কুমিল্লায় সরগরম ভোটের প্রচার শেষ পাল্টাপাল্টি অভিযোগে

বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় শেষ হয় ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচার; শনিবার নতুন মেয়র নির্বাচনে ভোট দেবেন প্রায় আড়াই লাখ নগরবাসী।

মাসুম বিল্লাহও আবদুর রহমান. কুমিল্লা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2024, 03:59 PM
Updated : 7 March 2024, 03:59 PM

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন উপ-নির্বাচনে ভোটের প্রচার; দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণই ছিল প্রচারের সময়। 

তফসিল অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় শেষ হয় ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচার; শনিবার নতুন মেয়র নির্বাচনে ভোট দেবেন প্রায় আড়াই লাখ নগরবাসী। 

দলীয় প্রতীকবিহীন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই নেতা এবং বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কৃত ‍দুই নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। 

গত ডিসেম্বরে মেয়র আরফানুল হক রিফাতের মৃত্যুতে মেয়র পদটি শূন্য হয়েছে। ২০২২ সালের ১৫ জুন ভোটে জিতে দেড় বছরের কম সময় পদে ছিলেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। 

উপ-নির্বাচনে নতুন নগরপিতা বাছাইয়ের ভোটে আবারও লড়ছেন দুই বারের সাবেক মেয়র, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মনিরুল হক সাক্কু, যাকে হারিয়ে মেয়রের পদে বসেছিলেন রিফাত। তার প্রতীক টেবিল ঘড়ি। 

২০২২ সালের ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রথমবার নির্বাচনে নেমে ২৯ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে সাড়া ফেলে দেওয়া মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিষ্কৃত সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার এবারও ভোটের মাঠে আছেন ঘোড়া প্রতীক নিয়ে। 

বাস প্রতীক নিয়ে লড়ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসীন বাহার সূচনা; তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে। 

মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়েছেন হাতি। 

ভোটের প্রচারের শেষদিন বৃহস্পতিবার মিছিল, মাইকিং আর স্লোগানে-স্লোগানে নগরবাসীদের কাছে যান প্রার্থী এবং তাদের কর্মী-সমর্থকরা; নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্ব স্ব মার্কায় ভোটারদের সমর্থন চান তারা। 

সরগরম নগরীর বিভিন্ন অলিগলি ছেয়ে আছে প্রার্থীদের নির্বাচনি পোস্টার-ব্যানারে; এক্ষেত্রে বাস এবং ঘোড়া প্রতীকের প্রচারণা কার্যক্রমের আধিক্য দেখা যায়। 

প্রচারের পুরো সময়ের মতো শেষদিনেও প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ করেছেন। 

ভোটারদের হুমকিধমকি দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর বেশি বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থক এবং প্রার্থীর বাবা এমপি বাহারের দিকে। 

তবে, বাস প্রতীকের প্রার্থী তাহসীন বাহার সূচনা বলছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশকে ‘বিতর্কিত’ করার জন্য এসব অভিযোগ করা হচ্ছে। 

বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে হুমকিধমকির অভিযোগ করে সাবেক মেয়র সাক্কু বলেন, “প্রতিদিন ১২টায় বাস মার্কার ওরা অহেতুক আমার কর্মীদের বাসায় গিয়ে খারাপ ব্যবহার করে, কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বলে। 

“২৭টা ওয়ার্ডের সিটি করপোরেশনের সবাই সবাইকে চেনেন। এই ১২ নম্বর ওয়ার্ডে যারা আওয়ামী লীগ করে তাদেরকে আমি চিনি, যারা বিএনপি করে তাদেরকেও আওয়ামী লীগের লোকেরা চিনে। সুতরাং এগুলি না কইরা, কাদা ছোঁড়াছুড়ি না কইরা, সবাই ভোটারের কাছে গিয়ে ভোট চান, যাতে তাদের মুল্যবান ভোটটা পান।” 

নির্বাচন কমিশনের কাছে বৃহস্পতিবার অভিযোগ দিয়ে ঘোড়া প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট অভিযোগ করেছেন, বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থকরা তাদের কর্মীদের উপর হামলা এবং কার্যালয় ভাঙচুর চালিয়ে যাচ্ছে। 

হাতি প্রতীকের প্রার্থী, আওয়ামী লীগ নেতা তানিমও এমপি বাহারের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “কেবল একজন মানুষ ভোটকে বিতর্কিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি চাচ্ছেন, যেন ভোটাররা কেন্দ্রে না আসেন। 

“এজন্য ভোটারদের বাড়ি বাড়ি লোক পাঠিয়ে তাদেরকে হুমকি দিচ্ছেন। কুমিল্লার মানুষ ভোটের মাধ্যমে এর সমুচিত জবাব দেবেন।” 

প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নে বাস প্রতীকের প্রার্থী সূচনা সাংবাদিকদের বলেন, “ইভিএমে যদি ভোট ‍লুট করার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে না আসলেও ওই দুই প্রার্থী কোন ভরসায় ভোটে এসেছেন? এই ভোটে নির্বাচন কমিশনের অধীনে এসেছেন। এটা নির্বাচনের একটা সুষ্ঠু পরিবেশকে বিতর্কিত করা ছাড়া আর কিছুই নয়।” 

