রতীক) এবং জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল (লাঙ্গল প্রতীক)

  • ২০১৯ সালে ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী কেবল একজন হওয়ায় ভোট করতে হয়নি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ সদর আসনে ভোটের হার ছিল ৪৪% 

 কুমিল্লা সিটি 

  • ১০৫টি ভোটকেন্দ্র

  • ভোটার দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন

  • প্রার্থী: কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু (টেবিল ঘড়ি), কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার (ঘোড়া), কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনা (বাস) এবং কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম (হাতি)

  • এই সিটিতে ২০১২ সালের নির্বাচনে ৭৫%, ২০১৭ সালে ৬৪% এবং ২০২২ সালে ৫৯% ভোট পড়ে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনে ভোট পড়ে ৩৯%

নতুন কৌশল 

বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় এড়াতে আওয়ামী লীগ বেছে নেয় নতুন কৌশল। কোনো আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যাতে একলা পড়ে না যান, সেজন্য মনোনয়নের বাইরে থাকা দলের নেতাদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ খুলে দেওয়া হয়। রাজনীতির মাঠে সেটা পরিচিতি পায় ‘ডামি প্রার্থীর কৌশল’ হিসেবে। 

শেষ পর্যন্ত ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২টি; আওয়ামী লীগের প্রতীক নিয়ে ভোট করা শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ ১টি করে, কল্যাণ পার্টি ১টি, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ১১টি আসন পায়। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২ আসনে বিজয়ী হন, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ নেতা। 

জাতীয় নির্বাচনে সেই কৌশলের বিপুল সাফল্যের পর আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নেয়, স্থানীয় সরকারের সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে তারা আপাতত প্রার্থীদের নৌকা প্রতীক দেবে না। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, স্থানীয় নির্বাচনে হানাহানি রোধ করা এবং ভোটারদের কেন্দ্রে আনাই এ কৌশলের উদ্দেশ্য। 

তবে বিশ্লেষকদের কারো কারো মতে, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় অটল থাকা বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং দলটির সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে আনতেও এ কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। 

নতুন পরীক্ষা

সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলীয় প্রতীক না দেওয়াটা একটা পজিটিভ সিম্বল। কারণ দলীয় প্রতীক দিলে অনেক সময় বিদ্রোহী দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তখন তাদের মধ্যে একটা অন্য ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, যে দলই হোক।”

তার ভাষ্য, যারা দলীয় রাজনীতি না করে নির্দলীয় প্রার্থী হন, তারাই সত্যিকারের স্বতন্ত্র প্রার্থী। কিন্তু দল করেও মনোনয়ন না পেয়ে অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। সেক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে হানাহানি, মারামারি ঘটে।

কবিতা খানম বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ের ঘটনাগুলো ঘটে একেবারে ঘরে ঘরে। এতে আরো শত্রুতা বাড়ে, এমনিতেই স্থানীয় নির্বাচনে সহিংসতা হয়। তখন দল থেকেও একটা মেসেজ থাকে বিদ্রোহীদের দল থেকে বের করে দেওয়ার। তারাও একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সুতরাং আমার মনে হয়, ওপেন করে দিয়েছে এটা ভালো। এটা সহিংসতা কমাবে এবং দলের মধ্যে শৃঙ্খলা সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখবে।”

সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “স্থানীয় নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ থাকে, সবসময়ই থাকে। কারণ এটা ঘরে ঘরের নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির যে ক্রাইসিসটা থাকে, স্থানীয় নির্বাচনে সে ক্রাইসিসটা থাকে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা আবার বেশি হয়।”

তবে সিটি ভোটকে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করতে নারাজ কবিতা খানম। তিনি বলেন, “জাতীয় নির্বাচন সরকার গঠন করে, এটা কিন্তু তা না। ভোটাররা এখানে আসে, নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে ভোট দেয়। এখানে আস্থাহীনতার বিষয়টা প্রকটভাবে থাকে না।”

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু বিএনপিসহ বেশকিছু দল নির্বাচনে নেই, সে কারণেই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক না দেওয়ার কৌশল নিয়েছে।

“এই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য তারা প্রতীক বরাদ্দ না দিয়ে ওপেন করে দিয়েছে, যাতে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থীও নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। নির্বাচনটা যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না হয়। কিন্তু এটার একটা সমস্যা হচ্ছে যে, একই দল থেকে যখন একাধিক প্রার্থী দাঁড়ায়, তখন কিন্তু আবার ওই অর্থে নির্বাচনটাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বলা যায় না।”

