‘চট্টগ্রামের প্রাণ’ কর্ণফুলী নদীকে ‘গিলতে বসা’ দুই সহস্রাধিক সরকারি-বেসরকারি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
Published : 04 Feb 2019, 07:51 PM
সোমবার অভিযান শুরুর দিনেই ৮০টির বেশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয় বলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পতেঙ্গা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার তাহমিলুর রহমান ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে সকাল সোয়া ১০টায় সদরঘাট লাইটারেজ জেটি ঘাট এলাকায় অভিযান শুরু হয়ে চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।
অভিযানের শুরুতেই জেটি ঘাটে নদী সংলগ্ন ‘সদরঘাট সাম্পান চালক সমবায় সমিতি’র অবৈধ কার্যালয় ও যাত্রী ছাউনি এবং বিআইডব্লিউটিসি’র একটি স্থাপনা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
এসময় বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি কয়েকটি ছাপড়া ঘর ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর অভিযান শুরু হয় পাশের কর্ণফুলী ঘাটে, সেখানে নদীর তীর দখল করে গড়ে তোলা কয়েকটি টিনের ঘর ভাঙ্গা হয়।
দুপুরে ইঞ্জিনিয়ার মো. রশীদের মালিকানাধীন কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের পাকা ভবনে অবৈধ স্থাপনা ভাঙার কার্যক্রম শুরু হয়। অভিযানে বুলডোজার দিয়ে পাকা ও লোহার স্থাপনার আরও কিছু অংশ ভেঙে দেওয়া হয়।
১৯৯৪ সালে জেলা প্রশাসন থেকে দশমিক ৫৩২১ একর খাস জমি লিজ নেওয়ার পর সেখানে তারা একটি কোল্ড স্টোরেজ গড়ে তোলেন।
সহকারী ভূমি কমিশনার তাহমিলুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রথম দিনে সদরঘাট লাইটারেজ জেটি ঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার নদী তীর ধরে অভিযান হয়েছে।
“এখানে ৫০টির মতো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হয়েছে। এর বাইরে ৩০ জন মালিক তাদের স্থাপনা নিজ উদ্যোগে সরিয়ে নিয়েছে।”
উচ্ছেদ করা স্থাপনার মধ্যে ১০ বড় পাকা কাঠামো ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমদিনে উদ্ধার করা জায়গার পরিমাণ চার একরের মতো।
পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে শুরু করে মোহরা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা তিনটি জোনে ভাগ করে এ অভিযান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথম ভাগে সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। পরে পতেঙ্গা ও চাক্তাই এলাকায় উচ্ছেদ শুরু হবে।
পে লোডার, এক্সক্যাভেটর ও ট্রাক নিয়ে ১০০ জন শ্রমিক নদী তীরের অবৈধ স্থাপনাগুলো ভাঙার কাজ করেছে। বিপুল পরিমাণ পুলিশ ও র্যাব সদস্য ছাড়াও সিটি করপোরেশন, সিডিএ, চট্টগ্রাম বন্দর কতৃর্পক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ, ফায়ার সার্ভিস সাভির্স ও কণর্ফুলী গ্যাসের প্রতিনিধিরা এ অভিযানে অংশ নেয়।
প্রথম দফার অভিযানে দুইশ মতো স্থাপনা উচ্ছেদ হলে ১০ একরের মতো জায়গা উদ্ধার হবে বলে মনে করছেন সহকারী কমিশনার তাহমিলুর।
নদী তীরের উদ্ধার করা জামিতে সীমানা পিলার দিয়ে বনায়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
সদরঘাট এলাকায় নদী তীরে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিদর্শনে আসেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন ও চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রকৌশল) কমডোর খন্দকার আক্তার হোসেন।
জেলা প্রশাসক এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের নির্দেশ মোতাবেক দুই হাজার ১১২টির মধ্যে ছয়টি বাদ দিয়ে উচ্ছেদে অভিযান চলতে থাকবে। আরএস জরিপ অনুযায়ী এ উচ্ছেদ কার্যক্রম চলছে।
উচ্ছেদ কার্যক্রমে তারা কোন প্রভাবশালীর কাছে মাথা করবেন না উল্লেখ করে ইলিয়াছ হোসেন বলেন, “উচ্ছেদ শুরুর আগে আমরা কয়েকটি জায়গা থেকে হুমকিও পেয়েছি। অভিযান পরিচালনাকারী অফিসাররাও হুমকি পেয়েছে। কিন্তু দেশকে বাঁচাতে কোনো ছাড় নেই।”
নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর সেসব জায়গা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দখল নেয়া হবে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, তারপর সেখানে পরিকল্পনা মোতাবেক সৌন্দয্য বর্ধন, ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নেয়া হবে।
সদরঘাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নদী তীরের অধিকাংশ স্থাপনা বেসরকারি হলেও তা লিজ নেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। পরে ইজারাগ্রহীতারা নদী তীর অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা গড়ে।
অভিযান দেখতে আসা চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রকৌশল) আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হলে নদীর পাড়ে এরকম বন্দরের অনেক জায়গায় জাহাজ ভিড়তে পারবে। মালামাল লোড-আনলোডের কাজ হবে, দৃষ্টিনন্দন হবে, জাহাজের নাবিকরা এখানে বসতে পারবে।
অবৈধভাবে তীর দখল করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আইন অনুযায়ী নিয়মের মধ্যে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমরা সবসময়ই ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে আমাদের ভূমিতে থাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করি। এটা আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম।’’
২০১০ সালের ১৮ জুলাই হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে জনস্বার্থে করা রিট আবেদনে হাই কোর্টের এক আদেশে নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে সব ধরণের স্থাপনা বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। সেইসাথে স্থানীয় প্রশাসনকে নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দিতে বলে আদালত।
অভিযানে ২০০ পুলিশ সদস্য ও র্যাবের ৬০ জন অভিযানে সহযোগিতা করছে বলে জানান চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ আব্দুর রউফ।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন জানান, তাদের ৪টি ইউনিটের ৫০ জন কর্মী উচ্ছেদ অভিযানে দিনভল সহযোগিতা করেছে।
আদালতের নির্দেশের পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করে। সেসময় যে অবৈধ স্থাপনাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেগুলোই এখন উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে একটি সমন্বয় সভার পর সোমবার থেকে অভিযান শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়।
পতেঙ্গা, ইপিজেড, বন্দর, কোতোয়ালি, বাকলিয়া, চান্দগাঁও মৌজার ৩৬৮ এবং পূর্ব পতেঙ্গা মৌজার ১৭৪৪টিসহ ২১১২টি স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে আলোচনা হয় সেদিনের সভায়।
অভিযানে নামার আগে শনিবার বিকালে নগরীর সদরঘাট এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, কর্ণফুলীর দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।