এতদিন মাছ, মাংস, ডিমের দাম নিয়ে যে হাহাকার ছিল, তা ভুলে এখন এক বাটি সবজিও পাতে তুলতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
Published : 01 Nov 2023, 12:52 PM
কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা শুনলে যে কেউ অবাক হবেন। সেই বিস্ময়কর কৃষি উৎপাদনের দেশে বেশিরভাগ সবজির কেজি কেন ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলছে না। অথচ আগে আমাদের কৃষি উৎপাদন এত বেশি ছিল না। তবু ভরা মৌসুমে বেগুন এবং মূলার মতো সবজি ক্রেতার অভাবে গবাদি পশুকে খাওয়ানো হতো। মিষ্টি কুমড়া, জাতি লাউ, চাল কুমড়া—খুব একটা বেচাকেনার সবজি ছিল না। এখন এসবের কেজিও পঞ্চাশ টাকার ওপরে।
এসব আসলে অতীত নিয়ে সামান্য ঘাটাঘাটি মাত্র। যদিও এমন সোনালি অতীতের গল্প আরও অনেক আছে। সেদিকে না গিয়ে কিছু রাজকীয় হিসাবপত্রের কথা বলি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে আছে চাল, মসুর ডাল, আলু, পেঁয়াজ ও চা। যদিও ফলও আছে, তার কথা বাদ দিলাম। এছাড়া কুমড়া, ফুলকপি সমজাতীয় কিছু কৃষিপণ্য এবং শিম উৎপাদনেও বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। চাল এবং রসুন উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। মসুর ডাল উৎপাদনে ষষ্ঠ। পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি উৎপাদনে সপ্তম।
আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ সাত নম্বরে। যে আলু অন্তত সাত টাকা, তের টাকা কেজিতে মানুষ এই সরকারের আমলেই কিনেছে তার দাম বেড়ে এখন ষাট টাকা। সরকার প্রাণান্ত চেষ্টা করেও দাম কমানোর জন্য ব্যবসায়ীদের বাগে আনতে পারেনি। অথচ আলুর দাম এত সস্তা ছিল যখন তার চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। দুই দশকে বিশ্বে সেই বিশতম দেশ থেকে আলু উৎপাদনে সাত নম্বরে বাংলাদেশ। আর যে মরিচের কেজি পাঁচশ টাকার ওপরে চলে গিয়েছিল সেই মরিচ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বলেও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে। ফুলকপি ও ব্রকলি এবং মটরশুঁটি উৎপাদনে নবম। মসুর ডাল উৎপাদনে ষষ্ঠ।
এসবই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গত মার্চের দেওয়া তথ্য, ২০২১ সালের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে। কথা হচ্ছে এত এত উৎপাদনের মধ্যে দাম না কমে বহুগুণ বেড়েছে কেন? যদি আলুর কথাই ধরি। ২০ বছর আগে আলু উৎপাদন হতো প্রায় ১৫ লাখ টন। এখন কমবেশি এক কোটি টন আলুর উৎপাদন হয় দেশে। ২০ বছর আগের তুলনায় আলুর উৎপাদন প্রায় সাতগুণ বাড়লেও আলুর দাম না কমে বেড়েছে কেন? এই সময়ে দেশের মানুষ তো সাতগুণ বাড়েনি। মানুষের আয়-রোজগারও বাড়েনি এতটা।
বাস্তব ও যুক্তিসম্মত দাম রাখার ক্ষেত্রে সরকারের আসলে কোনো লক্ষ্য আছে কিনা জানা নেই কারও। কারণ কোনো সুপরিকল্পনা ছাড়া খাদ্য রপ্তানিকারক দেশের তকমা অর্জন করতে চায় দেশ। প্রায় ১০/১২টি দেশে আলু রপ্তানি করে বাংলাদেশ। সরকারের ২০ শতাংশ ভর্তুকির কারণে গত বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রায় ৪০ গুণ বেশি আলু রপ্তানি হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। আলু দিয়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন লাভজনক ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। যা মানুষের মৌলিক খাদ্যপণ্য নয়। আলুর এমনই বহুমুখী ব্যবহার শুরু হয়েছে উন্নয়নের ছোঁয়ায়। পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকারের উচিত বাজার মূল্যের এই বৈষম্য দূর করা। এখন চাল ও আলুকে টেক্কা দিচ্ছে অনেক সবজি। তাও চলেছে দীর্ঘদিন ধরেই।এর মধ্যে কোনো কোনো সবজি কেনা অনেকের ক্ষেত্রেই কষ্টকল্পনা মনে হচ্ছে। বিষয়টি শ্বাসরুদ্ধকর।
বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনে শীর্ষে গিয়ে কোন ধরনের লাভ হচ্ছে তাহলে। বেশি উৎপাদন হেতু যেখানে সুলভ হবার কথা সেখানে দিন দিন অগ্নিমূল্য দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকের হয়তো লাভ হচ্ছে এতে। তবে জনগণ মাছ, মাংস, ডিম নয় অন্তত স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাকসবজিও কিনে খেতে না পারে তাহলে এই লাভ দিয়ে কী হবে!
২০২৩ সাল শেষের দিকে প্রায়। ২০২২ সালে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে ২০২৩ সালে খাদ্যসঙ্কট তথা খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এক ইঞ্চি জায়গাও খালি না রাখতে। করোনার সময় থেকে তিনি এই কথা বলে আসছিলেন। এর মধ্যে ২০২৩ সাল আমরা অতিক্রম করতে চলেছি। এই দুর্দিনে নির্বাচন উপলক্ষে আরও ভয়াবহ দুই মাস সামনে আছে।
এতদিন মাছ মাংস ডিমের দাম নিয়ে যে ফরিয়াদ ছিল, তা ভুলে এখন এক বাটি সবজিও পাতে তুলতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের মানুষই বিশ্বে সবচেয়ে কম শাকসবজি খেয়ে থাকে এমনটা বলা হয়। ভেতো বাঙালির অপবাদ আছে। সেই কমের মধ্যেও আরও কমে যাচ্ছে সবজি খাওয়া। আর চালের দাম বাড়তে বাড়তে গত কয়েকমাস ধরে স্থির থাকলেও সবচেয়ে কমদামি চালও পঞ্চান্ন থেকে ষাট টাকা কেজি। এক সময় সবজি আর আলু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতো চালের ওপর চাপ কমাতে। কী ভেবে, কোন পরিকল্পনায় সেই পরামর্শ ছিল কে জানে! এখন সেই আলু আর সবজির দাম চালের অগ্নিমূল্যকেও টপকে যাচ্ছে।
যদি ধরে নেওয়া হয় আমাদের উৎপাদনের সক্ষমতা এতটুকুই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার কী হবে? মানে বাকি থাকা অনাবাদি জায়গাটুকুও শেষ হয়ে গেলে এই চড়ামূল্যের সবজি বাজার কি আরও লেলিহান আগুনের মতো হবে। সরকার ডিম, আলু, পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়ে দেখেছে। ভয় তো দূরের কথা নিশঙ্কচিত্তে ব্যবসায়ীরা তাতে কানও দেয়নি। তারপরও মূল্যবৃদ্ধি করে চলেছে ইচ্ছামতো। মানে কার কাছে কে ফরিয়াদ করে—বোঝা দায়, যেন গায়েবি কারবার।
মূল্যবৃদ্ধির একটা কারণ হচ্ছে দীর্ঘসময় ধরে মূল্য বাড়তে থাকা পণ্যটির ঘাটতি। আলুসহ সবজির দাম বৃদ্ধির সঙ্গে ঘাটতির বিষয়টিও উঠে আসছে মনে হয়। এই ঘাটতির কারণ কি বহুবিধ কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের শীর্ষে থাকা বা শীর্ষে থাকার প্রবণতা। যেসব সবজি ও কৃষিপণ্যে আমরা অভ্যস্ত নই তার চাষাবাদের কারণে আমাদের দরকারি কৃষিপণ্য এবং শাকসবজির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
অনেক কৃষিপণ্য উৎপাদনে শীর্ষে থেকেও যদি দেশের জনগণের চাহিদা না মেটে তবে সেই শীর্ষে থাকাটা কতটুকু টেকসই! যা ইচ্ছা তা উৎপাদন করার আগে দেশের মানুষের মূল খাদ্যপণ্যের বার্ষিক উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। আর দশ-বিশটা কৃষিপণ্যে শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশ হয়ে লাভ কি যদি একটা পণ্যও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় না থাকে। একইসঙ্গে শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশের তকমার মর্যাদা রক্ষা করতে শীর্ষ জন্মহারের লাগামটাও টানতে হবে। খাদ্য ঘাটতির জন্য এটাই অশনি সংকেত। ওই লাগাম টানার জন্য জনগণকে যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদানের সাহসও থাকতে হবে। এরকম অপ্রতিরোধ্য পণ্যমূল্য তুলনামূলক বিশ্বের কাছে মুখ দেখানোর ক্ষেত্রেও খারাপ নজির।আর ব্যবসায়ীদের ছাড় দেয়ার সংস্কৃতি সর্বত্র সাধারণ ভোক্তার জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। বাজারে ক্রেতা এখন বিক্রেতার কাছে দাসতুল্য হয়ে উঠেছে।
কৃষকের হাত থেকে যে কোনো পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সরকারের দায়িত্ব। যেসব হিমাগার মালিকরা সিন্ডিকেট করছে তাদের হিমগারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরকম প্রক্রিয়াজাতকরণ জনগণের জন্য কাল হয়েছে কিনা তা-ও ভেবে দেখা দরকার। আর কৃষকদেরকে নিত্য প্রয়োজনীয় ফসল ফলানোর জন্য উৎসাহিত করতে হবে। কারণ পণ্যমূল্য লাগামহীন হওয়া মানে ঘাটতি তৈরি হয়েছে কোনো না কোনোভাবে।
সাধারণ যে চাল, আলুর স্বনির্ভরতা নিয়ে আমাদের গৌরব সেটাও এখন হাতছাড়া হচ্ছে।জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশের খাদ্যশক্তির দ্বিতীয় প্রধান উৎস আলু। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টির উন্নতির অন্যতম কারণও ছিল আলু। সেই আলুর বর্তমান দাম গত বছরের তুলনায় ৫৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি এখন সব ধরনের সবজিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সবকিছুই যদি খাদ্য সঙ্কট বা ঘাটতির আলামত বলে মনে করা হয়, তাহলে দেশের মানুষকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।