উচ্চতায় দশম হলেও অভিযানের জন্য কৌশলগতভাবে অন্যতম কঠিন হিসেবে বিবেচিত এ পর্বত শৃঙ্গ।
Published : 07 Apr 2025, 04:37 PM
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের দশম সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে আরোহণ করলেন এভারেস্টজয়ী বাবর আলী।
এ অভিযানের আয়োজক সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর সভাপতি ও অভিযান ব্যবস্থাপক ফারহান জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ খবর দিয়েছেন।
ফারহান জামান জানান, সোমবার ভোরে অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান চট্টগ্রামের বাবর আলী।
অভিযানের আউটফিটার মাকালু অ্যাডভেঞ্চার এর সত্ত্বাধিকারী মোহন লামসাল এর মাধ্যমে এ খবর পাওয়ার কথা বলেন ফারহান।
বাবরের সংগঠন পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, “লাখো শুভাকাঙ্ক্ষীর প্রার্থনার উত্তর দিয়েছেন স্রষ্টা। প্রকৃতিমাতা বিমুখ হননি। বঙ্গ সন্তান বাবরকে ক্ষণিকের জন্য নিজের চূড়ায় দাঁড়াতে দিয়েছে অন্নপূর্ণা।
“বিশ্বের দশম শীর্ষ পর্বত এবং অন্যতম কঠিন পর্বত ২৬, ৫৪৫ ফুট উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১ এর শীর্ষে প্রথমবার উড়লো আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।”
ফারহান জামান বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি বাবর আলী সুস্থ অবস্থায় ক্যাম্প-৩ তে নেমে এসেছেন। তবে যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। বাবরকে আজ নেমে আসতে হবে ক্যাম্প-২ এর নিরাপত্তায়। আর আগামীকাল নামতে হবে বেজক্যাম্পে।”
পর্বতে চড়ার চেয়ে নামা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ওই এলাকা বিপদসংকুল হওয়ায় বাবরের নিরাপদ অবতরণের জন্য সবাইকে প্রার্থনা করার অনুরোধ করা হয়েছে ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের ফেসবুক পোস্টে।
তুষারঝড় পেরিয়ে অন্নপূর্ণা চূড়ায়
এ অভিযানের জন্য বাবর আলী বাংলাদেশ থেকে নেপালে যান ২৪ মার্চ। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ২৬ মার্চ কাঠমান্ডু থেকে আকাশপথে যান পোখারা। এরপর কিছু পথ গাড়িতে ও বাকি পথ পায়ে হেঁটে ২৮ মার্চ পৌঁছে যান বেজক্যাম্পে।
একদিন বিশ্রাম নিয়ে পরদিন চড়তে শুরু করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নিতে। ক্যাম্প-১ (৫২০০ মিটার) এ দুই রাত এবং ক্যাম্প-২ (৫৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে ২ এপ্রিল বাবর বেজক্যাম্পে নেমে আসেন।
ফারহান জামান বলেন, “সাধারণত এই সময় শুরু হয় ভালো আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষার পালা। কিন্তু বাবর নেমে এসেই জানতে পারেন আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে ভালো আবহাওয়া থাকবে পরদিন থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত।
“এই সম্ভাব্য ভালো আবহাওয়াকে কাজে লাগাতে মাত্র ২৪ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে বাবর আবার চড়তে শুরু করেন ৩ এপ্রিল। ওইদিন ক্যাম্প-১ এ থেমে পরদিন উঠে যান ক্যাম্প-২ এ।”
এর মাঝেই শুরু হয় বিপত্তি। বিকাল থেকেই হঠাৎ শুরু হয় তুষারঝড়। দীর্ঘ যোগাযোগহীনতার পর জানা যায় ৫ এপ্রিল বাবর পেরিয়ে গেছেন কঠিন অংশ, পৌঁছে গেছেন ক্যাম্প-৩ (৬৫০০ মিটার)।
ফারহান জামান বলেন, সাধারণত ৭৪০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প-৪ তৈরি করে ‘সামিট পুশ’ শুরু হলেও সিদ্ধান্ত হয় অবস্থার প্রেক্ষিতে এই ক্যাম্প বাদ দিয়ে ক্যাম্প-৩ থেকেই শুরু হবে চূড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা, অর্থাৎ ওই উচ্চতায় একটানা ১৬০০ মিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
“চূড়া পর্যন্ত পথ তৈরি এবং আবহাওয়ার উন্নতির জন্য ক্যাম্প-৩ এ অতিরিক্ত একদিন অপেক্ষা করে ৬ এপ্রিল রাতে ওই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বাবর বেরিয়ে পরেন। এদিকে রোপ ফিক্সিং টিম সামিট পর্যন্ত পথ তৈরি করতেই ভোরে শীর্ষে উঠে আসেন বাবর আলী।”
সোমবারই বাবর আলী নেমে আসবেন ক্যাম্প-২ এ। সেখানে রাতটা কাটিয়ে মঙ্গলবার নেমে আসবেন বেজক্যাম্পে।
অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে বাবরের সাথী ছিলেন ক্লাইম্বিং গাইড ফূর্বা অংগেল শেরপা।
অন্নপূর্ণা অনন্য কেন
নেপালের গন্ডকিতে অবস্থিত অন্নপূর্ণা পর্বত স্থানীয়দের কাছে ‘ফসলের দেবী’ হিসেবে পূজনীয়। এর চূড়া মূলত চারটি।
যার মধ্যে শীর্ষ হল পৃথিবীর দশম শীর্ষ পর্বত ৮ হাজার ০৯১ মিটার (২৬,৫৪৫ ফুট) উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১।
উচ্চতায় দশম হলেও অভিযানের জন্য কৌশলগতভাবে অন্যতম কঠিন হিসেবে বিবেচিত এই পর্বত। এ চূড়ায় সফল সামিটের বিপরীতে মৃত্যুর হার প্রায় ১৪%, যা ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিল ৩২%!
গত মৌসুম পর্যন্ত এই পর্বতে শীর্ষে পৌঁছেছেন ৫১৪ জন এবং ৭৩ জন মারা গেছেন।
১৯৫০ সালের ৩ জুন ফ্রান্সের মরিস হেরজগ এবং লুইস লেচেনাল এই পর্বত চূড়া প্রথম স্পর্শ করেন, যা যেকোনো আট হাজারি শৃঙ্গে প্রথম সাফল্যও বটে।
ওই হিসেবে এ বছরই অন্নপূর্ণা-১ প্রথম সামিটের প্ল্যাটিনাম জুবিলি। এই ৭৫ বছরের মধ্যে ২০০৯ সালে অন্নপূর্ণা-৪ এ একবার বাংলাদেশি অভিযান হলেও অন্নপূর্ণা-১ এ এটিই প্রথম এবং সফল অভিযান।
অভিযান ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, “গত বছর এভারেস্ট-লোৎসে সামিটের পর এবার অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে পৌঁছানোর মাধ্যমে বাবর আলী বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছেন।
“ওর কঠোর পরিশ্রম এবং নিরলস অধ্যবসায়ের প্রতিফলন এই সাফল্য। আমরা আশা করি এই অর্জন বাংলাদেশের পর্বতারোহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।”
বাবরের লক্ষ্য বিশ্বের ১৪টি আট হাজারি শৃঙ্গের সবকটিতেই লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানো।
এবারের অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার্স লিমিটেড, ভিজ্যুয়াল ইকো স্টাইলওয়্যার লিমিটেড, এডিএফ এগ্রো, ফ্লাইট এক্সপার্ট, এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ব্লু জে।
বাবর আলী নিজেই চট্টগ্রাম ভিত্তিক দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক।
পেশায় ডাক্তার এই পর্বতারোহী ২০২৪ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে একই অভিযানে দুটি আটহাজারি শৃঙ্গ এভারেস্ট এবং লোৎসে পর্বত জয় করেন। প্রথম বাঙালি হিসেবে ২০২২ সালে আমা দাবলাম চূড়া স্পর্শের নজির গড়েন।
বাবর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ভারতের দীর্ঘতম সড়ক কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সাইক্লিং করেছেন, প্রথম বাঙালি হিসেবে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার এমাথা-ওমাথা।
প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে তিনি ৬৪ দিনে হেঁটেছেন বাংলাদেশের ৬৪ জেলা।
বাবর আলী ‘ম্যালরি ও এভারেস্ট’, ‘পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা’, ‘সাইকেলের সওয়ারি’, ‘এভারেস্ট ও লোৎসে শিখরে’ নামের চারটি বইয়ের রচয়িতা।
চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী ও লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান বাবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।