জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক থেকে ঢাকা শহর অস্ট্রেলিয়ার সিডনির চেয়ে বেশি। ফ্রান্সের প্যারিসে বিদেশিদের বসবাস করা যতটা ব্যয়বহুল, ঠিক সমপরিমাণ ব্যয় হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবসম্পদ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মার্সার প্রকাশিত একটি তালিকায় এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
Published : 06 Feb 2025, 05:39 PM
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হলো। ৩১ জানুয়ারি জ্বালানি তেলের দাম পুনর্র্নিধারণ করেছে সরকার। প্রতি লিটারে দাম বাড়ানো হয়েছে এক টাকা। নতুন নির্ধারিত দাম ১ ফেব্রুয়ারি থেকে থেকে কার্যকর হয়েছে। এর আগে গেল ৩১ ডিসেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে এক টাকা করে কমানো হয়েছিল।
তখন ডিজেলের বিক্রয়মূল্য প্রতি লিটার ১০৫ টাকা থেকে এক টাকা কমিয়ে ১০৪ টাকা, কেরোসিন ১০৫ টাকা থেকে এক টাকা কমিয়ে ১০৪ টাকা পুননির্ধারণ করা হয়। তবে প্রতি লিটার অকটেন ১২৫ টাকা ও পেট্রোল ১২১ টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। আমাদের দেশের চাক্ষুষ বাস্তবতা হলো জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর ফল–নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি! আর এর ফলাফল হয় সার্বিক মূল্যস্ফীতি।
মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরণের মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়। মুদ্রাস্ফীতি বলতে বোঝায় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়া, যা সাধারণত মুদ্রার অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে ঘটে থাকে। সহজ ভাষায় বললে, একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুদ এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায় অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায় তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর সহায়তায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপাল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৮ নভেম্বর এ প্রসঙ্গে গভর্নর সাংবাদিকদের বলছিলেন, তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে ঋণ দিচ্ছে সবল ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে ৬টি ব্যাংককে (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অফ বাংলদেশে পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি) তারল্য সহায়তা দিয়েছে। টাকা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে এ সহায়তা দেওয়া হয়। অথচ দায়িত্ব নেওয়ার আগে দেশের অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির জন্য গভর্নর মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্তকে বেশ সমালোচনা করতেন।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ২৯ জানুয়ারি দেশে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দলকে বলেছেন, উত্তরাধিকারসূত্রে তার সরকার ‘বিপর্যস্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত‘ একটি অর্থনীতি পেয়েছে। বলতেই হয়– ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাজুক অবস্থা। পুঁজিবাজার পতনবৃত্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। রপ্তানির চাকা ঘুরছে না। বিনিয়োগ আশাব্যঞ্জক নয়। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ভোক্তার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারার ব্যর্থতায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, শুধু প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছাড়া দেশ অর্থনীতির সব সূচকই নিম্নমুখি। মূল্যস্ফীতি বাড়ছেতো বাড়ছেই। এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, যা পরিবহন খরচ বাড়াতে প্ররোচিত করবে মালিকদের। এতে ন্যূনতম হলেও প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যের ওপর।
অর্থনীতিতে পড়েছি জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারের কথা– ব্রিটিশ অর্থনীতি ও জনমিতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস পড়তে গিয়ে। সতরো শতকের অর্থনীতির এই পণ্ডিত বলেছেন, মানুষ বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্য বাড়ে গাণিতিক হারে। জ্যামিতিক হার হলো ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২ এবং গাণিতিক হার হলো ১, ২, ৩, ৪, ৫। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্তে এ হারের কথা মনে পড়ে গেল।
দাতাদের পরামর্শ অনুয়ায়ী যদিও তা আগেই বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু এই মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সকল পণ্যে পড়বে। পরিবহন খরচ বাড়বে। যাতায়াত খরচ বাড়বে। জ্বালানিনির্ভর উৎপাদনকারী অতিরিক্ত খরচ আদায় করে নেবে ভোক্তা বা ক্রেতার কাছ থেকেই। মূল্য বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব হলো সাধারণ জনগণেরই নাভিশ্বাস! অর্থাৎ পরিবহন ভাড়া এবং উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা পণ্যের দাম বাড়াবে জ্যামিতিক হারে। আমাদের দেশে মূল্যবৃদ্ধি বা অতি মুনাফাখোর মানুষের সংখ্যা অনেক। সরকার কোন পণ্যের দাম ২ টাকা বাড়ালে ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতায় টমাস রবার্ট ম্যালথাসের জ্যামিতিক হারকে অনুসরণ করেন। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকলেও দেশের অভ্যন্তরে তা বাড়ানো হয়। সরকারের মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা নতুন নয়।
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে রাখা যাচ্ছেই না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। টানা আট মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে আছে। বাজারে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন। শীতের শুরু থেকে বাজারে শাকসবজির সরবরাহ বাড়লেও এখন পর্যন্ত দাম তেমন কমছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপও কাজ করছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। সর্বোচ্চটা ছিল গত জুলাই মাসে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে স্কুল ব্যাংকিংয়েও। দেশে প্রায় তিন বছর ধরে গড় মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। অর্থনীতির পরিভাষায় মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি কম হলে সেটি অর্থনীতির সংকটকে ইঙ্গিত করে। দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে লোকজনের আয় কমে গেছে। এতে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশের শিক্ষা ব্যয়ও বাড়ছে প্রতি মাসে। এর প্রভাব পড়েছে স্কুল শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়েও। গেল অর্থবছরের শেষের দিকে অর্থাৎ জুন মাসে কিছুটা প্রবৃদ্ধি থাকলেও নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমছে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়। এক মাসের ব্যবধানে সঞ্চয় কমেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত চার মাসে সঞ্চয় কমেছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক এর সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের অক্টোবর মাসে স্কুল শিক্ষার্থীদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮৭ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল দুই হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে আমানত কমেছে ৪৮ কোটি টাকা। এর আগের বছর ২০২৩ সালের মে শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২২৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে কমেছে প্রায় ১০১ কোটি টাকা। গত জুন মাসে ছিল দুই হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে চার মাসে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় কমেছে ২৩৮ কোটি টাকা।
বিশ্বের ব্যয়বহুল শহরের একটি হলো ঢাকা। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক থেকে ঢাকা শহর অস্ট্রেলিয়ার সিডনির চেয়ে বেশি। ফ্রান্সের প্যারিসে বিদেশিদের বসবাস করা যতটা ব্যয়বহুল, ঠিক সমপরিমাণ ব্যয় হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবসম্পদ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মার্সার প্রকাশিত একটি তালিকায় এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
পণ্য ও যাত্রী পরিবহনকারী ট্রাক ও বাসে ব্যবহৃত ডিজেল বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত জ্বালানির অন্যতম প্রধান পণ্য। আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ওপর সকল পণ্যের দাম নির্ভর করে। এই সেই দেশ যেখানে একবার কোন দ্রব্যের দাম বাড়লে পরে তা কমার ইতিহাস নেই। অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপর ৫ মাস আগে সব ধরনের জ্বালানির দাম লিটারে ১.২৫ টাকা থেকে ৬ টাকা কমানো হলেও পরিবহন খরচ বা ভাড়া কমায়নি দেশের পরিবহন মালিকরা। জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণ কমানো হয়েছিল সে সময়; দেশের বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। অথচ ১ টাকা বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দ্রুতই। যখন তেলের দাম কমানো হয়েছিল, তার সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেতে পারত পণ্যমূল্য– সাধারণ জনগণ তাই ভেবেছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের বাজারে যে প্রভাব দেখা যায়, মূল্য হ্রাসে সে প্রভাব পড়ে না। জ্বালানি তেল এমন একটি পণ্য যার মূল্য বাড়লে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পায়। চাষাবাদ থেকে শিল্প-কারখানা পরিচালন– সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জ্বালানি। তাই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম আরেক দফা বেড়ে যাবে। আর এর প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতি মোকাবেলায় দুর্ভোগ পোহাতে হবে সৎ ও সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষকে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ বা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নিদারুণ কষ্টের কথা, কষ্টার্জিত জীবনের কথা ভাবছে না কেউ। বরং সামর্থ্যবান শ্রেণির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। ফলে ধনী আর্থিকভাবে আরো লাভবান হচ্ছে, আর দিনে এনে দিনে খায় শ্রেণির মানুষের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের কারণে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ চরম কষ্টে জীবন নির্বাহ করছে। সৎভাবে বাঁচার উপায় কোথায়? অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের পথ থাকছে না। ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেই থেকে যাচ্ছে।