“যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে, সন্ত্রাসবাদে জড়িত হয়েছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য আমরা তৎপর”, বলেন তিনি।
Published : 28 Sep 2024, 09:49 PM
নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরকে ‘জঙ্গি’ উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম।
গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর নিষিদ্ধ সংগঠনটির প্রকাশ্যে চলে আসা এবং প্রকাশ্যে নানা কর্মসূচি পালনের মধ্যে শনিবার চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে পুলিশ প্রধান এ কথা বলেন।
মহানগর পুলিশ কমিশনারের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রামের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি।
একজন গণমাধ্যমকর্মী চট্টগ্রামে হিযবুত তাহরীরে তৎপরতার উদাহরণ দিয়ে এ বিষয়ে পুলিশের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চান।
জবাবে পুলিশ প্রধান বলেন, “হিযবুত তাহরীর ‘জঙ্গি’ সংগঠন। সে ব্যাপারে আমাদের মামলা হয়েছে। আমাদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, চলবে। ‘জঙ্গির’ ক্ষেত্রে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
অনেক তরুণ না জেনে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়াচ্ছে- সেই সংবাদ কর্মীর এমন মন্তব্যের পর তিনি বলেন, “যারা কিশোর বা যারা এটাতে জড়িয়ে পড়ছে বা আকৃষ্ট হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমাদের সমাজের অনেক কিছু করণীয় আছে।”
২০০১ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে হিযবুত তাহরীর। এর নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএর একজন শিক্ষক।
২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগ সরকার প্রেসনোট জারি করে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
সংগঠনটির মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিম সম্প্রতি বিবিসি বাংলাদেশকে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সরকার পতন আন্দোলনে শুরু থেকেই তাদের কর্মীরা অংশ নেন। তবে তারা কোনো ব্যানার ব্যবহার করেননি।
৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনই ঢাকায় মিছিল করে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এরপর আরও নানা দাবিতে মিছিলের পাশাপাশি ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠকও করেছে সংগঠনটি। চট্টগ্রামেও পালন করছে নানা কর্মসূচি।
গত ৫ সেপ্টেম্বরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন করার কথাও জানিয়েছে সংগঠনটি। তবে সরকারের তরফে কোনো বক্তব্য আসেনি।
‘জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দেশের শত্রু’
আইজিপি বলেন, “জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম দেশের শত্রু। যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে, সন্ত্রাসবাদে জড়িত হয়েছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য আমরা তৎপর।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে আটক বেশ কয়েকজনের জামিন পাওয়া নিয়েও কথা বলেন তিনি।
“যারা জামিন পেয়েছে, যদি কোনো কারণে আবার দেখি জঙ্গিবাদে ফিরেছে, সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম করছে, সেখানে আমরা কিন্তু তাকে আবার আইনের আওতায় আনব।”
জামিন একটি আইনি অধিকার মন্তব্য করে পুলিশ প্রধান বলেন, “আমাদের সার্ভিলেন্স সবসময় আছে। কোন ধরনের অপরাধ কাজে বা অপতৎপরতায় জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
পুলিশের সব ইউনিট কাজ শুরু করেছে
সরকার পতনের খবরে থানায় থানায় আক্রমণের পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া পুলিশ আবার সক্রিয় হয়েছে বলেও দাবি করেন আইজিপি।
তিনি বলেন, “আন্দোলনের ফলে পুলিশ বাহিনী নতুন সময়ে পদার্পণ করেছে, এখন সবাই কিন্তু আন্তরিক। আজকের মিটিং এর উদ্দেশ্য ছিল, আমরা কী করে পূর্ণ উদ্যমে মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি; সবাই নিজ দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত উদগ্রীব।
“দায়িত্ব গ্রহণের পর আমার মূল লক্ষ্য ছিল পুলিশের সকল ইউনিটকে অপারেশনাল করা, যে সদস্যরা মনোবল হারিয়েছে বিভিন্নভাবে ট্রমাটাইজড হয়েছে, তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনা, তাদেরকে কাজের পরিবেশ করে দেওয়া, তাদেরকে কাজে ফেরানো। ইতিমধ্যে সকল ইউনিটের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে।”
