ট্যাক্স রিটার্ন ২০২২: জেনে নিন পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন

আয়কর বিবরণী দাখিল করার প্রমাণ সংরক্ষণ করা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন থেকে কিছু সেবা পেতে গেলে আপনাকে রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ প্রদর্শন করতে হবে।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Oct 2022, 06:46 AM
Updated : 17 Oct 2022, 06:46 AM

এই পরিবর্তনগুলো ভালোভাবে না জেনে আয়কর গণনা করা হলে কর গণনা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আর যদি নিজেই রিটার্ন তৈরি করে জমা দিতে চান তাহলে তো জানা অবশ্যই জরুরি। এই লেখায় ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আলোচনা করা হবে।

প্রতি বছরই বাজেটে কিছু পরিবর্তন আসে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আপনি ২০২১-২২ আয় বছরে যে আয় করেছেন তার রিটার্ন দাখিল জুলাই মাসের এক তারিখ থেকে শুরু হয়েছে। জরিমানা ছাড়া ৩০ নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত আপনার রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।

যদি ঝামেলাহীনভাবে রিটার্ন দাখিল করতে চান তাহলে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রিটার্ন তৈরির কাজ শুরু করতে পারেন। তবে নতুন করদাতার জন্য এই বছর বাড়তি সুবিধা রয়েছে।

তারা রিটার্ন দাখিল করার জন্য একটা দীর্ঘ সময় পাচ্ছেন।

নতুন করদাতার কর দিবস ৩০ জুন ২০২৩

আপনি যদি নতুন করদাতা হয়ে থাকেন তাহলে আপনার জন্য এবার রিটার্ন দাখিল করার শেষ দিন হল ৩০ জুন ২০২৩। অর্থ আইন ২০২২ অনুযায়ী নতুন করদাতার আয়কর রিটার্ন দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর ২০২২ না হয়ে ৩০ জুন ২০২৩ হবে।

তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। আপনি আগের বছরগুলোতে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার জন্য যোগ্য ছিলেন। কিন্তু করেননি। সেক্ষেত্রে আপনাকে আলাদা দুইটি সময়ের মধ্যে আয়কর বিবরণী দাখিল করতে হবে।

ধরা যাক, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ আয় বছরগুলোতে আপনার করযোগ্য আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করেছে। কিন্তু আপনি রিটার্ন দাখিল করেননি। এক্ষেত্রে কিন্তু আপনি সবগুলো আয়কর রিটার্ন ৩০ জুন ২০২৩ এর মধ্যে জমা দিতে পারবেন

না।

প্রথমে আপনাকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ এর মধ্যে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ এই দুই বছরের ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে হবে। আর ৩০ জুন ২০২৩ এর মধ্যে ২০২১-২২ আয় বছরের আয়কর বিবরণী দাখিল করতে পারবেন।

তবে আপনি যদি চান, তাহলে একসঙ্গে তিন বছরের রিটার্ন ৩০ নভেম্বর ২০২২ এর মধ্যে দাখিল করে দিতে পারেন। এতে করে দুবার ট্যাক্স রিটার্ন নিয়ে কাজ করতে হবে না।

আপনি ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার পর ট্যাক্স রিটার্ন প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বা ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট যত্ন করে রেখে দিন।

সেবা পেতে হলে এখন থেকে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ প্রদর্শন করতে হবে

আয়কর বিবরণী দাখিল করার প্রমাণ সংরক্ষণ করা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন থেকে কিছু সেবা পেতে গেলে আপনাকে রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ প্রদর্শন করতে হবে।

আগে টিআইএন দাখিল করতে হত। কিন্তু এই বছর থেকে নতুন নিয়ম মতো আপনাকে রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ দেখাতে হবে।

যদি কোনো ব্যক্তি রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হন তাহলে উল্লেখিত সেবা থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন নতুবা আয়করের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।

কোন কোন সেবা পেতে গেলে আপনাকে আয়কর বিবরণী দাখিল করার প্রমাণ দেখাতে হবে তার একটি তালিকা আয়কর আইনে উল্লেখ রয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে পাঁচ লাখ টাকার অধিক লোন নিতে চাইলে, সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন করতে চাইলে, ক্রেডিট কার্ড প্রাপ্তি ও বহাল রাখতে চাইলে, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আবাসিক গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তি ও বহাল রাখতে চাইলে, পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে চাইলে, পাঁচ লাখ টাকার অধিক সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইলে ইত্যাদি।

এসব কাজ যদি আপনি করতে চান তাহলে এখন থেকে আপনাকে রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ দেখাতে হবে। এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ হিসেবে ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিতে হবে কিনা?

আপনি ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট না নিলেও চলবে। রিটার্ন দাখিল করার সময় যে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পাবেন তা দিয়েই কাজ চালাতে পারবেন।

রিটার্ন দাখিল করার আগে আপনি যে কর গণনা করেন তখন করের পরিমাণ দেখে মনে হতে পারে অনেক বেশি কর এসেছে। কিন্তু এই করের পরিমাণ কমাতে উপায় হল বিনিয়োগ ভাতা।

আপনি যদি কিছু নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগ বা দান করেন তাহলে কর রেয়াত দাবী করতে পারবেন যা আপনার করদায় বহুলাংশে

কমাবে। কিন্তু এবার বিনিয়োগ ভাতার সীমা এবং কর রেয়াত গণনায় পরিবর্তন এসেছে।

বিনিয়োগ ভাতার সীমা হ্রাস পেয়েছে

একটু আগে জেনেছেন, করদায় কমানোর উপায় হল বিনিয়োগ বা দান। তাই বিনিয়োগ বা দান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আপনাকে এই বিনিয়োগ বা দান আয়কর আইনে উল্লেখিত খাতে করতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে আপনি যতই বিনিয়োগ বা দান করেন না কেনো, আপনি কিন্তু ওই বিনিয়োগ বা দানকৃত টাকার ওপর কর রেয়াত দাবী করতে পারবেন না। তাই আপনি বিনিয়োগ বা দান করার আগে আয়কর আইনে উল্লেখিত খাতগুলো জেনে নিন।

আর চেষ্টা করুন সারা বছর ধরেই এই বিনিয়োগ বা দান করতে। না হলে শেষ দিকে চাপ পড়তে পারে।

এখন আপনি যে বিনিয়োগ বা দান করবেন তার একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বিনিয়োগ ভাতা হিসেবে আয়কর গণনায় দেখাতে পারবেন।

আগে একজন ব্যক্তি করদাতা তার করযোগ্য আয়ের ২৫% পর্যন্ত বিনিয়োগ ভাতা দাবী করতে পারতেন। কিন্তু এবার তা

কমে ২০% পর্যন্ত করা হয়েছে। এর ফলে সকল করদাতার বিনিয়োগ ভাতার পরিমাণ কমে যাবে। ফলে কর রেয়াতও কমবে।

আপনি যখন বিনিয়োগ ভাতার সীমা নির্ধারণ করবেন তখন মোট তিনটি সংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট সংখাটি হবে আপনার বিনিয়োগ ভাতা যার ওপর আপনি কর রেয়াত গণনা করবেন।

এই তিনটি সংখ্যা হলো- ১. করযোগ্য আয়ের ২০%, ২. আপনার প্রকৃত বিনিয়োগ অথবা ৩. এক কোটি টাকা। এই তিনটি অংকের মধ্যে যেই অংকটি ছোট হবে, সেটাই হবে আপনার বিনিয়োগ ভাতা।

এই বিনিয়োগ ভাতার ওপরেই আপনি কর রেয়াত গণনা করবেন।

কর রেয়াত গণনায় পরিবর্তন এসেছে

আগে কর রেয়াতের হার ছিল দুটি। ব্যক্তি করদাতার করযোগ্য আয়ের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কর রেয়াতের হার নির্ধারণ হত।

যদি কোনো ব্যক্তি করদাতার করযোগ্য আয় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হত তাহলে বিনিয়োগ ভাতার ওপর ১৫% হিসেবে কর রেয়াত দাবী করতে পারতেন। আর যদি কোনো করদাতার করযোগ্য আয় ১৫ লাখ টাকা অতিক্রম করতো তাহলে কর রেয়াত হার হতো ১০%।

এর ফলে যাদের আয় বেশি ছিল, তারা কম কর রেয়াত সুবিধা পেতেন। কিন্তু এবার দুইটি কর হার বাদ দিয়ে একটি কর হার ঠিক করা হয়েছে।

এর ফলে সকল শ্রেণির করদাতা ১৫% হিসেবে কর রেয়াত সুবিধা পাবেন। যাদের আয় বেশি তারা এর ফলে বেশি সুবিধা পাবেন। তবে কর রেয়াত গণনা আগের চেয়ে সহজ হল। একটা হার ব্যবহার করে এখন আপনি কর রেয়াত গণনা করতে পারবেন।

ইতোমধ্যেই জেনেছেন, কর রেয়াত আপনার করদায় অনেকাংশে হ্রাস করে থাকে। কিন্তু এই কর রেয়াতের পরিমাণ অর্ধেক কমে যেতে পারে যদি আপনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল না করেন।

৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থতায় কর রেয়াত ৭.৫%

কর দিবসের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে ব্যর্থ হলে করদাতা কিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

কোন করদাতা যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করেন তাহলে জরিমানা দিতে হয়। যেমন– করদায়ের ওপর মাসিক ২% হারে সুদ দিতে হয়। আর এখন থেকে এই সুদের পাশাপাশি কর রেয়াতের পরিমাণ কমবে অর্ধেক।

আপনি যদি ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করেন তাহলে কর রেয়াত ১৫% এর স্থলে ৭.৫% হিসেবে পাবেন। ফলে আপনার কর রেয়াত অর্ধেক কমে গেল। যে কারণে আপনার করদায় বেড়ে যাবে।

তাই চেষ্টা করুন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখল করতে। তবে নতুন করদাতার জন্য এবার কর দিবস কিন্তু ৩০ জুন

২০২৩।

লেখক: জসীম উদ্দিন রাসেল, কর পরামর্শক এবং প্রশিক্ষক।