স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিবেশ, ভোটারদের উপস্থিতি কিংবা ফলাফল কোনোটি দিয়েই জাতীয় নির্বাচনকে মাপা যাবে না কিংবা এটিকে নির্বাচনের মডেল হিসেবেও ধরে নেয়া যাবে না।
Published : 26 Jun 2023, 12:53 PM
হিসেব অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর পাঁচ মাস। কারণ ডিসেম্বরেই নির্বাচন হওয়ার কথা। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এখনও তাদের মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে সরে আসেনি। আর অন্যদিকে গত কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে চলেছে সরকারপক্ষ। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, এই সরকারের অধীনেও ভালো নির্বাচন সম্ভব। তবে হিসেব-নিকেশও অনেকেই করছেন। আওয়ামী লীগের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কিনা—এ বিষয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক।
জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশনের ভোট শেষ করেছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। তবে এর কোনো নির্বাচনেই বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক দলের প্রার্থীরাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। গাজীপুর নির্বাচনকেই বিশ্লষণ করলে আমরা সেখানে কয়েকটি চিত্র স্পষ্টই দেখি। সেখানে যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন তিনিও আওয়ামী পরিবারের লোক। তার সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। সেখানে প্রতিযোগিতা হয়েছে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যেই। তবে এখানে যে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট করা প্রার্থীটিকে জিতিয়ে দিতে ভোট দিয়েছে এ নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। এই ধারাবাহিকতায় গাজীপুর, খুলনা ও বরিশালের পর শেষ ধাপে ভোট হয়েছে সিলেট ও রাজশাহী সিটিতে।
এই পাঁচ সিটিতে ভোট হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনের দাবি অনুযায়ী সিসি ক্যামেরা ছিল সকল ভোটকেন্দ্রে এবং নির্বাচন কমিশন তা প্রত্যক্ষ করেছেন। নির্বাচনগুলোতে তেমন বড় কোনো সহিংসতা হয়নি।
ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ক্ষমতাচর্চা এবং তাদের পক্ষে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার চিত্র এই পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তেমন একটা ছিল না। কারণ হয়তো অনেক। যদিও অনেকের বিশেষ করে গণমাধ্যমের ধারণা, গাজীপুর নির্বাচনের আগে আমেরিকা বাংলাদেশ বিষয়ে নতুন যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছিল, তার প্রভাব পড়েছিল নির্বাচনে। আবার কেউ কেউ বলেছেন বিরোধীদল বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে খুব বেশি তোড়জোড় দেখানো হয়নি। বরং সরকারের পক্ষ থেকে তাগাদা ছিল সফল নির্বাচনের নমুনা সবার সামনে, বিশেষ করে কয়েকটি দেশের সামনে হাজির করা। সেই তাগাদায় ছিল বিরোধীদলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে নাকচ করার অভিপ্রায়ও।
তবে এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের মেজাজ-মর্জি কিংবা ফলাফল কোনোটিই মূল্যায়ন করা যাবে না। কারণ এই নির্বাচন সরকার পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখে না। এর আগে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখনও আমরা দেখেছি স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। শুধু এই পাঁচটি নির্বাচনেই নয় এর আগের অনেকগুলো স্থানীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। কিন্তু সেটি দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের কোনো কিছু ঠাহর করা যায়নি।
তবে এই নির্বাচনগুলোতে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি না থাকলেও সাড়া ফেলেছে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ইসলামী দল বিএনপি জোটে অবস্থান করলেও চরমোনাই কখনও এই জোটে ছিল না। কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর ভোট অনেককেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তবে কি ইসলামী দলগুলো ভেতরে ভেতরে তাদের জনসমর্থন তৈরিতে কাজ করছে?
একথা আমাদের মানতেই হবে যে, গত দুই বছর ধরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের চেষ্টা ছিল বিএনপি জোট থেকে ইসলামী দলগুলোকে বের করে নিয়ে আসা। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিন ধরে চলা মধুর সম্পর্কে চিড় ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নিয়ে। রাজনৈতিক দল না হয়েও গত কয়েক বছর বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে হেফাজত মাঠে ছিল। মামুনুল হকসহ হেফাজতের আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেফতার হেফাজতের রাজনীতিকে কিছুটা কঠিন করে ফেলে এবং সরকারের প্রতি তাদের নতজানু মনোভাব তৈরি করে। তবে একথা বলাই যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর গুরুত্ব অনেকখানি। আর ওই কারণেই, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে ততবেশি এই দলগুলোকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হবে, আর হবে দর কষাকষি।
বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জামায়াতে ইসলামী। তবে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরদার হলে আদর্শগতভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে জামায়াত ইসলামী। মূলত তখন থেকেই রাজনৈতিকভাবে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। যদিও এর আগেই আর্থাৎ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই তাদের জনসমর্থন কমে যাওয়া অনেকটাই স্পষ্ট হচ্ছিল। জামায়াতের রাজনীতিতে ভয়াবহ ছোবল আসে ২০১৩ সালে। ওই বছরের ১ অগাস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় বাংলাদেশের হাইকোর্ট। যার কারণে এরপর থেকে বাংলাদেশের কোনো স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে, এমনকি দলীয় ব্যানারে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতেও এই দলটিকে দেখা যায়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের রাজপথে কর্মসূচি দেয়ার চেষ্টা নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯। এর মধ্যে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে ১০টি। এ দলগুলোর নেতাদের সবাই যে ব্যক্তিগত ক্যারিশমাতে সমান সামর্থ্য রাখেন তা নয়, তবে জোটের তাপে ক্ষমতাশীল হয়ে উঠতে পারেন এবং রাজনীতির মাঠে দুশ্চিন্তা এবং তুষ দুটোই ছড়াতে পারেন এরা। জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে জিতে আসা এই ইসলামী দলগুলোর পক্ষে সুদূর পরাহত, তবে জোটভুক্ত হয়ে তারা ভোটের ময়দানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে কাজে লাগানো থেকে নানা ধরনের উস্কানিও তৈরি করতে পারে। অন্তত এই ছয় মাস এই দলগুলোর কদর থাকবে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
সবই এখনকার হিসেব। বাকি ছয় মাসে এই হিসেব আরও ঘনীভূত হতে পারে কিংবা অনেকটাই পাল্টে যেতে পারে। তবে সবই নির্ভর করছে নির্বাচনের আরও নানা ধরনের খানা-খন্দের ওপর। কিন্তু এটি ঠিক যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিবেশ, ভোটারদের উপস্থিতি কিংবা ফলাফল কোনোটি দিয়েই জাতীয় নির্বাচনকে মাপা যাবে না কিংবা এটিকে নির্বাচনের মডেল হিসেবে ধরে নেয়া যাবে না। সেই হিসেব বড় কড়া, বড় অঙ্কের।