কোনো কিছুই আর ঠিক হবে না, জীবনটা এভাবেই চলে যাবে- এই ধরনের নেতিবাচক ভাবনা থেকে বের হয়ে আসার উপায়ও রয়েছে।
Published : 12 Dec 2022, 08:21 PM
কোনো কিছুতেই আর আনন্দ পাওয়া যাচ্ছে না- এমন পরিস্থিতির আলাদা নামও রয়েছে।
ধরা যাক, শখের কোনো খাবার আজ রান্না করবেন বলে মনস্থির করেছেন- কিন্তু শেষ বেলায় আর সেটা করতে ইচ্ছে হল না। অথবা কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার ইচ্ছে শেষ মুহূর্তে মরে গেল। কিংবা জীবনের কোনো কিছুই আর করতে ভালো লাগছে না হঠাৎ করে।
জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এরকম মনে হতেই পারে। আর মনোবিজ্ঞানে এর নাম ‘অ্যানহিডোনিয়া’।
এই পরিস্থিতে একজন ভাবতে থাকে, সব কিছু করাই অর্থহীন যেহেতু কোনো কিছুতেই আনন্দ নেই।
‘অ্যানহিডোনিয়া’ বলতে যা বোঝায়
বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা করার প্রবণতা কিংবা কোনো দুর্ঘটনার পর মানসিক সমস্যায় ভোগা- এরকম মানসিক অসুস্থতার সাধারণ একটি লক্ষণ হলো ‘অ্যানহিডোনিয়া’।
তবে ফ্লোরিডার মনোবিজ্ঞানি ড. সিগাল লেভি বলেন, “মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ কোনো পরীক্ষায় ধরা না পড়লেও পরিস্থিতিগত বিষণ্নতা বা পরিস্থিতির কারণে ‘অ্যানহিডোনিয়া’তে মানুষ ভুগতে পারে।”
রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই মন্তব্যের স্বীকৃতি দিয়ে টেক্সাসের আরেক মনোবিজ্ঞানি ড. মিরান্ডা নাড্যু বলেন, “এই পরিস্থিতির শিকার বহু মানুষই হয়, অন্তত জীবনে একবার হলেও।”
যে কারণে কোনো কিছুই ভালোলাগে না
মস্তিষ্কের একটা অংশ রয়েছে, যাকে বলে ‘রিওয়ার্ড সার্কিট’, মানে কোন কাজ করলে পুরস্কার মিলবে বা আনন্দ পাওয়া যাবে বা যোগ্যতার সম্মান আসবে- সেটা নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের এই অংশ।
“আর মস্তিষ্কের এই কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় ডোপামিন হরমোনের মাধ্যমে,” বলেন আটলান্টার ‘এমোরয় ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন’য়ের ‘সাইকিয়েট্রি অ্যান্ড বিহেইভিওরাল সায়েন্স’ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জেনিফার ফেলগার।
একই প্রতিবেদনে তিনি জানান, ডোপামিন নির্ধারণ করে কোন কাজে অংশ নিলে পুরস্কার মিলবে। পাশাপাশি কোনটা ঝুঁকিপূর্ণ বা হুমকি স্বরূপ সেটাও নির্ধারণ করে এই হরমোন।
ড. ফেলগার বলেন, “অ্যানহিডোনিয়া’তে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই রিওয়ার্ড সার্কিট ঠিক মতো কাজ করে না। ফলে এক ধরনের অসামাঞ্জস্যতা দেখা দেয় আর ডোপামিনের কার্যক্রম দুর্বল হতে থাকে।”
আশপাশের পরিস্থিতি
সত্যি বলতে আমাদের আশপাশে যা ঘটে চলেছে সেগুলো মানসিক শান্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। যে কোনো জিনিসের দাম বৃদ্ধি, চাকরির অভাব, তেলের দাম বাড়া, যুদ্ধ লাগা বা পরিবারের জন্য ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারা- সব কিছু মিলিয়ে যে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে মানসিক চাপ বাড়তেই থাকে।
ড. ফেলগার বলেন, “এসব পরিস্থিতির কারণে মস্তিষ্ক একের পর এক হুমকির শিকার হয়, আর পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতির মাত্রা দিন দিন কমতে থাকে।”
উত্তরণের উপায়
কেউ কেউ অবশ্য এই ধরনের পরিস্থি কাটাতে মনের জোর খাটাতে পারেন। তবে যারা পারছেন না তাদের ক্ষেত্রে সহজ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন ডা. ফেলগার।
প্রদাহপূর্ণ জীবনযাত্রার পরিবর্তনের চেষ্টা: “কারও কারও বংশগত কারণে ডোপামিনের সামান্যতম অসামঞ্জস্যতা থাকে। তবে বিভিন্নভাবেই এই হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক করার উপায় রয়েছে”, বলেন স্যানফ্রান্সিসকো’র ‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া’র কগনেটিভ নিউরোসায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক ড. টিফানি হো।
যেমন- পর্যাপ্ত ঘুম, শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো।
ড. হো বলেন, “এই ধরনের বিষয়গুলো শরীর ও মনের প্রদাহ কমায়। তাই আনন্দ ফিরিয়ে আনতে এগুলোই হবে প্রধান চাবিকাঠি।”
ডা. নাড্যু’র ভাষায়, “সামাজিক যোগাযোগ কমে যাওয়ার কারণেও অনেকসময় মানুষের মাঝে বিষণ্নতা ও ‘অ্যানহিডোনিয়া’ দেখা দেয়।”
বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার কমানো, বিশেষ করে রাতে: বর্তমানে আমাদের সমস্ত আনন্দ যেন ওই মোবাইল, টিভি বা কম্পিউটারের মধ্যেই আবদ্ধ। “বৈদ্যুতিক পর্দার আনন্দ পেতে আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, আশপাশের সাধারণ কিছু থেকে আর আনন্দ মেলে না”, বলেন ড. ফেলগার।
এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য ধীরে ধীরে বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহারের সময় কমানোর পরামর্শ দেন এই মনোবিজ্ঞানি। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর আগে অন্তত এক ঘণ্টা আগে থেকে এসব যন্ত্র থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যা কিনা ভালো ঘুমের জন্য উপকারী।
নিজেকেই নিজের প্রিয় বন্ধু ভাবুন: “নিজের যত্নের জন্য যা কিছু করতে ভালোলাগে সেটাই করার চেষ্টা করতে হবে”, পরামর্শ দেন ড. নাড্যু।
তবে পারে সেটা হাঁটতে যাওয়া বা কারও সাথে গল্প করা।
ড. নাড্যু বলেন, “ভালো লাগবে না এরকম মনে হলেও এই কাজগুলো করার চেষ্টা করতে হবে। আর মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘এই সময়ের জন্য কোনটা বেশি উপকারী? কীভাবে নিজের যত্ন নিতে আমি আরও কর্মক্ষম হব?”
চিন্তা ভাবনার ধারা চিহ্নিত করতে পারলে নিজের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারগুলো সহজ হবে। কোনো কিছু না করার চাইতে কিছু করার চেষ্টার মনোভাব গড়ে তোলার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ বা কর্মক্ষম হওয়ার মতো সক্ষমতা ফিরে পাওয়া যায়।
নেতিবাচক চিন্তার অনুসন্ধান: প্রায় সময় দেখা যায় ‘অ্যানহিডোনিয়া’তে ভোগার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় কাজ করছে।
ড. নেড্যু বলেন, “নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতির নেতিবাচক বিষয় মিলিয়ে ফেলা পাশাপাশি ভবিষ্যত নেতিবাচক চিন্তার মিশ্রণ ঘটতে দেখা যায়।”
ভবিষ্যত ভাবনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ‘কখনও পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না’, অথবা, ‘আমি সবসময় এরকমই বোধ করবো’ এই ধরনের ভাবধারা বজায় থাকা।
বিশ্বাস ফিরে পেতে একটি কাগজে সব ধরনের নেতিবাচক ভাবনার তালিকা করার পরামর্শ দেন ড. নাড্যু।
এমনকি কোন পরিস্থিতে কী মনোভাব জাগছে, সেটা নিয়ন্ত্রিত নাকি অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘটছে সবকিছু লিপিবদ্ধ করতে হবে। আর এসব ঘটার সময় মনে পরিস্থিতি কী হচ্ছে সেটাও লিখতে হবে।
শুধু নেতিবাচক নয় ইতিবাচক দিকগুলোও পাশাপাশি লিখতে হবে। এরপর নিজেই বিচার বিবেচনা করে দেখুন কোনটাতে আসলে আপনার কোনো দোষ আছে নাকি যা ঘটছে তা সবই প্রাকৃতিক। আর এই কাজটা করতে হবে ‘জাজমেন্টাল’ না হয়ে।
প্রাকৃতিক বিষয়ের মাধ্যমে নেতিবাচক ভাবনা প্রতিস্থাপনের চেষ্টা: নেতিবাচক ভাবনাগুলো লেখার পর সেগুলো প্রাকৃতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করার জন্য সময় নিতে হবে।
ড. নাড্যু বলেন, “ধরা যাক আপনার কোনো বন্ধুর সঙ্গে আগের মতো আর সুসম্পর্ক নেই, তারপরও সে আমার খোঁজখবর রাখে।”
তিনি আরও বলেন, “এর ফলে শুধু নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক চিন্তার খোরাকও যোগানো যায়। আর এক পর্যায়ে এই বিষয়টা মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সহজ হয়।”
যেসব বিষয় কৃতজ্ঞ সেগুলোর তালিকা করা: “যেসব বিষয়গুলো কৃতজ্ঞ বা মনোরম আনন্দ দেয় সেগুলো প্রতিদিন লিখে রাখলে, নেতিবাচক ভাবনার আড়ালে সেগুলো হারিয়ে যাবে না”, বলেন ড. নেড্যু।
হতে পারে সেটা, এক প্লেট মজার খাবার কিংবা শুধুই বালিশ জড়িয়ে রাতে শুয়ে থাকা বা বারান্দা থেকে চাঁদ দেখা। মনে রাখতে হবে এই ধরনের অনেক কাজই আপনি সহজে করতে পারছেন, অন্য অনেকেই পারছে না। তাই এই ধরনের বিষয়গুলো একটা দুটো হলেও প্রতিদিন লিখে রাখার পরামর্শ দেন মনোবিজ্ঞানি।
আনন্দ পাওয়া যায় এরকম কাজ করা: একসময় যে কাজ করতে ভালো লাগতো এখন আর সেটা ভালো লাগছে না। এই ধরনের পরিস্থিতি সত্যিই নিরুৎসাহজনক।
তাই আনন্দ পাওয়ার নতুন কোনো মাধ্যমের খোঁজ না করে বরং যেটাতে আগে আনন্দ পেতেন সেটাতেই নতুন করে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন, ড. লেভি।
প্রথমে অল্প সময় ধরে চেষ্টা চালানোর কথা বলেন এই মনোবিজ্ঞানি। হতে পারে সেটা হাঁটা বা প্রিয় কোনো সিরিজ টিভিতে দেখা।
দরকার পড়লে মনোবিজ্ঞানির পরামর্শ নেওয়া: উপরের সবগুলো বিষয় স্বল্পমেয়াদের ক্ষেত্রে উপকারী। তবে দীর্ঘদিন ধরে ‘অ্যানহিডোনিয়া’ বা বিষণ্নতায় ভুগলে অবশ্যই মনোবিজ্ঞানির শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন ড. লেভি।
তার কথায়, “দৈনন্দিন কার্যক্রমে যদি নেতিবাচক ভাবনা বাজে প্রভাব ফেলতে শুরু করে আর সেটা দিনের পর দিন চলতে থাকে তবে অবশ্যই পেশাদার থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে হবে। এই বাজে পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে, তিনি অবশ্যই অতিরিক্ত অনেক কিছুই যোগ করবেন।”
আরও পড়ুন
মানসিক চাপ অদ্ভূত প্রভাব ফেলে শরীরে