গত ৫২ বছরে সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যদের কথা বলার স্বাধীনতায় অগ্রগতি কতটুকু? ১৯৭২ সালে গণপরিষদে কী ধরনের বিতর্ক হয়েছে? এর পরবর্তী সংসদগুলোয় কতটা প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়েছে আর সাম্প্রতিক ইতিহাস কী বলছে?
Published : 05 Jun 2024, 02:50 PM
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যেদিন (১০ জানুয়ারি ১৯৭২) বীরের বেশে দেশে ফিরলেন, তার পরদিনই তিনি সাময়িক সংবিধান আদেশ বলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পদেক্ষপ নেন। এই প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনের পেছনে যুক্তি দেখানো হয় যে, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই উক্ত আদেশ জারি করা হয়েছে। (মওদুদ আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ইউপিএল/১৯৮৩, পৃ. ১১)।
সংসদীয় শাসনব্যবস্থার মূল শর্ত ও সৌন্দর্যই হলো সংসদীয় বিতর্ক। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও সংখ্যালঘিষ্ঠ, এমনকি বিরোধী দলের চেয়ারে যদি একজনমাত্র সদস্যও উপবিষ্ট থাকেন, তাকেও যথেষ্ট পরিমাণে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়— যার উদাহরণ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সংসদের যাত্রা শুরুর আগেই ১৯৭২ সালে গঠিত ‘গণপরিষদ’। যে পরিষদ নতুন রাষ্ট্রের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিল।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের গত ৫২ বছরের সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যদের কথা বলার স্বাধীনতায় অগ্রগতি কতটুকু? ১৯৭২ সালে গণপরিষদে কী ধরনের বিতর্ক হয়েছে? এর পরবর্তী সংসদগুলোয় কতটা প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়েছে আর সাম্প্রতিক ইতিহাস কী বলছে?
সংসদীয় বিতর্ক
রাষ্ট্রপতির ভাষণ, জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়, উত্থাপিত কোনো প্রস্তাব বা বিলের ওপর সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়, সেটিকেই সংসদীয় বিতর্ক বলা হয়। এই বিতর্কে সদস্যরা নিজ নিজ বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি ও অন্যের বক্তব্যের জবাবে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এই বিতর্ক পার্লামেন্টকে স্বচ্ছতা দান করে।
পার্লামেন্টে বিতর্কের যেমন সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, তেমনি আছে নির্ধারিত সময়। বিতর্কের পরিণতিতে বিষয়টি ভোটে দেয়া না-দেয়া অথবা প্রস্তাব গ্রহণ বর্জনও হয়। সকল সদস্যকে সংসদ পরিচালনার গাইডলাইন কার্যপ্রণালিবিধি মেনে বিতর্কে অংশ নিতে হয়। এজন্য স্পিকারের অনুমতি নিতে হয়। একই সময় একাধিক সদস্য বক্তব্য রাখতে চাইলে স্পিকার যিনি আগে আগ্রহ দেখিয়েছেন তাকে সুযোগ দেন। বিতর্কের সময় স্পিকারকে সম্বোধন করে (মাননীয় স্পিকার বা Honorable Speaker বলে) বক্তব্য রাখতে হয়। (জালাল ফিরোজ, পার্লামেন্টারি শব্দকোষ, বাংলা একাডেমি/২০১০, পৃ. ৬৪)।
সংসদে কথা বলার স্বাধীনতা
সংসদে কথা বলার স্বাধীনতা সদস্যদের একটি বিশেষাধিকার। উপমহাদেশে এই স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। ব্রিটিশ-ভারতে প্রবর্তিত ১৯১৯ সালের ভারত শাসন বা মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও সংসদে সদস্যদের ইচ্ছেমতো কথা বলার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘সংসদে বা সংসদের কোনো কমিটিতে কিছু বলা বা ভোটদানের জন্য কোনো সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’
অর্থাৎ সংসদে একজন সদস্য যে কোনো বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে স্বাধীন। তার ওই বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার সুযোগ থাকলেও সংসদে দেয়া বক্তব্যের কারণে কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ নেই। অথচ ওই একই বক্তব্য সংসদের বাইরে দিলে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। এটিই হচ্ছে সংসদ সদ্যদের বিশেষ অধিকার বা প্রিভিলেজ। তবে সংসদে কথা বলার এই অবারিত স্বাধীনতা থাকা মানেই সংসদ সদস্যরা যা খুশি বলেন বা বলবেন, বিষয়টি এমন নয়। আইন ও সংবিধানে যাই বলা হোক না কেন, নীতি-নৈতিকতা ও রেওয়াজ মেনেই সদস্যরা কথা বলেন। তারা চাইলেই যা খুশি বলতে পারেন না। সেজন্য তাদেরকে সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি মানতে হয়।
একজন সদস্যের কথা বলার স্বাধীনতা আছে মানে তিনি সংসদে যা খুশি বলতে পারেন কিনা, এই প্রশ্নে ভারতে বিতর্ক উঠলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংসদে সদস্যের ইচ্ছামতো কথা বলার স্বাধীনতা সংরক্ষিত থাকে। সদস্যের সংসদে বলা কথা বা তার দেয়া ভোট নিয়ে কোনো আদালত কোনো কার্যধারা সৃষ্টি করতে পারবে না বলে আদালত রায় দেন। তবে আদালত এও বলেন যে, সদস্যদের কথা বলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত হবে সংবিধানের নির্দেশ, কার্যপ্রণালী বিধি ও স্পিকারের কর্তৃত্ব দ্বারা। অর্থাৎ আদালত সদস্যদের বাকস্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে না পারলেও সংসদীয় রীতিনীতি, সদস্যের ব্যক্তিগত বিবেচনা বোধ, স্পিকারের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। (পার্লামেন্টারি শব্দকোষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৫)।
গণপরিষদে সুরঞ্জিতের স্বাধীনতা
সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একাই প্রচুর কথা বলেছেন। সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদ নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেশি সময় পাচ্ছেন বলে কোনো কোনো সদস্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭২ সালের ২৩ অক্টোবর গণপরিষদে বলেন, ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটি বিশিষ্ট দলের বিশিষ্ট সদস্য এবং একমাত্র পার্লামেন্টারি সদস্য। সেই হিসাবে তাকে তার দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বক্তব্য পেশ করার জন্য স্পিকার যে সুযোগ দিয়েছেন, এতে আপত্তি করার কোনো কারণ নেই। কেননা একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটু বেশি সময় পেতেই পারেন।’ (ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, সিসিবি ফাউন্ডেশন/২০১৪, পৃ. ১৬৯)।
গণপরিষদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এই বাড়তি সময় পাওয়া বা দীর্ঘ বক্তৃতার প্রসঙ্গে বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘সংবিধান বিলের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেশ দীর্ঘ ও তীব্র বক্তৃতা দিতেন। বঙ্গবন্ধু একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি সুরঞ্জিতের বক্তব্য শুনছি কি না। বললাম, মাঝে মাঝে শুনি। তিনি হেসে বললেন, ‘‘১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে কনস্টিটিউশন নিয়ে আমি যেসব কথা বলেছি, সেসব কথাই এখন সুরঞ্জিত আমাকে শোনাচ্ছে। তখনকার হাউজের ডিবেট পড়ে দেখো।’’ (আনিসুজ্জামান, বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা/২০১৫, পৃ. ৬০)।
তার মানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধানের খসড়ার ওপরে যে দীর্ঘ ও ‘তীব্র’ বক্তৃতা দিতেন, তাতে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুরও সায় ছিল।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ভিন্নমতসূচক মন্তব্য বা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। শুধু তিনি একা নন, এই কমিটির আরও পাঁচজন সদস্য সংবিধানের ওপর এই নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় গণপরিষদ সদস্যরা কথা বলা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করেছেন এবং তাদের কথার কতটুকু মূল্যায়ন হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
লারমা ও ‘বাঙালি’ বিতর্ক
সংবিধানের খসড়ায় ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ছিল: বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। কিন্তু সংবিধান বিলের ওপর দফাওয়ারি আলোচনায় ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকা-১২ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া এই অনুচ্ছেদে একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনে বলেন, ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’
এ সময় স্পিকার মুহম্মদুল্লাহ প্রস্তাবটির বিষয়ে পরিষদ সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইন ও সংসদীয় বিষয়াবলি এবং সংবিধান-প্রণয়ন-মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার সাহেব, এই সংশোধনী গ্রহণযোগ্য বলে আমি মনে করি এবং এটা গ্রহণ করা যেতে পারে।’
কিন্তু এর বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তিনি স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। সবদিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দ পুরুষ— কেউ বলেন নাই, আমি বাঙালি। আমার সদস্য-সদস্যা ভাইবোনদের কাছে আমার আবেদন, আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়’...
লারমার কথা শেষ না হতেই স্পিকার তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না?’
উত্তরে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেন, ‘আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোনোদিনই নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।’
এটুকু বলার পরে স্পিকার তাকে বসতে বলেন। এই বিষয়ে বিরোধী দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ফ্লোর নিয়ে কথা বলতে চাইলে স্পিকার তাকে সুযোগ দেননি। তারপরও সুরঞ্জিত বলেন, ‘রাজ্জাক ভুঁইয়া সাহেব যে সংশোধনী এনেছেন তাতে মনে এ প্রশ্ন জাগে যে, বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া ভারতের কেউ বাস করছে। বাঙালি বলতে এইটুকু বোঝায় যে, যারা বাংলা ভাষা বলে।’ সুরঞ্জিত এটুকু বলার পরে স্পিকার তাকে বসতে বলেন এবং প্রস্তাবটি ভোটে দেন। কণ্ঠ ভোটে সংশোধনী প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায় এবং বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলে পরিচিত হবেন— এই বিধানটি সংবিধানে যুক্ত হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে মানবেন্দ্র লারমা পরিষদ থেকে ওয়াকআউট করেন।
এদিন এই ইস্যুতে সৈয়দ নজরুল ইসলামও বক্তব্য রাখেন। বলেন, ‘বাঙালি-পরিচয়ের প্রতিবাদে যাদের নাম করে এই পরিষদ-কক্ষ পরিত্যাগ করে চলে গেছেন, তারা বাঙালি জাতির অঙ্গ। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ৫ লক্ষ উপজাতি রয়েছে, তারা বাঙলি। তারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অঙ্গ বলে আমরা মনে করি। বাবু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি বাংলা বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। এ কথা স্বীকার করার পরেও কেন তিনি চলে গেলেন, তা যদি তিনি বলতেন, তাহলে আমি এই পরিষদে তার জবাব দিতে পারতাম। তার অনুপস্থিতিতে বলছি বলে এ কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। ঐ পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা অধিবাসী, তারা এই স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই অঙ্গ। আমরা চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিকরা সারা বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিকের সমমর্যাদাসম্পন্ন হবে। তা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫ লক্ষ অধিবাসী বাঙালি জাতির গর্ব হিসাবে থাকবে। ত্রিশ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়েছে। সেই অধিকারের সংগ্রামে এবং সেই সংগ্রামের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যে একাত্মতা অনুভব করে নাই, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।’ (গণপরিষদ বিতর্ক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩৯)।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে এই সংশোধনী পাশের কয়েকদিন আগে ১৯৭২ সালের ২৬ অক্টোবর গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনায় সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এ এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, ‘আমার পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাইরাও অধিকার পাবেন। কোনো অংশ হতেই তারা বঞ্চিত হবেন না। বাঙালি হিসাবে আমরা বেঁচে থাকব। একটা জাতির অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে বৈচিত্র্য অনেক বেশি, মাধুর্য অনেক বেশি। এই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে শুধু এক জাতি, এক কৃষ্টি, এক সংস্কৃতি— তা নয়। বহু অঞ্চলে বহু মানুষ আছে, তাদের নিজস্ব অনেক কিছু আছে। শত বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকব। কিন্তু সর্বোপরি থাকবে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদ অক্ষুণ্ণ রেখে সেই জাতির অভ্যন্তরের প্রতিটি মানুষের প্রতি আমরা সম-দৃষ্টি রেখে আমাদের জাতীয়তাবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করব।’
তার মানে আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলে বিবেচিত হবেন বলে সংশোধনী প্রস্তাব আনলেও এটি যে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের চিন্তায় আগে থেকেই ছিল সেটি কামারুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুলের মতো নেতাদের বক্তৃতায় স্পষ্ট। কেননা সংশোধনী প্রস্তাবটি উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ড. কামাল হোসেনও এটি মেনে নেন। এই ইস্যুতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কথা বলতে চাইলেও স্পিকার তাকে সময় দেননি। এমনকি স্পিকার নিজেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না?’ তাছাড়া জাতীয়তাবাদ (বাঙালি) যে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হবে, সেটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের আগেই ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দেয়া ভাষণে ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে সমাবেশে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উপস্থিত ছিলেন। (সময়রেখায় বঙ্গবন্ধু, শিলালিপি/২০২১, পৃ. ২৩৩)। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলে পরিচিত হবেন— এই বিধানটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি কেন শুরুতেই উল্লেখ করল না? কেন এটি একজন সদস্যের সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে পাশ করতে হলো?
বিতর্ক যা-ই থাক, এ বিষয়ে ড. আনিসুজ্জামানের ভাষ্য: ‘পাহাড়ি জনসমষ্টির স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি সেদিন আমরা বুঝতে পারিনি। মানবেন্দ্র লারমাও সেদিন পাহাড়ি ও চাকমা প্রায় সমার্থক করে ফেলেছিলেন, অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেননি।…পাহাড়িদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য যে সেদিন আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হইনি, এ ছিল নিজেদের বড়োরকম এক ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রেরণা পেয়েও যে পাহাড়ি জাতীয়তাবোধের বা চাকমা জাতীয়তাবোধের সূচনা হতে পারে, এ-কথা একবারও আমাদের মনে হয়নি। নিজেদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যে আমরা তখন বেশিদূর দেখতে পারছি না, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরে অন্য কোনো জাতীয়তাবোধ স্বীকার করতে পারছি না, বরঞ্চ তাকে সন্দেহের চোখে দেখছি। ৬ অনুচ্ছেদের ওই ছোট্ট সংশোধনীকে উপলক্ষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতিত্বের সঙ্গে পাহাড়িদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যে-বিরোধ সেদিন সূচিত হলো, তার ফল কত সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, তা এখন আমরা জানি। (বিপুলা পৃথিবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯)।
৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা বাহাত্তর সালেই
সংসদ সদস্য পদ বাতিলসম্পর্কিত সংবিধানের যে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এখনো বিতর্ক হয় এবং যে বিধানকে সংসদ সদস্যদের কথা বলা তথা তাদের স্বাধীন মত প্রকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করা হয়, সেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় গণপরিষদ গঠনের কালেই।
১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ বাংলাদেশ কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি মেম্বারস (সেসেশন অব মেম্বারশিপ) অর্ডার নামে যে আইনটি করা হয়, সেখানে বলা হয়, ‘গণপরিষদের যেসব সদস্য নিজ দল থেকে পদত্যাগ করবেন বা যাদের নিজ দল থেকে বহিষ্কার করা হবে, তারা আর পরিষদের সদস্য হিসেবে থাকতে পারবেন না।’
এই আদেশের প্রস্তাবনায় বলা হয়, যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকর ভূমিকার (ইফেক্টিভ ফাংশনিং) ওপর নির্ভরশীল, তাই তা নিশ্চিত করার জন্য আইনটি করা হয়েছে।’
সংবিধান বিলের ৭০ অনুচ্ছেদে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হলে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে সংসদ সদস্যদের পদ বাতিল সম্পর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে বললাম, অন্য দেশের সংবিধানে এমনটি নেই। পরে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমরা আরো কয়েকজন আলোচনা করি। কিন্তু তিনি বললেন, ‘এদেশের মানুষকে আমি জানি। অনেকেই লোভে পড়ে ব্যক্তি স্বার্থে এদিক ওদিক করে। সুষ্ঠুভাবে দেশ চালাতে গেলে গণতন্ত্রের সঙ্গে স্থিতিশীল সরকার দরকার’।”
কমিটির জ্যেষ্ঠতম সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমানও ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে নিজের আপত্তির কথা জানান। তিনি এ বিষয়ে সংবিধান বিলের সঙ্গে নোট অব ডিসেন্ট দেন। শুধু তিনি একা নন, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরও চারজন সদস্য (আছাদুজ্জামান খান, এ কে মুশাররফ হোসেন আখন্দ, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ও সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত) ৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করেন।
হাফেজ হাবীবুর রহমান বলেন, ‘গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোথাও কোনো রাজনৈতিক দল থেকে বহিষ্কারের কারণে সংসদের সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায় না। সংসদ সদস্য পদের এই ধরনের অবসান কেবল একটি স্বৈরাচারী শাসনে পাওয়া যায়, যেখানে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বিরাজ করে। একজন সংসদ সদস্য ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন, দলের সদস্যদের দ্বারা নন। একবার তিনি নির্বাচিত হলে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য হন এবং তখন তিনি কেবল তাঁর রাজনৈতিক দলের সদস্য থাকেন না। সদস্য পদ বাতিলের এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে দলীয় একনায়কত্ব এবং দলের নেতার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা পায়।’
হাফেজ হাবীবুর রহমানের মতে, কোনো দলের কখনোই জনগণের রায় অর্থাৎ নির্বাচন বাতিল করার অধিকার থাকতে পারে না। দলের নেতারা যেখানে তাদের রাজনৈতিক আচরণের জন্য ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ নন, সেখানে একজন সংসদ সদস্য তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।
দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কার্যকরী সদস্যকে নিয়ন্ত্রণমূলক শাস্তি প্রদানের বিধানের প্রয়োজন হয় তাহলে ভোটারদের মাধ্যমে তা করার (রিকল) ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই দল কর্তৃক বহিষ্কারের ভিত্তিতে সদস্যপদ বাতিলের মতো জঘন্য ব্যবস্থা থাকতে পারে না। এ ধরনের ব্যবস্থা বহাল থাকলে দলীয়ভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয়ে সদস্যরা সংসদীয় দলের বৈঠকেও দলের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাবেন না। অধিকন্তু, আমাদের দেশে সংসদীয় নেতা ও দলীয় নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম, রীতি বা প্রথা গড়ে ওঠেনি। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে একজন দলীয় নেতা ও সংসদীয় নেতা আধিপত্য বিস্তারের জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের বা সমর্থকদের দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে অথবা শুধু প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এবং সেখানে দলীয় নেতার প্রিয়ভাজনকে স্থলাভিষিক্ত করতে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হতে পারে। সুতরাং দল কর্তৃক বহিষ্কারের কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের এমন একটি ঘৃণ্য বিধান একটি দলের মধ্যেও অনেক দ্বন্দ্ব ও অচলাবস্থার জন্ম দেবে। দলীয় শৃঙ্খলা এবং নির্বাচনী এলাকা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা সব সময় একই নয় এবং কখনো কখনো তা সাংঘর্ষিক হতে পারে।
তবে আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ব্যাপারে মত দিলেও তিনি এটিকে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে এরকম অনুচ্ছেদ যুক্ত করা একরকম অনিবার্য ব্যাপার। এটি আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কুফল থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। এর ফলে দলকে ভেঙে সংসদে আরেকটি দল গঠন ও ব্যক্তিগত বিবেচনায় দলীয় আনুগত্য পরিবর্তন করা রোধ হবে এবং এটি এই দেশে সঠিক সংসদীয় অনুশীলন ও প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। তবে এ দেশে সংসদীয় রাজনীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন জনমত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড গাইড করবে এবং কোনো সদস্য জনমতকে উপেক্ষা করে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না, তখন এ ধরনের বিধানের কোনো প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করি না।’
তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি সংবিধানে এরকম বিধান যুক্ত করতেই হয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের পরামর্শ দেন মুন্তাকীম চৌধুরী। এজন্য তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হলেই কারও সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধান নিয়ে আরও আলোচনার প্রস্তাব দেন। কেননা তার মতে, এই বিধানটি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির জন্ম দিতে পারে।
এরকম বাস্তবতায় ৭০ অনুচ্ছেদের এই বিধানটি বাতিল করে তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। সেটি হলো, কোনো সংসদ সদস্য যে দলের টিকিটে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদি ভোট দেন, তবে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে এবং এই ক্ষেত্রে দলের আস্থা রয়েছে এমন সংসদীয় দলের নেতা কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে স্পিকারকে কাজ করতে হবে। তিনি মনে করেন, ৭০ অনুচ্ছেদের মতো একটি বিধান গ্রহণ করতে হলে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্লিখন জরুরি।
এই অনুচ্ছেদ নিয়ে গণপরিষদে আরও একাধিক সদস্য বক্তব্য রাখেন এবং পরে নুরুল হকের প্রস্তাবক্রমে এই অনুচ্ছেদটি সংশোধিত আকারে গৃহীত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদের ওপর তিনি যে সংশোধনী আনেন সেটি এরকম: কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না। (আসিফ নজরুল, সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১০৮)। স্পিকার এই সংশোধনীটি ভোটে দিলে কণ্ঠ ভোটে পাস হয়। অর্থাৎ দল থেকে বহিষ্কার করা হলে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধানটি বাদ দেয়া হয়— যার পেছনে সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির একাধিক সদস্যেরও ভূমিকা ছিল। তবে গণপরিষদে বিতর্কের মুখে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে কিছুটা শিথিল করা হলেও এখনও এই বিধানটিকে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে কথা বলার ক্ষেত্রে অন্তরায় বলে বিবেচনা করা হয়।
গণপরিষদের বিতর্ক কতটা প্রাণবন্ত ছিল?
খসড়া সংবিধান বা সংবিধান বিলের ওপর সাধারণ আলোচনা চলে ১৯৭২ সালের ১৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। ৮ কার্যদিবসে ১০টি বৈঠকে মোট ৩২ ঘণ্টা আলোচনা হয়। সে সময়কার ৪০৪ জন গণপরিষদ সদস্যের মধ্যে মাত্র ৪৮ জন সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৪৫ জন ছিলেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের, একজন বিরোধী দল ন্যাপের (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) এবং দুজন স্বতন্ত্র সদস্য।
গণপরিষদ বিতর্কে অংশ নেওয়া ৪৮ জনের মধ্যে ১৬ জন খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন। সাতজন নারী সদস্যের মধ্যে চারজন সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন। আওয়ামী লীগের ১৭৫ জন সদস্য বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ চেয়ে চিফ হুইপের কাছে নাম জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু বেশির ভাগই সুযোগ পাননি।
সিলেট-২১ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আব্দুল আজিজ চৌধুরী এমন অভিযোগও করেছেন যে, সদস্যদের পরিষদ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকির কারণে তারা প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজস্ব মতামত এ পরিষদে ব্যক্ত করতে পারছেন না। ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি গণপরিষদে দেয়া বক্তব্যে ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটি খবরের উধ্বৃতি দিয়ে বলেন, দ্বিতীয় তালিকার মাধ্যমে আরও কিছু আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যকে বাহির করার ব্যবস্থা হচ্ছে। এর পূর্বে আওয়ামী লীগ দলীয় পরিষদ-সদস্যদের মধ্য হতে ২২ তারিখে ১৯ জনকে বাহির করেও দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই অধিবেশন বসেছে। তাই আমি বলতে চাই, সদস্যদের বাহির করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার ফলে এই মহান পরিষদের মাননীয় সদস্যদের উপর প্রভাব পড়েছে। তাঁরা প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজস্ব মতামত এই পরিষদে ব্যক্ত করতে পারেননি। এই পরিষদ যে প্রভাবান্বিত হয়েছেন মতামত প্রকাশের ব্যাপারে, সে সম্পর্কে দেশবাসী নিশ্চিত- এই আমার বক্তব্য। (গণপরিষদ বিতর্ক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৫)।
সংবিধান বিষয়ে জনগণের মতামত নেওয়া হয়েছিল সীমিতভাবে এ সংক্রান্ত আলোচনায় অনেকেই তা বলেছেন। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, নানা সীমাবদ্ধতার পরও গণপরিষদের বিতর্ক ছিল প্রাণবন্ত, বিশদ ও জ্ঞানগর্ভ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অবাধে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন এবং গণপরিষদের বাইরের এমন কোনো বিতর্ক ছিল না, যা তিনি গণপরিষদে উত্থাপন করেননি। প্রতিটি বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি সংবিধানের বিভিন্ন বিধিবিধানের পেছনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে সরকারপক্ষকে বাধ্য করেছেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাও অনেক বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আবদুল আজিজ চৌধুরী এবং অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানে খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য আছাদুজ্জামান খানও বিভিন্ন সময়ে সাহসের সঙ্গে বক্তব্য রেখেছেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত উত্তর দিয়েছেন। ফলে কার বক্তব্য কিংবা কার সংশোধনী কতটুকু গ্রহণ করা হলো, সেই বিতর্কের বাইরে গিয়েও এটা বলা যায় যে, সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় গণপরিষদ বেশ প্রাণবন্তই ছিল এবং নানা সীমাবদ্ধতার পরও এখানের আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ককে পার্লামেন্টারি ডিবেটের একটা শুভ সূচনা বলা যেতে পারে।