পতিত জমির মধ্যে থেকে ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমি সামনের বোরো মৌসুমেই চাষে আনতে চায় কৃষি মন্ত্রণালয়।
Published : 20 Nov 2022, 12:59 AM
সুদূর ইউক্রেইনের যুদ্ধে টান পড়েছে খাবারের পাতে, যা বাড়ির পাশে পড়ে থাকা জমিতে আবাদের বিষয়টি এনেছে সামনে; সরকারও এমন পতিত জমি খুঁজে চাষ শুরুর কার্যক্রমে নেমে পড়েছে।
প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমি কাজে লাগিয়ে নিজেদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর সরকারি নীতি মাঠেও বাস্তবায়নে ঠিক করা হচ্ছে করণীয়; তৎপরতা শুরু হয়েছে ব্যক্তি মালিকানার বাইরে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পতিত ভূমিতে ফসল ফলানোরও।
করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে ৪৩১ কোটি টাকার ‘পুষ্টিবাগান’ প্রকল্পের আওতায় বছর খানেক ধরে চলা কার্যক্রমও এতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা কৃষি মন্ত্রণালয়ের, যারা আগে থেকেই অনাবাদি জমি খুঁজে বের করে ফসল ফলানোর কাজটি দেখভাল করছে।
এখন নতুন করে জানার চেষ্টা চলছে দেশে আবাদযোগ্য অনাবাদি পতিত জমির পরিমাণের পরিসংখ্যান। স্বল্পতম সময়ে বছরের পর বছর পড়ে থাকা জমির কতটুকুতে কী ধরনের ফসল ফলানো যাবে তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে।
প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনে সামনের বোরো মৌসুমেই গতবারের চেয়ে এবার ৫০ হাজার হেক্টর বেশি জমি চাষের আওতায় আনার প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে পতিত জমি থেকেই এ লক্ষ্যমাত্রা ধরার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সম্প্রসারণ) মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলু।
কোভিড মহামারী ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পতিত জমিতে চাষাবাষ করতে দেশবাসীর প্রতি সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
এরপর বিশ্বের অন্যতম খাদ্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত দুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেইন যুদ্ধে জড়ালে খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী ঢেউ এসে পড়ে বাংলাদেশেও। চাল ও আটাসহ সব খাদ্যপণ্যের দাম চড়তে চড়তে এখন সাধারণের নাগালের বাইরেই বলা চলে।
বৈশ্বিক এ পরিস্থিতির চাপে দেশেও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করে খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়াতে কোনো জমি যেন পতিত না থাকে সেই নির্দেশনার কথা জানাচ্ছেন প্রায়ই।
পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও। এ বিষয়ে তিন মন্ত্রণালয়কে ডিও লেটার দিয়েছেন তিনি।
প্রকৃত আবাদযোগ্য অনাবাদি জমির হালনাগাদ তথ্য জানতে মাঠ পর্যায়ে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান যুগ্ম সচিব বাবলু।
পতিত জমি কত?
২০২১ সালে হাতে নেওয়া ‘অনাবাদি, পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন’ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, শুধু বসতবাড়িতেই পতিত জমি রয়েছে দুই লাখ হেক্টর। দেশের মোট অনাবাদি জমির মধ্যে তা অন্তত চার ভাগের এক ভাগ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯-২০২০ সালের ‘ভূমি ব্যবহার জরিপের’ তথ্য অনুযায়ী, দেশে আবাদযোগ্য জমির মোট পরিমাণ ৮৮ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য অনাবাদি জমি ৪ লাখ ৩১ হাজার হেক্টর।
কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে এর পরিমাণ অনেক বেশি হলেও বাস্তবে কত অনাবাদি বা পতিত জমি রয়েছে এবং তার মধ্যে আবাদযোগ্য কত সেই তথ্য এবারের উদ্যোগে হালনাগাদ করা হবে। পতিত এসব ভূমি চাষের আওতায় আনার পদক্ষেপ থাকবে।
কাজে নেমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জেলা পর্যায়ে অধিদপ্তরের ভূমি ব্যবহার হয় এমন ১০ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমির প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে।
দেশজুড়ে বসতবাড়ির আশপাশ, পাহাড়ি এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওরাঞ্চল, চর, বিরোধপূর্ণ জমি, ‘অ্যাবসেন্টি’ জমি, প্রাতিষ্ঠানিক জমি, নিচু ও নিমজ্জিত জমি বছরের পর বছর ধরে অব্যবহৃত রয়েছে।
মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তিন থেকে চার ধরনের অনাবাদি জমি রয়েছে।
এরমধ্যে এমন জমি রয়েছে যেগুলো পতিতই থাকছে, আবাদে আনা যাবে না; অনেক অনাবাদি জমি পড়ে আছে মালিককে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে; বসতবাড়ির আশপাশে পড়ে থাকে অনেক জমি; আবার অনেক জমি রয়েছে শুধু এক ফসলি হবে এবং কিছু জমি রয়েছে যেগুলোকে প্রকৃতভাবেই আবাদযোগ্য করে তোলা সম্ভব হবে।
অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং এর অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, অনাবাদি জমির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। একইসঙ্গে কোন ধরনের জমিতে কোন ফসল হতে পারে সেই পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
সভা করেছে মন্ত্রণালয়
এতদিন এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ না থাকলেও এখন মন্ত্রণালয় জোরেশারে কাজ শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ে ‘অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনার জন্য যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে’ শীর্ষক সভা করেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে আগামী ২৭ নভেম্বর আরেকটি ফলোআপ সভা করা হবে।
মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সম্প্রসারণ) আবু জুবাইর শিগগির অনাবাদি জমির মধ্যে কতটুকু আবাদযোগ্য হবে সেই পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে বলে জানান। সেসব জমিকে আবাদে আনার ক্ষেত্রে সমস্যা চিহ্নিত করে তা কীভাবে স্বল্প সময়ে কাটিয়ে ওঠা যায় তা নিয়ে কাজ চলছে।
“বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালে খাদ্য ঘাটতির একটা শঙ্কা করা হচ্ছে। আমরা চাই- কোনো ঘাটতি যাতে না ঘটে বরং উদ্বৃত্ত থাকে এমন টার্গেট নিয়ে আমরা কাজ করছি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছি আমরা। তারপরও খাদ্য শস্য উৎপাদন চাহিদার চেয়ে যেন বেশি হয় সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি,” যোগ করেন তিনি।
হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং এর অতিরিক্ত পরিচালক বাদল চন্দ্র জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে আবাদযোগ্য অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনতে অধিদপ্তর ১০টি কৌশল ও পদক্ষেপ নিয়ে কাজে নেমেছে।
এসব জমিতে সবখানে একই ফসল হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, কোথাও ধান হবে, কোথাও আম-জাম, লেবু, গম, সবজি হবে- এ প্লানটা কীভাবে করা যায় তা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রাথমিক সভা হয়েছে।
তিনি জানান, এখন আবাদ হয় না কিন্তু আবাদের আওতায় আনা যাবে, সেসব বিষয়ে আরও তথ্য নেওয়া হচ্ছে। প্রকৃত অনাবাদি জমির সঠিক তথ্য নিয়ে কীভাবে সেগুলো ব্যবহার করা যায় সে পদক্ষেপ চলছে।
যেসব তথ্য আসবে
জেলাভিত্তিক মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ, এক থেকে পাঁচ ফসলি জমির পরিমাণ, নিট ফসলি জমি ও মোট ফসলি জমির পরিমাণের তথ্য পাওয়া যাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হালনাগাদ এ পরিসংখ্যানে।
ব্লকভিত্তিক ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনার তথ্যও চাওয়া হয়েছে। উপজেলা, জেলা ও অঞ্চলের প্রতিটি ব্লকের বছরব্যাপী স্থায়ী ফসল আবাদের তথ্য, লক্ষ্যমাত্রার তথ্য (আবাদি জমি); বছরব্যাপী আবাদযোগ্য অনাবাদি জমির পরিমাণ, অনাবাদি থাকার কারণ এবং আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর ফসলভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কৌশলও জানতে চাওয়া হয়েছে।
আবাদে আনার ১০ কৌশল
আবাদযোগ্য হলেও দীর্ঘদিন থেকে কোনো ফসল চাষ হয় না এমন পতিত জমির ধরণ চিহ্নিত করে সেখানে কী ধরনের শস্য ফলানো হবে তার কৌশল ঠিক করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
>> বসতবাড়ি, পুকুর-খাল পাড় ও আশপাশের স্যাঁতস্যাঁতে ছায়াযুক্ত অব্যবহৃত জমি: পারিবারিক শাকসবজি ও ফল।
>> পাহাড়ি এলাকা: ফল ও শাকসবজি।
>> সিলেট ও উপকূলীয় এলাকা: সেচের জন্য পাম্প ব্যবহার বাড়িয়ে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল।
>> হাওরাঞ্চল: সাধারণ এক ফসলি শস্য। বোরো ছাড়াও মিষ্টি কুমড়া, ক্ষিরা, শসা, চিনাবাদাম, আলু, সূর্যমুখী, সরিষা, ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, মাসকলাই ও গমসহ নানাজাতের রবিশস্য।
>> অ্যাবসেন্টি কৃষকের জমি: মালিক খুঁজে তার জমি ইজারা বা বর্গা দিয়ে চাষের আওতায় আনা।
>> পানিতে নিমজ্জিত নিম্নভূমি: মেশিন ব্যবহার করে অন্তত একটি ফসলের আওতায় আনার ব্যবস্থা।
>> প্রাতিষ্ঠানিক জমি: সুগারমিল, ক্যান্টনমেন্ট, জুটমিল, স্কুল, কলেজ, অফিস ইত্যাদির জমিকে এলাকা অনুযায়ী চাষের আওতায় আনা।
>> চর এলাকা: বাদাম, কুমড়া ও মসলা চাষের আবাদ সম্প্রসারণ।
>> কচুরিপানাযুক্ত অতি নিচু জমি: ভাসমান সবজি ও মসলা চাষ।
>> বিরোধপূর্ণ জমি: স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বিরোধ মিমাংসা করে চাষাবাষ।
কীভাবে বাস্তবায়ন
কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সম্প্রসারণ) আবু জুবাইর হোসেন বাবলু জানান, অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনতে বেশ কিছু সমস্যার সমাধানও করতে হবে। কোথাও সেচের, কোথাও বাড়তি সারের, বীজের ব্যবস্থা করতে হবে। কোথাও জলাবদ্ধতা থাকায় পানি সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
রংপুর অঞ্চলে অনাবাদি খুবই কম থাকলেও অনেক ধনি ব্যক্তি জমি আবাদ না করে, ফেলে রাখে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আর এটা করতে দেব না।“
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক বাদল চন্দ্র জানান, অধিদপ্তরের ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্পের’ আওতায় পারিবারিক পর্যায়ে অনাবাদি জমি আবাদে আনার কার্যক্রম ইতোমধ্যে কাজে দিচ্ছে।
“ইতোমধ্যে সাড়ে চার হাজার হেক্টর বসতবাড়ির জমি আবাদের আওতায় এসেছে। প্রকল্প তো সুনির্দিষ্ট এলাকার একটা জিনিস, এটা প্রদর্শনী করতে হয়। এখন বাড়িতে বাড়িতে এ কাজ হয়েছে। এটা দেখে আরও পাঁচজন উব্দুদ্ধ হবে। বিরাট অর্জন হবে।“
অন্য অনাবাদি জমিকেও চাষের আওতায় আনার কাজেও সফল হওয়ার আশা তার।
বাগান প্রকল্প
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২১ সালে অধিদপ্তরের ৪৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ের তিন বছর মেয়াদি ‘পুষ্টিবাগান’ প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইউনিয়নে ৪ লাখ ৮৮ হাজার পরিবারের বসতবাড়ির অনাবাদি জমিতে এ বাগান করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়।
প্রকল্প পরিচালক মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বসতভিটায় দেড় থেকে পাঁচ শতক অনাবাদি জমিতে শাক, সবজি, ফল ও মসলা বছরজুড়ে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৫১% অর্জন হয়েছে। দুই বছরে দুই লাখ বাগান সৃষ্টি হয়েছে। এতে সবজি ও মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক জানান, দেশে ২ কোটি ৫৪ লাখ বসতবাড়ির মোট জমি ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর, যার মধ্যে পতিত ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর। এগুলোতে থাকা কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৫২ লাখ। প্রতিটি বসতবাড়ির গড় আয়তন শূন্য দশমিক শূন্য ২ হেক্টর।
আরও পড়ুন:
পতিত জমি আবাদে ৩ মন্ত্রণালয়কে কৃষিমন্ত্রীর চিঠি
খাদ্য নিরাপত্তায় জোর, সাশ্রয়ের পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর
মঙ্গা যেন না ফেরে, নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর