বিজয়ের পরে বিজয়ীর প্রধান কাজ সংযত থাকা। কেননা, বিজয়ের পরে তার অসংযত আচরণ বিজয়কে ম্লান করে দিতে পারে। এমনকি বিজয় বেহাতও হয়ে যেতে পারে।
Published : 06 Aug 2024, 05:18 PM
এটা ঠিক যে, টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বইপত্র এবং বিভিন্ন জাতীয় স্থাপনার নামে বঙ্গবন্ধুর নাম এত বেশি ব্যবহার করেছে এবং এমন সব ছোটখাটো বিষয়ে তার মতো একজন নেতার নাম ও ছবি ব্যবহার করেছে যে, তাতে তাকে মহিমান্বিত করার বদলে মানুষের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সর্বজনীন করার বদলে তাকে আওয়ামী লীগের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছে।
কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রক্ষমতায় যে দলই থাকুক, যিনি যে আদর্শ বা মত ও পথের অনুসারী হোন না কেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল—এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় বরং এর আগে প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলনে তার কী ভূমিকা—সেটি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ বললেও শেখ মুজিবুর রহমানকেই বুঝায়। অথচ এরকম একজন মানুষকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যা করেছে তাতে অনেকেই বিরক্ত হয়েছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন। হয়তো ওই বিরক্তি ও ক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় তারা শেখ হাসিনার পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলেছেন। কিন্তু কোনো ক্ষোভ বা অসন্তোষই জাতির পিতার ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলাকে বৈধতা দিতে পারে না। আমার বিশ্বাস, যারা আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করেন; যারা গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের নানাবিধ গণবিরোধী নীতি ও পরিকল্পনায় বিরক্ত—তারাও এই দৃশ্য দেখতে চাননি যে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে কিংবা তার ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হবে।
গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রখ্যাত শিল্পী শামীম সিকদারের ভাস্কর্য পার্কে ঢুকে বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ভাস্কর্যগুলোও ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে ঐতিহাসিক স্থাপনা বা ইতিাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ভাস্কর্য ও ম্যুরালগুলো ভেঙে ফেলার কী সম্পর্ক? কারা করলেন এগুলো?
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলাফল আজকের বাংলাদেশ, ওই শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছেন বা তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলেছেন—এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার, বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দাবির সঙ্গে ভাস্কর্য ভাঙার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। তাহলে এগুলো কারা করলেন?
কিছু ইঙ্গিত সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যাচ্ছে। ৫ অগাস্ট ফেইসবুক দেওয়া একজনের পোস্টে ভাস্কর্য নিয়ে লেখা পোস্ট পড়লাম। কোন চিন্তা ও আদর্শের লোকেরা অতীতে ভাস্কর্য ভেঙেছেন, তাদের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই।
সোমবার রাজধানীতে আরও যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ঢুকে লুটপাট। কারা গিয়েছিলেন সেখানে? একজন সাধারণ মানুষ, ধরা যাক তিনি আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন না—কিন্তু ন্যূনতম মানবিক বোধ, সততা ও দেশপ্রেম থাকলে তিনি কি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে লুটপাট করতে পারেন? মানুষের ক্ষোভ ব্যক্তির ওপর, স্থাপনা বা রাষ্ট্রীয় ভবনের ওপর কেন? গণভবনে ঢুকে কারা লুটপাট করলেন? গণভবনের লেকে বঙ্গবন্ধুর একটা ভাস্কর্য হাতে নিয়ে কারা সাঁতার কাটলেন? কারা ওখান থেকে সমস্ত আসবাবপত্র, শোপিস এমনকি শেখ হাসিনার শাড়িগুলো নিয়ে গেলেন? টেলিভিশন, ফ্রিজ, শাড়ি, সোফা, এসি, মাছ, ফ্যান, হাঁস, মিষ্টি, ফুলের টব এমনকি ‘গণভবন’ লেখা সাইনবোর্ডটিও খুলে নিয়ে হাসিমুখে বের হয়ে যাচ্ছেন—এমন ছবি ও ভিডিও গণমাধ্যমে এসেছে। কারা এসব নিয়ে গেলেন? তারা কি সাধারণ শিক্ষার্থী বা সমাজের ভালো মানুষ? তারা কি বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন?
কারা সংসদ ভবনে ঢুকে সবকিছু তছনছ করলেন? সংসদ ভবন একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। যেখান থেকে মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। আইন প্রণয়ন হয়। যেখানে রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ, বই ও ডকুমেন্টস থাকে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সংসদের অধিবেশন কক্ষে ঢুকে সংসদ সদস্যদের চেয়ারে বসে সিগারেট ফুঁকছেন কিছু তরুণ। এই তরুণদের পরিচয় কী? তারা কি সত্যিই সাম্প্রতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? বৈষম্যবিরোধী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের চেয়ারে বসে সিগারেট ফোঁকার কী সম্পর্ক?
বলা হয়, বিজয়ের পরে বিজয়ীর প্রধান কাজ সংযত থাকা। কেননা বিজয়ের পরে তার অসংযত আচরণ বিজয়কে ম্লান করে দিতে পারে। এমনকি বিজয় বেহাতও হয়ে যেতে পারে। বিজয়ীর অসংযত আচরণের সুযোগ নিতে পারে তৃতীয় পক্ষ। আবার কোনো তৃতীয় পক্ষও এমন সব ঘটনা ঘটাতে পারে, যার দায় গিয়ে বিজয়ীদের ওপর গিয়ে পড়ে। ফলে দুদিকেই খেয়াল রাখা দরকার।
এটা ঠিক যে, মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষের প্রতিক্রিয়ায় যখন বড় কোনো বিজয় আসে, তখন দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত কিংবা যারা নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করছেন তারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারেন। যার দ্বারা তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয়েছেন, সুযোগ পেলে তিনি এর বদলা নিতে চান। বিশ্বের অনেক সফল বিপ্লব ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরে এই ঘটনাগুলো দেখা গেছে। এরকম পরিস্থিতিতে প্রথমত বিপ্লব বা যারা পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের দায়িত্বশীলতা ও সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা জরুরি। কিন্তু যারা নৈরাজ্য প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেবেন বলে মনে করা হয়, ওই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যদি আক্রমণের শিকার হয় তখন প্রতিহিংসা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।
৫ অগাস্ট সোমবার দুপুরের পরে সেনাবাহিনীর তরফে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার খবরটি নিশ্চিত করার পরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি যেসব সহিংসতা, আগুন, ভাংচুর, লুটপাট ও প্রতিশোধপরায়ণতা শুরু হয়েছিল, সেগুলো প্রতিহত করতে রাষ্ট্রের তরফে কোনো শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি। বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কয়েকজন সেনা সদস্য বিক্ষুব্ধ মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত ব্যানার খুলে ফেলছেন। একজন বিজিবি সদস্য ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিচ্ছেন। বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কয়েকজন সেনা সদস্য বিক্ষুব্ধ মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত ব্যানার খুলে ফেলছেন। একজন বিজিবি সদস্য ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিচ্ছেন। বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একটি বাহিনীর কতিপয় সদস্য বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে মিলে বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত ব্যানার খুলে ফেলছেন। অন্য আরেক বাহিনীর একজন একটি বিশেষ দলের স্লোগান দিচ্ছেন।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের দলনিরপেক্ষ থেকে দেশ ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা। তারা অ্যাক্টিভিস্ট নন। আজকে বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে বা একটি চরম কর্তৃত্ববাদী ও পরাক্রমশালী সরকারের যে অসম্মানজনক পতন হলো, তার পেছনে যদি ২০টি কারণ থাকে, তার একটি হলো রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর পেশাদারি ধ্বংস তথা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন নেওয়া কর্মীদের দলীয় কর্মী বা ক্যাডারে পরিণত হওয়া।
সুতরাং ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে সেই সরকারের পতনের পরে নতুন যে সরকার আসবে; প্রথমত অন্তর্বর্তী এবং এরপরে নির্বাচিত সরকার—তাদের আমলেও রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর সদস্যরা আগের সরকারের মতোই আচরণ করবেন—সেটি কাম্য নয়।
রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় কার্যালয়ে পরিণত না হলে আওয়ামী লীগের মতো একটি শক্তিশালী দল এবং শেখ হাসিনার মতো একজন পরাক্রমশালী শাসককে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হতো না।
অতএব ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট দেশে যে অভুতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল—তার মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার একটি বিরাট বিজয় হয়েছে বটে। কিন্তু এটি তখনই সফল হবে যখন এই আন্দোলনের মূলমন্ত্র ‘বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আর এটি নিশ্চিত করতে গেলে বছরের পর বছর ধরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, তার সংস্কার আগে জরুরি।