খাদ্য নিরাপত্তায় জোর, সাশ্রয়ের পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর

তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ চলার জন্য যেটুকু বিদ্যুৎ প্রয়োজন, সেটা দিতে পারবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2022, 05:15 PM
Updated : 6 Oct 2022, 05:15 PM

বিশ্ব আগামী বছর ‘দুর্ভিক্ষের মত খারাপ পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে বৃহস্পতিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “যার যেখানে যতটুকু জমি আছে, অথবা জলাধার আছে, সেখানে যেন কিছু না কিছু উৎপাদন করে। কারণ এটা বিশ্বব্যাপী একটা আশঙ্কা আগামী বছরটা মহা-সংকটের বছর হবে।

“সবচেয়ে বড় কথা খাদ্য সংকটের বিষয়টা বেশি বিবেচনা করা দরকার। এক ইঞ্চি জমি যেন অনাবাধি না থাকে। আমরা সেদিক লক্ষ্য রেখেই বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছি।”

দেশবাসীকে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, “প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। বিদ্যুৎ ব্যবহার, পানি ব্যবহার, খাদ্য ব্যবহার প্রত্যেকটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাই যেন সীমিত হয়, সাশ্রয়ী হয়। কারণ আগামী সংকটটা যেন আগামীতে সেভাবে না দেখা দেয়।”

কৃষি উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “কৃষি উৎপাদন আমরা যদি আরও করতে পারি, ভালোভাবে বাড়াতে পারি এবং আমাদের যা আছে – তাতে অসুবিধা হবে না। আমরা খেয়ে-পরে থাকতে পারব। আবার মানুষকে খাওয়াতেও পারব, এটুকু আশ্বাস দিতে পারি।”

সংকটের প্রেক্ষাপট এবং তা মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “যেহেতু করোনাভাইরাস দেখা দিয়েছিল, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা… (উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা) ২০২৪ সালে কার্যকর করার কথা, আমরা ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় নিয়েছি। সেক্ষেত্রে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাজেটে আমরা কিন্তু পিছিয়ে থাকিনি।

“বিশ্বব্যাপী এত যে অর্থনৈতিক সংকট তার মাঝেও বাজেট আমরা দিয়েছি, আগের বাজেটের থেকে কিছু বেশি অর্থই আমরা ব্যবহার করেছি।”

বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সরকার তা অর্জনের ক্ষেত্রে ‘সঠিক পথে’ রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

সংকট মোকাবিলার জন্য পাঁচ মাসের খাদ্য কেনার রিজার্ভ রয়েছে জানিয়ে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “আগামীর কথা চিন্তা করে আমাদের বাজেট কী রকম হবে, কী কী কাজ করব, সে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা আছে। আমাদের অর্থনীতি এই সংকট মোকাবিলা করে, একদিকে করোনাকালীন সংকট আরেক দিকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা পাল্টা নিষেধাজ্ঞা মাঝেও কিন্তু আমরা অর্থনীতি সচল রাখতে পেরেছি।”

বিশ্বখ্যাত রেটিং সংস্থা মুডিসের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “তারা বলেছে মার্চ মাসেই, ২২ সালের বাংলাদেশের স্টেবল আউটলুক। অর্থাৎ আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি।

“এখনও আমাদের যে রিজার্ভ আছে, যদি কোন সংকট দেখা দেয় পাঁচ মাসের খাদ্য কেনার মত রিজার্ভ আমাদের আছে। রিজার্ভটা হিসাব করা করা হয় এই কারণে যে কোন দুর্যোগ দেখা দিলে তিন মাসের খাদ্য কেনার সংগতি আছে কি না। আমাদের এখনও পাঁচ মাসের আছে।”

আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ কখনো ঋণ খেলাপি হয়নি জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “আমরা ঋণটা সময় মত পরিশোধ করি। যখন ঋণটা পরিশোধ করি, তখন রিজার্ভ কিছুটা কমে আসে। আর করোনাভাইরাসের সময় যেহেতু অনেক কার্যক্রম বন্ধ ছিল, তখন রিজার্ভ বাড়াতে পেরেছিলাম।”

অর্থিক স্থিতিশীলতা যাতে থাকে, সেজন্য যত রকমের ব্যবস্থা নেওয়ার, তা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “করোনা থেকে যখন কিছুটা মুক্তি পেলাম আমাদের আমদানি বাড়ল, আমাদের বেশিরভাগ আমদানি কিন্তু মেশিনারিজ, বিলাসবহুল পণ্য আমদানি যেন কম হয় সে জন্য অনেক ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের অর্থিক একটা স্থিতিশীলতা যাতে থাকে, তার জন্য যত রকমের ব্যবস্থা নেওয়ার, আমরা কিন্তু নিচ্ছি।”

বাজেটের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যে সমস্ত প্রকল্প একান্তভাবে জরুরি, সেই প্রকল্পগুলো অধিক টাকা দিয়ে দ্রুত শেষ করে সেখান থেকে রিটার্ন পাওয়া যায়, সেই ধরনের প্রকল্প প্রথমে দ্রুত শেষ করে দিচ্ছে সরকার।

প্রকল্প গ্রহণ ও ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সব দিক বিবেচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে কেউ বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে আসলে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব, তা কিন্তু আমরা করি না।

“আমরা হিসাব করে দেখি ওই প্রকল্পটা আমাদের দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য কতটাকা খরচ করতে হবে, কত টাকা পরিশোধ করতে হবে কত টাকা ঋণ নিতে হবে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর আবার কত টাকা রিটার্ন আসবে।”

বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘যথেষ্ট শক্তিশালী’ আছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা যে দারিদ্র্য বিমোচন করেছি, বা আমরা অন্যান্য আর্থ সামাজিক উন্নয়ন করেছি, সেই গতিটা যেন অব্যাহত থাকে, আমরা কিন্তু সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি। একটা সময় আমাদের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে গিয়েছিল, সেটাও উত্তরণ ঘটিয়েছি। আমাদের এবারের বাজেটের টার্গেট আমরা কিন্তু তার কাছাকাছি আছি, কমতে দিই নাই। সেগুলো করে যাচ্ছি।”

দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে সরকারপ্রধান বলেন, “লং টার্ম, মিডিয়াম টার্ম, বা ইমিডিয়েট কোনো ক্ষেত্রেই কিন্তু বাংলাদেশের কোনো রিস্ক নাই, এইটুকু কথা দিতে পারি। এইটুকু ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি।

“তাছাড়া ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ নিয়ে আগেই বলেছি সেটা নিয়েও কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। অর্র্থনীতির প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট আমরা যেটা নির্দিষ্ট করেছি, সেটা আমরা অর্জন করতে সক্ষম হব, এ ব্যাপারে অন্তত সকলকে আশ্বস্ত করতে চাই। এরপর যদি মহাদুর্যোগ দেখা দেয়, এমনিতেই সারা বিশ্ব কষ্ট পাচ্ছে, বেশি কিছু বলার নেই। আমাদের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী অছে, এটুকু আশ্বাস আমি দিতে পারি।”

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার অর্থসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করার কথাও জানান শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আমাদের কী কী করণীয়। এর জন্য আলাদা বাজেটও আমি রেখেছি। বিশেষভাবে আমার এই বাজেটটি হবে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে সেই প্রস্তুতি নেওয়া আছে।

“আজকেও আমি আমার একটা বড় অঙ্কের টাকা রেখে দিলাম, যাতে আমার এই টাকাটা আপৎকালীন সময়ে কাজে লাগে, যেটা আমরা খাদ্যের উপর বেশি জোর দিচ্ছি। আমার দেশের মানুষের যাতে কষ্ট না হয়।”

শেখ হাসিনা বলেন, মহামারীর মধ্যে আসা রাশিয়া-ইউক্রেইন ‍যুদ্ধের মধ্যে অর্থনীতি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে।

দেশবাসীকে প্রয়োজনে হারিকেন ও কুপি বাতি দিয়ে চলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের সবাই কিন্তু প্রস্তুত থাকেন, যে অবস্থা সারা বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি হচ্ছে, ভেন্নার তেল আর রেড়ির তেল দিয়ে কুপি বাতি জ্বালাতে হবে। ভেন্নার তেলতো কেউ চিনবে না, কুপির তেলও চিনবে না।

“এটা খুব গাঢ়ো একটা তেল, অনেকক্ষণ জ্বলে। আর ভেন্না গাছতো সবুজ গাছ, সবুজ সবুজ কাঁটা কাঁটা ফল হয়, সেখান থেকে তেল হয়, সেই তেল দিয়ে কিন্তু কুপি বাতি জ্বালায়। কুপি, পিদিম, প্রদীপ আর চেরাগ জ্বালায়- অনেক নাম আছে। বা হারিকেন জ্বালাতে হবে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে, গ্যাসের অভাব। যতটুকু গ্যাস আমাদের আছে, আমরা ব্যবহার করছি। উন্নত দেশগুলির যে দুরবস্থা, সেটাওতো দেখতে হবে। সেখানকার মানুষওতো সবচেয়ে কষ্টে পড়েছে।

“আমাদের দেশে আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। তো, এখন থেকে সবাই প্রস্তুত হন যে, চেরাগ জ্বালায়া চলতে হবে। ওই হাড়িতে কাঠখড়ি পুড়িয়ে রান্না করতে হবে।”

জনগণকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানালেও ডিজিটাল বাংলাদেশ চলার জন্য যেটুকু বিদ্যুৎ প্রয়োজন সেটা দিতে পারবেন বলে স্মিতহাস্যে আশ্বস্ত করেন শেখ হাসিনা।

‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাই না’

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো হস্তক্ষেপ করে না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিবেশী দেশের কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কাজের জন্য দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “যুদ্ধাবস্থাটা বিরাজ করতেছে, সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ একটা ব্যাপার। সেখানে আমরা নাক গলাতে যাই না, আমরা যাবও না। এমনকি আমাদের মাটি কেউ ব্যবহারও করতে পারবে না।

“অন্য দেশের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা ইনসার্জেন্সি অ্যাক্টিভিটিজ চালানো জন্য আমাদের মাটি কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। এটা হল বাস্তবতা।” 

রোহিঙ্গাদের ফেরানোর চেষ্টা সরকার করে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানে তারা আছে, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাই কিন্তু সহায়তা করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা তারাও মিয়ানমারে যাচ্ছে, কথা বলছে।

“মিয়ানমার সরকার, সামরিক শাসক- তারাতো কারও কথা মানছে না। শুধু জাতিসংঘ কেন, আসিয়ান কান্ট্রিজ, তারাও কম চেষ্টা করেনি। অন্যান্য দেশও চেষ্টা করছে, কিন্তু মিয়ানমার তাদেরকে নিচ্ছে না।”

গত পাঁচ বছর রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের কাঁধে বোঝা হিসাবে রয়েছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “জাতিসংঘে বারবার আমরা তুলে ধরছি। কিন্তু আসলে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের কতটুকু ফেরত যেতে পারবে, সেটাই হল সবচেয়ে বড় কথা।

“রোহিঙ্গাদের জন্য সহযোগিতা আসত, সেটা বর্তমানে অনেকটা সীমিত হয়ে এসেছে। যেহেতু আমরা মানবিক কারণে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছি, এই আশ্রিতদেরকে ঠেলে পাঠাতে পারি না।”