সঠিকভাবে কাজ করতে পারলে জনগণের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আন্দোলনে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার তদন্ত এবং বিচারের আশ্বাস দিয়ে আইজিপি বলেন, “জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন কাজ করছে। সরকার অত্যন্ত আন্তরিক সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের বিষয়ে।”
সম্প্রীতি বিনষ্টের সুযোগ নেই
বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে ‘কিছু ক্ষুদ্র গোষ্ঠী’ তৎপর বলে মন্তব্য করে আইজিপি বলেন, “আমরা চাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী কোনো ঘটনা ঘটবে না।”
‘এ দেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান সবার’- এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ দেশের প্রতিটা বিষয়ে সবার সমান অধিকার। এটা সংবিধান স্বীকৃত এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে যে কোনো অপতৎপরতা আমরা রুখে দিতে চাই।”
দুর্গোৎসবে পরিপূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, “কেউ যাতে বিশৃঙ্খলা করতে না পারে। কেউ যদি করতে চায় তাকে আমরা আইনের আওতায় নেব। কোনো ধরনের কোনো সুযোগ নেই।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তিন জন উপদেষ্টাসহ সেখানে গিয়েছিলাম। পাহাড়ি-বাঙালি পাশাপাশি থাকলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। সেটাকে ইস্যু করে কোনো একটি পক্ষ চেষ্টা করেছে এটাকে উসকে দিতে। বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে নানা রকম গুজব ছড়িয়েছে।
“সাইবার প্যাট্রলিং এর মাধ্যমে জানতে পারছি কারা এসব রটনা, গুজব, মিসইনফরমেশন ও ডিজইনফরমেশন কারা করার চেষ্টা করছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
‘মব জাস্টিসে’ ছাড় নেই
সরকার পতনের পর মানুষের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার প্রসঙ্গেও কথা বলেন আইজিপি।
তিনি বলেন, “প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, নাম-ধাম সবার পাওয়া গেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
“একটা বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, ‘মব জাস্টিসের’ নামে কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। যে অপরাধ আপনি করলেন, সে অপরাধে কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আপনাকে আইনের আওতায় আসতেই হবে।”
কোথাও কিছু ঘটলে দ্রুত পুলিশকে জানানোর আহ্বান জানিয়ে আইজিপি বলেন, “পুলিশকে সহায়তা করা মানে জনগণকে সহায়তা করা।”
‘নিরীহ কেউ আসামি হলে, ভয় নেই’
সরকার পতনের পর ঢালাও মামলায় সংবাদকর্মীদেরও আসামি করার বিষয়েও আইজিপির কাছে প্রশ্ন রাখেন একজন সংবাদকর্মী।
জবাবে ময়নুল বলেন, “অনেক নিরীহ সাংবাদিক যেমন আছেন, ঠিক তেমনি আমাদের পুলিশ সদস্যরাও আসামি হয়েছে, অনেক বেশি সংখ্যায়।
“যেক্ষেত্রে সাংবাদিক, পুলিশ, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও নিরীহ লোকজন আসামি, সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করা হবে। সদর দপ্তরে আলাদা কমিটি করেছি, কত লোক আসামি হয়েছেন আমরা তথ্য রাখছি। নিরীহ, নিরপরাধ হলে কারও কোনো ভয় পাওয়ার কারণ নেই।”
মামলা হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “ধর্তব্য অপরাধে যদি কেউ জড়িত থাকে তাহলেই কেবল তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে। এটা নিয়ে ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
পুলিশে সংস্কার কত দূর?
পুলিশ সংস্কারে আসা নানা প্রস্তাব কতটুকু এগিয়েছে?- প্রশ্ন ছিল আইজিপির কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “যে ছয়টি কমিশন করা হয়েছে তার একটি পুলিশ সংস্কার কমিশন। তারা তিন মাসের মধ্যে সংস্কার প্রতিবেদন দেবেন। আমরা নিজেরাও সংস্কারের জন্য কমিটি করেছি।
“১১টি দাবি উঠেছিল মাঠ পর্যায় থেকে। তাদের নিয়েই কমিটি করেছি। প্রতিটি দফা আলোচনা করে কোন ক্ষেত্রে কী করা যায় আমরা করছি।”
সংস্কারের জন্য সময় লাগবে জানিয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, “একটি জায়গায় বেশি সংস্কার করতে চাই। মারণাস্ত্র ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অনেক ক্ষেত্রে মানা হয়নি। অনেক জায়গায় ব্যত্যয় ঘটেছিল।
“আমাদের অ্যাপ্রোচে কী কী ভুল হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা করছি। পুলিশের কাজকে কতটুকু মানবিক করা যায় সেটা চেষ্টা করছি।”