তার মতে, কোনো নির্বাচনে তখনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে বলা যাবে, যখন সব দলের অংশগ্রহণ থাকে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, ভোটারদের মধ্যেও আগ্রহ থাকে।

“যেহেতু এখানে মোটামুটিভাবে একই দলের প্রার্থী, বিশেষ করে ময়মনসিংহে, সেটাতে তো ভোটাররা খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না। একই দল থেকে যখন একাধিক প্রার্থী থাকে, তখন সে দলের ভেতরে এক ধরনের দ্বন্দ্ব, বিভক্তির সৃষ্টি হয়। একই দলে যখন কয়েকজন প্রার্থী, তখন নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে যায়। যেটা আমরা ভাবি যে দলকে সুসংগঠিত করতে হবে, সুসংহত করতে হবে, সে জিনিসটা বাধাপ্রাপ্ত হয়।”

আব্দুল আলিমের মতে, একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, সে নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। যেহেতু বিএনপি বা অন্যান্য কিছু দল এ নির্বাচনে নেই, সে কারণে এ নির্বাচনকে ‘ওই অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক’ বলতে চান না তিনি।

“খুব সফল, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হয়ত আমরা সক্ষম হব না, যেহেতু সবগুলো দল নেই। তারপরও একেবারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে ভালো। এটা তো দুটো ছোটো নির্বাচন। নির্বাচনের স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা একটা দুটো স্থানীয় নির্বাচন দিয়ে বলা যাবে না। হয়ত বলা যাবে ময়মনসিংহের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, এটা দিয়ে পুরো দেশের চিত্রটাকে তুলে ধরা যাবে না।”

জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কৌশলের বিশ্লেষণ করে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ- জানিপপ এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র হওয়ার পথ উন্মুক্ত ছিল। এবার সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছে ক্ষমতাসীন দল।

"এটা একটা নবতর দলীয় কৌশল। নিজেদের একাধিক প্রার্থীর পাশাপাশি ভোট বর্জন করা বা বৈরী ভাবাপন্ন প্রার্থীদের নির্বাচনে রাখার প্রলোভন বলা যায়। এর মাধ্যমে একটা পরীক্ষা হচ্ছে ঠিক। এতে ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে এবং ভোটার উপস্থিতিও বাড়বে।”

তিনি মনে করেন, দলীয় প্রতীক কারো নামে না থাকায় এবং নিজ দলের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকায় জাল ভোট বা কারচুপির শঙ্কাও কমবে।

“প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানো, কারচুপি বন্ধ, বৈরীদের ভোটে আনা, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর পরীক্ষা হচ্ছে এবার। ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় সেটা আমরা দেখব। সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ভালো হতে পারে। বিশেষ করে কুমিল্লায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, ময়মনসিংহেও প্রার্থীরা ভোটার টানবে।"

জানিপপ এর টিম শনিবার দুই সিটি এবং একটি পৌরসভার ভোট পর্যবেক্ষণ করবে বলে কলিমুল্লাহ জানান।  

‘সন্দেহ নেই’ আওয়ামী লীগে

ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৌশলগতভাবে আওয়ামী লীগ ‘শতভাগ’ সফল হয়েছে, এবারও তাই হবে।

"নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করাই আমাদের লক্ষ্য ছিল, সেই ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ সফল। এবারের নির্বাচন শতভাগ গ্রহণযোগ্য হয়েছে, এবং উৎসবমুখর পরিবেশে হয়েছে।"

আর দুই সিটির ভোট নিয়ে তার ভাষ্য, “সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় নির্বাচনে আমাদের দলীয় কোনো প্রার্থী নেই। এখন কে নির্বাচনে জয় পাবে সেটা দেখার বিষয় আমাদের না। নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় সেটা করার জন্য আওয়ামী লীগ দলগতভাবে সহযোগিতা করবে। আর আমরা অবশ্যই মনে করি দলীয় প্রতীক না থাকায় নির্বাচনে সবাই অংশ নিবে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে ব্যাপক ভোটারদের উপস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের ভেট হবে।”

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের দাবি, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ‘যথেষ্ট’ ছিল, ভোটও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ হয়েছে। আর তাতে আওয়ামী লীগ কৌশলগতভাবে ‘সফল হয়েছে’।

“সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতীক না থাকায় আরও বেশি জমজমাট হবে বলে আমি মনে করি। সব ধরনের প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে আছে, যদিও রাজনৈতিকভাবে প্রকাশ্যে হিসাবটা প্রতীকের কারণে হচ্ছে না। নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এবং সব দলের ভোটাররাই ভোট দিতে আসবে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই।" 

মাঠের চিত্র

কুমিল্লা সিটির ২০২২ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা আরফানুল হকের কাছে শ তিনেক ভোটে হেরেছিলেন দুইবারের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। আরফানুল হকের মৃত্যুতে এখন সেখানে মেয়র পদে উপ নির্বাচন হচ্ছে।

গত নির্বাচনে সাক্কুর হারের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিষ্কৃত নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সারের। প্রথমবার এসেই ২৯ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন তিনি। ফলে বিএনপির ভোট ভাগ হয়ে সুবিধা পায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী। সাক্কু-কায়সারের জন্য এবারও সেই সংকট থাকবে।

আবার আওয়ামী লীগের ভোটও কিছুটা হলেও ভাগ হবে, কারণ কুমিল্লা সদরের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনা সঙ্গে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম, যিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি।

সাক্কু দুইবার মেয়র হয়েছিলেন কুমিল্লা আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা অধ্যক্ষ আফজল খান এবং তার মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে।

প্রয়াত আফজল খান আর বাহাউদ্দিন বাহারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কুমিল্লার রাজনীতিতে বহুল চর্চিত বিষয়। এই দুই নেতার দ্বন্দ্বের সুবিধা নির্বাচনে সবসময় বিরোধী পক্ষ পেয়েছে।

বলা হয়, বাহারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুফল সাক্কু দুইবার ভোটবাক্সে পেয়েছিলেন। কিন্তু ২০২২ সালের নির্বাচনে বাহার সমর্থন দেন আরফানুল হককে। আর এবার বাহারের নিজের মেয়েই প্রার্থী। 

হিসাব বলছে, দুই ‘দলের’ চার প্রার্থীর ভোটে ‘কাটাকুটির’ নির্বাচন হতে যাচ্ছে কুমিল্লায়। আর তাতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বিএনপির দলীয়ভাবে ভোটে না থাকলেও দলটির কর্মী-সমর্থকরা দুই সাবেক নেতার পক্ষে মাঠে নেমে ঘাম ঝরিয়েছেন। ফলে বিএনপিপন্থি ভোটাররাও এবার কেন্দ্রে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে ভোটের দুদিন আগে থেকে ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের ‘হুমকি’ দেওয়া হচ্ছে বলেও কুমিল্লায় অভিযোগ উঠেছে। তিন প্রার্থীও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন বাস প্রতীকের প্রার্থী সূচনা এবং তার বাবার দিকে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন ভোটের আগের দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে যেতে পারে সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।” 

মেয়র পদে কুমিল্লার মত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস ময়মনসিংহে নেই। ২০১৯ সালে ময়মনসিংহ সিটির প্রথম নির্বাচনে মেয়র পদে ভোট করতে হয়নি, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। প্রায় আড়াই দশকের নির্বাচনি রাজনীতিতে তাকে কখনও পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়নি।

এবার দলীয় সিদ্ধান্তে নৌকা না পাওয়ায় তিনি নির্বাচন করছেন দেয়াল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে। তবে ভোটের সমীকরণে পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টাচ্ছে না। 

টিটুর মত এমন একজন শক্তিশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধে তার বিরোধী পক্ষ সম্মিলিতভাবে একজনকে মেয়র পদে ভোটে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন; যারা মূলত স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহিত-উর রহমান শান্তর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু দ্বিধা-বিভক্ত জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সেটি হয়নি।

টিটুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম এবং শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদেক খান মিল্কী টজু স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহিত-উর রহমান শান্তর সমর্থন পাবেন বলে আশা করেছিলেন, কারণ টিটুর সঙ্গে শান্তর রাজনৈতিক দ্বৈরথ পুরনো। তবে এহতেশামুল বা টজুর ভোটের প্রচারে এমপির সমর্থনের নমুনা দেখা যায়নি।

টিটুর বিরোধী হিসেবে পরিচিতরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছেন। এমপি-সমর্থকদের এই বিভক্তি টিটুকে সুবিধা দেবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

মেয়র পদে বিএনপির কেউ প্রার্থী না হলেও কাউন্সিলর পদে অন্তত সাতজন প্রার্থী আছেন। দল নির্বাচনে না থাকলেও দলের সমর্থকরা ঠিকই ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন বলে আশা করছেন তারা।     

আরও পড়ুন:

Also Read: ময়মনসিংহে শেষ মুহূর্তে প্রার্থীদের জমজমাট প্রচার

Also Read: কুমিল্লায় সরগরম ভোটের প্রচার শেষ পাল্টাপাল্টি অভিযোগে

Also Read: ময়মনসিংহ-কুমিল্লা সিটি ভোট: মনোনয়ন জমা ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত