“এভারেস্ট চূড়ায় আমি অনেকক্ষণ ছিলাম। এই চূড়ায় আমি ৫ মিনিটের বেশি থাকার সাহস করিনি।”
Published : 16 Apr 2025, 07:27 PM
নেপালে অন্নপূর্ণা-১ অভিযান সফলভাবে শেষ করার পর দেশে ফিরে দু:সাহসিক সেই যাত্রার গল্প শোনালেন পর্বতারোহী বাবর আলী।
বুধবার দুপুরে অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি এ অভিযান সফলভাবে শেষ করতে পারায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন বলে তুলে ধরেন।
পেশায় চিকিৎসক এই পর্বতারোহী বলেন, “অন্নপূর্ণা এত ডেডলি একটা মাউন্টেন, সবাই চায় কত অল্প সময় থেকে অভিযানটা শেষ করে আসবে। কারণ যত বেশি সময় থাকবেন তত ঝুঁকি থাকে। লাইফ রিস্ক তত বাড়বে। এই পর্বতে তুষার ধস হয়।
“আমি তো অনেক বছর ধরে পর্বতে যাচ্ছি, জীবনে মোট যত তুষার ধস দেখেছি এই একটা পর্বতে এই কয়দিনে এরচেয়ে কয়েকগুণ বেশি দেখেছি।”
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গত ৭ এপ্রিল বিশ্বের দশম সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে আরোহণ করেন এভারেস্টজয়ী বাবর আলী।
নেপালের গন্ডকিতে অবস্থিত অন্নপূর্ণা পর্বত স্থানীয়দের কাছে ‘ফসলের দেবী’ হিসেবে পূজনীয়। এর চূড়া মূলত চারটি।
এর মধ্যে শীর্ষ হল পৃথিবীর দশম শীর্ষ পর্বত ৮ হাজার ০৯১ মিটার (২৬,৫৪৫ ফুট) উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১। উচ্চতায় দশম হলেও অভিযানের জন্য কৌশলগতভাবে অন্যতম কঠিন হিসেবে বিবেচিত এই পর্বত। এ চূড়ায় সফল সামিটের বিপরীতে মৃত্যুর হার প্রায় ১৪%, যা ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিল ৩২%!
গত মৌসুম পর্যন্ত এই পর্বতে শীর্ষে পৌঁছেছেন ৫১৪ জন এবং ৭৩ জন মারা গেছেন।
অন্নপূর্ণায় আরোহণের ভয়াবহতার চিত্র বর্ণনা করে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে এই পর্বতারোহী বলেন, “তুষার ধসেও পড়েছি, যদিও একেবারে শেষের দিকে। আমার দলে মোট চারজনের মধ্যে একজন এস্তানিয়ান, তুষার ধসে পড়ে যান। ও অনেকগুলো অভিযান করা এ পর্যন্ত, কিন্তু তুষার ধস তার কনফিডেন্সে এমনভাবে নাড়া দিয়েছে ও আর অভিযানটাই করেনি।
“এই মাউন্টেন সবাইকে ট্রেইন করে নেয়। আমি খুব ভাগ্যবান যে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছি। আমি আসার পরে ব্রুনো (অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য চট্টগ্রামের পরিচালক ব্রুনো লাক্রামপ) আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমার ফিঙ্গার টিপস ঠিক আছে কি না। কারণ প্রথম যারা আরোহণ করেছিল মরিস হেরজগ আর লুইস লেচেনাল, তাদের মধ্যে হেরজগ তার হাত-পায়ের আঙ্গুলের ডগা হারিয়েছিল।”
তিনি বলেন, “এটা খুব তুষার ধস প্রবণ। এর গাত্রটা তুষার ধরে রাখতে পারে না। আর এ বছর অন্নপূর্ণায় সবচেয়ে শুষ্ক বছর। কেননা গত শীতে খুব কম তুষারপাত হয়েছে। একদিক থেকে এটা খুব ভালো। কারণ এতে তুষার ধসের চান্স কম। কিন্তু আমি পর্বতে যাবার পরে প্রচুর পরিমাণ তুষারপাত হতে শুরু করল।
“২০২৩ সালে ভারতের রাজস্থানের পর্বতারোহী অনুরাগ মালো অন্নপূর্ণা অভিযানে গিয়ে একটা তুষার ফাটলে পড়ে তিন দিন আটকা ছিল। সেখান থেকে সে অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরেছিল।”
এভারেস্টের চেয়েও অন্নপূর্ণা অভিযান অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে বাবর বলেন, “এভারেস্ট চূড়ায় আমি অনেকক্ষণ ছিলাম। এই চূড়ায় আমি ৫ মিনিটের বেশি থাকার সাহস করিনি। এটা এমন একটা চূড়া যে খাড়া একটা স্লোপ বেয়ে উঠে দুজন লোক দাঁড়াতে পারে।
“সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ ছিল সামিট পুশ থেকে চূড়ায় যাওয়ার সময়টা। আর ক্যাম্প ২ থেকে ক্যাম্প ৩ এ যাত্রার পথটুকু। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে আপনি শত্রুপক্ষের এমন একটা করিডোর দিয়ে যাচ্ছেন যেখানে সবসময় দুপাশ থেকে কেউ মেশিনগান দিয়ে গুলি করছে। আপনি জাস্ট এঁকেবেঁকে যাচ্ছেন। উপর থেকে হয় পাথর খসে পড়তেছে অথবা তুষার ধস।”
ফেরার পথে বিপদে পড়ার কথা তুলে ধরে বাবর বলেন, “অনেক ভারি বুট থাকায় পায়ে পাথর পড়ার পরও আমি বেঁচে গেছি।
“চ্যালেঞ্জের দিক থেকে অন্নপূর্ণা ১০ এ ১০, এভারেস্ট ১০ এ ২ এবং লোৎসে ১০ এ ৪ বলে মনে করি। এভারেস্টে অনেক ক্লাইম্ব হয়। অন্নপূর্ণায় শুধু সিজনড ক্লাইম্বাররা যায়।”
তিনটি আট হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতে সফল অভিযানের পর নিজের স্বপ্ন হিসেবে এ উচ্চতার আরও ১১টি পর্বতের চূড়ায় উঠতে চান তিনি। তিনি জয় করেছেন এভারেস্ট, লোৎসে ও অন্নপূর্ণা। তার পরবর্তী গন্তব্য নেপালের মানাসলু, যেটা অষ্টম সর্বোচ্চ।
“আট হাজারি ১৪টির মধ্যে সাতটি নেপাল, দুটি তিব্বত এবং পাঁচটি পাকিস্তান থেকে সামিট করা হয়। সবই গ্রেটার হিমালয়ের অংশ,” যোগ করেন তিনি।
ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স ক্লাবের সভাপতি ও অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, “আমরা আশাবাদী যে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শীঘ্রই বাবর আলী বাকি সবকটি আট হাজার মিটার শৃঙ্গেই হাসিমুখে দাঁড়াতে পারবে। এই কীর্তি কিন্তু নেপালের শেরপারা বাদে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার শুধু একজন পাকিস্তানির আছে, তিনি হলেন শিরবাজ খান।
“আর সবগুলো আট হাজার মিটার পর্বত সামিটের কীর্তি আছে সমগ্র বিশ্বে মাত্র ৭১ জন পর্বতারোহীর।”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য চট্টগ্রামের পরিচালক ব্রুনো লাক্রামপ, বাবর আলীর অভিযান আয়োজনকারী সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের উপদেষ্টা শিহাব উদ্দীন এবং পৃষ্ঠপোষক কোম্পানি ভিজুয়াল নিটওয়ারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ নূর ফয়সাল।