বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সরকারের আয়ের সংস্থান করেই ব্যয় ঠিক করতে হবে। বাজেট বড় করলাম, কিন্তু তা ঋণ করে নিতে হচ্ছে। এতে তো খরচ বাড়বে, টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না।”
Published : 06 Jun 2024, 06:25 PM
নানামুখী অর্থনৈতিক চাপের মধ্যেও উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বড় ঘাটতির যে বাজেট নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রস্তাব করেছেন, তার ১৭ শতাংশের বেশি তাকে জোগাড় করতে হবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।
এর মধ্যে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা তিনি রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেওয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।
অবশ্য ঘাটতির এই পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪.৬ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
সাধারণত ঘাটতির পরিমাণ ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা হয়। তবে টাকা যোগানোর চাপ থাকায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর থেকে প্রতিবারই ঘাটতি ৪ দশমিক ৯ শতাংশের বেশি ছিল। এবার সেই ধারায় যতি টানলেন মাহমুদ আলী।
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি; সংশোধিত বাজেটে তা কমে আসে ২ লাখ ৩২ হাজার ৯১৮ কোটি টাকায়।
গত অর্থবছরে জিডিপির ৫.২ শতাংশ ঘাটতি রেখে মূল বাজেট সাজানো হলেও সংশোধনে তা ৪.৭ শতাংশে নেমে আসে। এবারের ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে তার কাছাকাছিই থাকছে।
আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয় ঋণ করে। সরকার বিদেশি সাহায্য ও বিদেশি ঋণ নিয়ে, দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ধার করে, জনগণের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারে।
এবারের বাজেটের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হলে অর্থমন্ত্রীকে ওই অর্থের ৩৬ শতাংশের বেশিই জোগাড় করতে হবে ঋণ করে।
সেজন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার মত ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন মাহমুদ আলী।
বিগত বছরগুলোতে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প করার তাগিদে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তবে বিদেশি ঋণের সুদ দিতে সরকারের রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করতে হয়। আর ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে ডলারের দর চড়ে যাওয়ায় এমনিতেই রিজার্ভ কিছুটা চাপে আছে।
ডলারের সঞ্চয় ধরে রাখতে সরকার বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি কম জরুরি প্রকল্পে অর্থায়ন বিলম্বিত করার নীতি নেয় দুই বছর আগে। এবারের বাজেটে বিদেশের বদলে দেশের উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনাও ডলার বাঁচানোর কৌশলের দিকেই ইংগিত করছে।
অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে, যা মোট ব্যয়ের ১৭.২৫ শতাংশ।
ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার এই লক্ষ্য বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ কম হলেও মূল বাজেটের তুলনায় কিছু বেশি।
গত অর্থবছরে তখনকার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি ঋণ করার লক্ষ্য ধরেছিলেন; সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৮ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন মাহমুদ আলী।
সঞ্চয়পত্র থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল; তবে শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র।
বাজেটে সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে ৯০০ কোটি টাকা বেশি।
বৈদেশিক অনুদানকে রাজস্বের সঙ্গে দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী। এর ব্যাখ্যায় তিনি বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, “বৈদেশিক অনুদান যেহেতু পরিশোধযোগ্য নয়, তাই এটাকে সরকারি রাজস্বের সঙ্গে একই গ্রুপভুক্ত করা হয়েছে।”
ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে বাইরে থেকে আসা তারল্য যোগ হয়। তাতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ে। তাছাড়া সেই ঋণের জন্য সরকারকে সুদও গুনতে হয়।
এবার দেশি-বিদেশি ঋণের জন্য ১ লাখ ১৩হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে অর্থমন্ত্রী হিসাব ধরেছেন, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে ঋণনির্ভর বাজেটের ধারা চলতে থাকায় দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হচ্ছে। ব্যাংক থেকে সরকার বেশি বেশি ঋণ নেওয়ায় তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে সময়ে সময়ে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ালেই ঘাটতি আরো বাড়বে। বাজেট বড় হলে রাজস্ব আদায়ের চাপ বাড়বে ব্যবসায়ীদের উপর। তারা কোথা থেকে দেবে? সব চাপ তো জনগণের ঘাড়ে পড়ছে।
“সরকারের আয়ের সংস্থান করেই ব্যয় ঠিক করতে হবে। বাজেট বড় করলাম, কিন্তু তা ঋণ করে নিতে হচ্ছে। এতে তো খরচ বাড়বে, টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না।’’
তারল্য সংকটের সঙ্গে ব্যাংকও ‘ভাবমূর্তি’ সংকটে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘‘ব্যাংকের প্রতি আস্থা উঠে গেলে অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা মেরামত করা কঠিন হয়ে পড়বে। ভঙ্গুর ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প কিছু নেই। সরকার তো ব্যাংক থেকেই ঋণ নেবে। তারল্য না থাকলে কীভাবে ঋণ নেবে?
“ব্যাংক রক্ষা করতে হবে আগে। ঋণ খেলাপিদের ছাড় দিয়ে কোনো লাভ হয়নি। তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত আনতে হবে, এতে তারল্য বাড়বে ব্যাংকে, তখন সমস্যা হবে না।’’