কোন প্রার্থীর প্রচার কোথায়, কী বক্তব্য 

শেষদিন বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম মার্কেটের সামনে ভোটের প্রচার শুরু করেন বাস মার্কার প্রার্থী সূচনা। 

এরপর প্ল্যানেট এসআর শপিং কমপ্লেক্স ও লিবার্টি চত্বর হয়ে সাত্তার খাঁন কমপ্লেক্স, খন্দকার হক টাওয়ার, সোনালী স্কয়ার ও রাজগঞ্জ বাজারের পথসভায় বক্তব্য দেন তিনি। 

এসময় বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষের কাছে গিয়ে ভোট চান তিনি। উন্নয়নের মধ্য দিয়ে স্মার্ট নগরী গড়ার প্রতিশ্রুতি ভোটারদের দেন এমপি বাহারের মেয়ে। 

কান্দিরপাড়-রাজগঞ্জ সড়কে এক পথসভায় সূচনা বলেন, “সবার কাছে দোয়া চাই একটি সম্মানের জায়গায় বসে যেন কাজের মাধ্যমে আপনাদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারি। আপনারা দায়িত্ব দিলে স্মার্ট বাংলাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে কুমিল্লাকে একটি স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলব। একটি সুন্দর নিরাপদ সবার বাসযোগ্য নগরী গড়ব।” 

তিনি বলেন, “আগামী ৯ তারিখ আপনাদের একটি ভোট কুমিল্লায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। এবারের  নির্বাচন  শুধু  নির্বাচন নয়, একটা সংগ্রাম আন্দোলনও বটে। এ  আন্দোলন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অপরাজনীতির বিরুদ্ধে ও অপরিকল্পিত নগরের বিরুদ্ধে।” 

সন্ধ্যায় ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের শাহেপানুয়া ঈদগাহ মাঠে শেষ নির্বাচনী উঠান বৈঠকে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন বাস প্রতীকের প্রার্থী। 

সকাল থেকে পুরো সময় নানুয়ার দিঘির পাড়ের বাসভবনে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী সাক্কু। 

এরপর নিজের এলাকা ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটের প্রচারে নামেন সাবেক এই মেয়র; প্রচারের সময় তাকে অনেকে ফুলেল শুভেচ্ছাও জানান। 

ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত এই নেতা বলেন, “ভোটাররা যাইতে চায় না। বললে বলে, আপনি কি ভোটটা রাখতে পারবেন? গতবারও দিছি রাখতে পারেন না। আমি অভয় দিই, সবসময় দিন একই রকম যায় না। আপনারা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটকেন্দ্রে যান, ইনশাল্লাহ এবার আমরা ভোট রাখার চেষ্টা করব।” 

প্রচারের সময়ের পরিবেশ নিয়ে এক প্রশ্নে সাক্কু বলেন “এটাতো উপ-নির্বাচন। যদি পুরো নির্বাচন হত, কাউন্সিলর থাকত, আরও উৎসবমুখর হইত, কারণ তারা নিজস্ব কিছু ভোট আনে। 

“এটা শুধু উপ-নির্বাচন, আমরা চারজন যে যতটুকু পারতেছি, ভোটারদের কাছে যাইতেছি। আমি আমার মত করতেছি, উনারা উনাদের মতো করতেছে, কীভাবে জানি না। এক পার্টিতো আছে, ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বলতেছে। উনারা ভয় পাইতেছে, বলতেছে, ‘ভোট কেন্দ্রে যায়েন না। ভোট দেওয়া হয়ে গেছে, আমরা সরকার পার্টি, আমরা পাস কইরামই’ এসব কথাবার্তা বলে।” 

এদিন সকাল ১০টার দিকে নগরীর ধর্মসাগর দিঘি ও কান্দিরপাড় এলাকায় গণসংযোগ করেন ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার। এছাড়া নগরীর বেশ কয়েকটি স্থানে উঠান বৈঠক ও গণসংযোগ করেছেন তিনি। 

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে কুমিল্লাবাসী নতুন নেতৃত্ব চায় মন্তব্য করে কায়সার সাংবাদিকদের বলেন, “মানুষের ভেতের কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য আগ্রহ আছে। সারা কুমিল্লার মানুষ মুক্তি চায়, দানবীয় শাসনের অবসান চায়।” 

হাতি প্রতীকের প্রার্থী তানিম শেষদিনে নগরীর থিরাপুকুর পাড়সহ কয়েকটি স্থানে গণসংযোগ করেছেন। এছাড়া নিজ বাসায় থেকে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেন তিনি। 

গণসংযোগে বেরিয়ে তানিম বলেন, “কুমিল্লার মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। গত ৪০ বছর ধরে আমি কুমিল্লার মানুষের জন্য কাজ করছি। মেয়র পদে যেতে পারলে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে কুমিল্লাবাসীর দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আমি চালাব।” 

এই সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ করা হবে। 

শুক্রবার কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটের সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়ার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।