বিগত স্বৈরাচার সরকারসহ প্রায় সকল আমলেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করেছে একটি অসাধু বাজার সিন্ডিকেট। মাত্র একদিনে তেলের বাজার অস্থিতিশীল করে হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি।
Published : 24 Jan 2025, 08:54 AM
ফার্মগেটের শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের সামনে একটা ভ্যানের ওপর বড় পাতিল নিয়ে বসে আছেন বসির উদ্দিন। তার অস্থায়ী খাবারের হোটেল। দোকানের সামনে একটি লাইট জ্বলছে, নিচে খাবারের তালিকায় লেখা ডিম-পোলাও ৩০ টাকা, মুরগি-বিরিয়ানি ৫০ টাকা। খুব আগ্রহ নিয়ে দাঁড়ালাম। অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর বললাম, “কেমন বেচাকিনি হয়?” তিনি বেশ অনাগ্রহ নিয়েই বললেন, “হয় কোনোরকম, পেটেভাতে চলে আরকি!”
বসির উদ্দিন একমনে ছোট খাবারের প্যাকেটে ডিম-পোলাও, বিরিয়ানি পরিবেশন করছেন আর তা কিনে নিচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, যাদের মধ্যে একটা অংশ ওখানকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এত অল্প টাকায় কীভাবে পারেন ডিম-পোলাও, বিরিয়ানি খাওয়াতে পারছেন?”
বেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসির উদ্দিন বললেন, “ভাই জিনিসপত্রের যে দাম! চাল, মাংস, ডিম, তেল, মসলার বাজার প্রায় দ্বিগুণ কিন্তু আমি তো দাম বাড়াতে পারি না, খারাপ লাগে। আগে যে পরিমাণে রান্না করতাম এখন তা পারছি না। বেচাবিক্রিও কমে গেছে। লাভও কম করি, কী আর করব বলেন? আমি এখানে বহু বছর ধরে ব্যবসা করি। আশপাশের অধিকাংশ মানুষ যারা খায় তাদের অবস্থাও আমি জানি। তাই সবাই দাম বাড়ালেও আমি আগের দামই রাখছি। দেখি কি হয়!”
মোহাম্মদপুরের সাদেক খান মার্কেটের মুরগির দোকানি ফারুক হোসেন (৪৭)। নিয়মিত তার কাছ থেকেই আমার পরিচিত প্রতিবেশী ও বন্ধুরা বাজার করেন। সেদিন মুরগি কিনতে গেলে বললেন, “ভাই আজকে মুরগি তুলি নাই।”
“কেন” উত্তরে ফারুক– ‘এত দাম চাইতেও লজ্জা লাগে”— বলে তিনি একটা লাজুক হাসি দিয়ে মাথা চুলকান। একজন মুরগি দোকানিকে বিব্রত হতে দেখে সেদিন আমিও অবাক হয়েছিলাম। যাক অন্তত একজন ব্যবসায়ীকে পাওয়া গেল যিনি তার নৈতিক জায়গাটা স্পষ্ট করলেন।
শংকরের মুদি দোকানদার সুমন (৫৮) বলেন, “কারও কোনো চিন্তা নাই দেখতেছি। আগের সরকার যে নিয়মে চলত, সবারই তো একই অবস্থা দেখতেছি। মানুষ খালি আমাদের জিগায় দাম বেশি কেন, এত লাভ করেন কেন। দেখেন এই যে চিনির বস্তা, এটা তিনশ টাকা বেশি দামে আনতে হইছে, চালের দাম বেশি, ডালের দামও বেশি। এখন আপনেই বলেন, পণ্যের দাম বাড়াইলে আমরা কী করব? কিন্তু মানুষকে কী বলব বুঝতেই পারি না।”
ধানমন্ডির স্থায়ী বাসিন্দা তানজির রহমান (৪৭) একটা করপোরেট প্রতিষ্ঠানে মধ্যম পর্যায়ের চাকরিজীবী। সপ্তাহের বাজার তিনি একবারে করেন প্রতি শনিবার। এ সপ্তাহে তিনি মাত্র একটি মুরগি কিনলেন। কারণ জানতে চাইলে বললেন, “দেখেন এত দাম দিয়ে মুরগি কিনে খাওয়াটা সত্যি কষ্টকর। আপাতত একটা নিলাম, দাম কমলে কিনব।”
রায়েরবাজারে এক মুরগির দোকানের সামনে বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তা বেগম (৩০), পেশায় গৃহপরিচারিকা। মুরগির গিলা ও কলিজা কত টাকা কেজি জানতে চাইলে দোকানদার খুব অনিচ্ছা নিয়ে, সামনে প্লেটে রাখা গিলা-কলিজা দেখিয়ে বললেন, “সবটা একসাথে নিলে দেড়শ টাকা পড়বে।” অর্ধেকটা দেয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলে দোকানি বললেন, “নিলে পুরাটাই নিতে হবে।” ভদ্রমহিলা হতাশ হয়ে বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেলেন।
রিংরোডের একটা চেইনশপের কাউন্টারের দায়িত্বরত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাদের বেচাকিনি কেমন?” তারও উত্তর, “স্যার, বিক্রি আগের তুলনায় অনেক কম। মানুষ আগে যা কিনত এখন তার প্রায় অর্ধেক কেনে।” এটার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, “মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি, জিনিসপত্রের দামও বেশি।”
এই ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক চিত্র। চিত্রটি ঠিক পূর্ণাঙ্গ নয়। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, শাক-সবজির বাজারে একবার ঘুরে এলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হলো এদেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। সব সরকারই এই একই বক্তব্য আমাদের সামনে হাজির করে, নানান কায়দায়। কিন্তু এই যে বাজার সিন্ডিকেট তার টিকিটিও কেউ ধরতে পারে না। ওইসব রাঘব-বোয়ালরা বরাবরই নিজেদের আড়াল করে রাখে। এই যে হাজার হাজার কোাটি টাকা লুটপাট করে যারা দেশকে ধ্বংসের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে তাদের ধারাবাহিকতা কি এদেশের মানুষ আর দেখতে চায়? নিশ্চয়ই না। দেশের সকল কিছু নিয়ে যখন সংস্কারের কাজ চলছে, ঠিক ওই সময়ে আমাদের ভাবতে হচ্ছে দ্রব্যমূল্য কেন নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। আজকে গরীব, নিম্ন আয়ের মানুষেরাই কেবল নয়, মধ্যবিত্তের জীবনেও দ্রব্যমূল্যের প্রভাব চরম পর্যায়ে পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের প্রভাব গিয়ে পড়ছে পরিবারের অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
বর্তমান সরকার বাংলাদেশের অনেক মৌলিক বিষয় নিয়ে কাজ করছে। দেশের আইন ও বিচার, সংবিধান, প্রশাসন, শিক্ষা, নির্বাচন আরও নানান বিষয়ে সংস্কার কাজ চলমান। তবে আমাদের মতো একটা শ্রেণিবিভক্ত সমাজে এবং যেখানে এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, নিশ্চয়ই তাদের জন্য সব থেকে জরুরি আলোচনা হলো প্রতিদিনকার খাদ্য নিরাপত্তা ও দ্রব্যমূল্য।
বিগত স্বৈরাচার সরকারসহ প্রায় সকল আমলেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করেছে একটি অসাধু বাজার সিন্ডিকেট। মাত্র একদিনে তেলের বাজার অস্থিতিশীল করে হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি। চিনির বাজার অনিয়ন্ত্রিত করা, পেঁয়াজ, আলুর বাজারের দৌরাত্ম্যও আমরা দেখলাম। এ সকল কিছুর পেছনে যে বাজার সিন্ডিকেট তা আজও কেন ভাঙ্গা সম্ভব হচ্ছে না? বাজারের ওই চাঁদাবাজি আজও কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না? পণ্য পরিবহন সিন্ডিকেট কেন ভাঙ্গা যাচ্ছে না? এই প্রশ্নগুলো খুব সঙ্গতভাবেই আমাদের সামনে এসে হাজির হচ্ছে। নাগরিক জীবন ছাপিয়ে আজ গ্রাম পর্যায়েও এই বাজার সিন্ডিকেট ছড়িয়ে পড়েছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী?
আমরা দেখছি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ তদারক ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। জেলা পর্যায়ে এসব টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে যা দেশের সব জেলা পর্যায়ে আলাদাভাবে কাজ করবে।
তাছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রতিটি জেলায় বিশেষ এ টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক হিসেবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং সদস্য সচিব হিসেবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া টাস্কফোর্সে সদস্য হিসেবে থাকবেন জেলার একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, কৃষি বিপণন কর্মকর্তা বা জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধি এবং দুজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি। টাস্কফোর্স প্রয়োজনে সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
আমরা সরকারের এই সকল সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আমরা এটাও বলতে চাই এই সকল কমিটি ও তাদের কাজের প্রভাব আমরা দেখতে চাই। একজন বস্তিবাসী কিংবা রিকশাচালকের কাছে এই খাদ্য নিরাপত্তাটাই প্রধান বিষয়। একইভাবে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জীবনের ওপর এই বাজার সিন্ডিকেটের চরম নেতিবাচক প্রভাব আর আমরা দেখতে চাই না। আমরা যেমন একটা বৈষম্যহীন দেশ ও সমাজ দেখতে চাই, তেমনি এই বৈষম্য দূর করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে তা জনসাধারণের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়া। আমরা মুখের বুলি শুনতে চাই না— চাই স্পষ্ট বাস্তবায়ন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এখন এই সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত বলে মনে করে সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ। সরকার নিশ্চয়ই মানুষের কথা শুনতে প্রস্তুত।